• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ভয়ংকর দৃশ্য এবং একজন সমীর কুশারী

লুৎফর রহমান রিটন

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১১ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ভয়ংকর দৃশ্য এবং একজন সমীর কুশারী

সমীর কুশারী এবং রফিকুল হক দাদুভাই। দু’জন প্রিয় মানুষ। চলে গেলেন এক দিনে, গতকাল, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। দু’জনেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু করোনা পরবর্তী ধকল দু’জনকেই ঠেলে দিয়েছে মৃত্যু অভিমুখে। তার ওপরে সমীর কুশারী ছিলেন কিডনি পেসেন্ট। বহুদিন ধরে চলছিলো তাঁর ডায়ালিসিস। 

সদা হাস্যোজ্জ্বল মিষ্টিভাষী স্বভাবে কথায় আচরণে বিনয়ের অবতার সমীর কুশারীকে আমি কোনোদিন কারো সংগে রাগ করতে দেখিনি। উচ্চ কণ্ঠে কথাও বলতে শুনিনি কখনো।  

সমীর কুশারী বিটিভিতে চিত্রগ্রাহক হিশেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। তারপর ২০০৯ পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর কাজ করেছেন বিটিভিতে। অবসরে যাওয়ার সময় তিনি ছিলেন বিটিভির মূখ্য চিত্রগ্রাহক পদে আসীন। 

বিটিভিতে যোগ দেওয়ার আগে কাজ করতেন চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিশেবে। ১৯৬৯ সালে চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের সহকারি হিসেবে ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন সমীর কুশারী । ১৯৭৩ সালে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন সহকারি চিত্রগ্রাহক।  

বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন মেধাবী চিত্রগ্রাহক ছিলেন সমীর কুশারী। বিটিভির দর্শকদের স্মৃতিতে নামটা ঝলমলে। কারণ সাদা-কালো টিভির আমল থেকেই টিভির পর্দায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পর প্রচারিত টেলপে যে ক’টা নাম প্রায় প্রতিদিন ভেসে উঠতো, সমীর কুশারী তাঁদের অন্যতম। বহু বহু বিখ্যাত নাটক কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ ছাড়াও আউটডোর শ্যুটিং-এ সমীর কুশারী ছিলেন একটি নির্ভরযোগ্য নাম। 

দর্শকদের নিশ্চয়ই মনে আছে স্টুডিওতে ধারণ করা ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রির কথা। কিংবা আউটডোরে ধারণকৃত ও সরাসরি সম্প্রচারিত ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের সেই অনুষ্ঠানটির কথা যে অনুষ্ঠানে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো? দু'টি অনুষ্ঠানেই চিত্রগ্রাহকের ভূমিকায় ছিলেন সমীর কুশারী।

সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দেখেছে- ২০০১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, পহেলা বৈশাখের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সেই সকালে যখন সঙ্গীত পরিবেশন করছেন ছায়ানটের শিল্পীরা, তখন হঠাৎ মঞ্চের একেবারে সামনেই দর্শকদের সারিতে বিকট শব্দে বিস্ফারিত হয়েছিলো বোমা। মঞ্চের দুই দিকে দু'টি উঁচু বেদি নির্মাণ করে সেখানে বিটিভির দু'টি বড় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিলো। বাম দিকের ক্যামেরায় দায়িত্বপালন করছিলেন সমীর কুশারী। 

আমরা দেখেছি সমীর কুশারী চালিত সেই বাম দিকের ক্যামেরার আওতায় থাকা দর্শকসারিতে হঠাৎ বিস্ফোরণ এবং ধোঁয়ার কুন্ডলি। সেই ধোঁয়ার ভেতরে ছটফট করছে ছিন্নভিন্ন মানবদেহ। 

পরবর্তীতে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সমীর কুশারী আমাকে জানিয়েছিলেন সেই ভয়াল ভয়ংকর সকালের কথা। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কাকা, তোমার চোখ তো ছিলো ক্যামেরায়। কী করে বুঝলে যে একটা ভয়াবহ ঘটনা এইমাত্র ঘটে গেছে! বিস্ফোরণের শব্দে? নাকি ধোঁয়ায়? নাকি মানুষের আর্তচিৎকারে?

সমীর কুশারী বলেছিলেন, ‘দ্যাখ, আমার চোখ তো ছিলো ক্যামেরায়, কানে হেডফোন, হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ, কিছুটা ধোঁয়া, ভাবলাম ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিটের কোনো ব্যাপার হয়তো। হেডফোনটা কান থেকে খুলে নিয়ে ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি, আরে না ঘটনা তো আরো ভয়ংকর কিছু! এটা তো বোমার বিস্ফোরণ! ঘটনাটা ক্যামেরায় তোলার জন্যে আমি ক্ষিপ্র গতিতে কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্যামেরা জুম ইন করে ধোঁয়ার কুন্ডলিতে চলে গেলাম। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য মুহূর্তেই আমাকে এলোমেলো করে দিলো। আমি দেখলাম পুড়ে যাওয়া ছিন্নভিন্ন কয়েকজন মানুষের শরীর। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নড়ছে। সেখান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শরীরে আমার কম্পন শুরু হলো। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। গা গুলিয়ে বমির উদ্রেক হলো। পৃথিবীটা দুলে উঠলো। অন্ধকার হয়ে গেলো আমার সবকিছু। যাকে বলে ব্ল্যাক আউট। আমি অতি দ্রুত হেডফোন ক্যামেরা সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে উঁচু বেদি থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে বমি করে ফেললাম। রিটন, সারাটা জীবন কতো শত সহস্র দৃশ্য আমি শ্যুট করেছি ক্যামেরায়। কিন্তু সেই সকালের এরকম তরতাজা ছিন্নভিন্ন মানুষের ছটফটানো শরীর আমি কোনোদিন শ্যুট করিনি রে...! এরকম দৃশ্য কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। ঘটনাটা আমার ক্যামেরাজীবনের একটা ভয়াল ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতোই।’

ঘটনার দীর্ঘদিন পর, সমীর কুশারী আমাকে ঘটনার স্মৃতিচারণ করার সময়ও কেমন বেদনার্ত আর বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলেন বারবার। ঘটনাটা একটা ট্রমার মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলো তাঁকে।  

০২ 
আমার খুব ঘনিষ্ঠ এবং কাছের মানুষকে আমি প্রায়শঃ কাকা সম্বোধন করতে পছন্দ করি। এবং যাঁদের আমি কাকা সম্বোধন করি তাঁদের আমি ‘তুমি’ বলে থাকি। যেমন খায়রুল আলম সবুজ। কিংবা যেমন আবেদ খান। সেরকম বিটিভির বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক সমীর কুশারীও ছিলেন আমার কাকা। আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, যাঁদের আমি কাকা এবং তুমি বলি, তাঁরা আমাকে তুই করে বলেন। যেমন বলতেন সমীর কুশারীও।
  
সমীর কুশারী যে মন্ট্রিয়লে তাঁর সন্তানদের কাছে চলে এসেছিলেন সেটা আমার জানা ছিলো না। অনেকদিন দেখা হচ্ছিলো না আমার সংগে সমীর কুশারীর। 

২০১৮ সালের জুলাই-অগাস্টের এক দুপুরে প্রীতিভাজন মিহির কান্তি রাউত মন্ট্রিয়ল থেকে ড্রাইভ করে অনেক দিন দেখা না হওয়া আমার কাকাকে নিয়ে এসেছিলো অটোয়ায়, আমার কাছে। কী যে খুশি হয়েছিলাম আমি! 

তাদের সংগে এসেছিলো অশোক তেওয়ারী নামের একজন হাস্যোজ্জ্বল তরুণ। সেই দুপুরে আমরা বিশাল আড্ডার এক পর্যায়ে (আমার কাজের ক্ষেত্র) লিংকনফিল্ড মল-এ লাঞ্চ করেছিলাম একসংগে। তারপর শুরু হয়েছিলো দীর্ঘ আড্ডা, আমাদের। ঢাকায় আমার এবং তাঁর কমন পরিচিত সার্কেলের বহুজনের নাম ধরে ধরে কতো কথাই না বললাম আমরা! 

সেদিন কাজ থেকে খানিকটা আগেভাগেই ছুটি নিয়ে সমীর কুশারীকে অপূর্ব একটা সূর্যাস্ত দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম ব্রিটানিয়া পার্কে যার নাম দিয়েছি আমি পতেঙ্গা। কারণ এখানে অনেক বড় বড় পাথর, পতেঙ্গার মতো, এবং সেখানে আছড়ে পড়ে ঢেউ অটোয়া রিভারের। সেই শেষ বিকেলে সেই সন্ধ্যায় অটোয়া শহরের পতেঙ্গার অপরূপ সূর্যাস্ত মুগ্ধ করেছিলো সমীর কুশারীকে। সমীর কুশারীর সংগে সেই বিকেলের ঝকঝকে স্মৃতিটা স্মৃতিতে আজও ভাস্বর। 

সেদিন বিদায়ক্ষণে আমি আমার কাকা সমীর কুশারীকে বলেছিলাম, ফের আমরা মিলিত হবো অটোয়া কিংবা মন্ট্রিয়ল কিংবা বাংলাদেশে। তুমি ভালো থেকো কাকা।

কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় আলিঙ্গনে জাপটে রেখেছিলেন দীর্ঘসময়। 

সেটাই আমার শেষ দেখা শেষ কথা শেষ স্পর্শ- সমীর কুশারীর সংগে।

প্রিয় সমীর কুশারী, প্রিয় সমীর দা, প্রিয় কাকা আমার, শান্তিময় হোক তোমার অনন্তযাত্রা। খুব ভালো থেকো তুমি অমৃতলোকে।  

অটোয়া ১০ অক্টোবর ২০২১

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: