কবি ফররুখ আহমদকে প্রথম ও শেষ দেখা

শা’ নযর
কবি ফররুখ আহমদকে প্রথম কাছে থেকে দেখি ১৯৬৮ সালে। কবি কথা বলছিলেন পুরান ঢাকার কারকুন বাড়ী লেনে সাপ্তাহিক 'জাহানে নও' অফিসে বসে। পত্রিকা অফিসের ক্ষুদ্র কক্ষটি বাংলা কাব্য গগনের উজ্জল জ্যোতিষ্ককে ধারণ করে তখন আলোর বন্যায় ভাসছিলো। ক’জন মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মঝে আমি তাতে হারিয়ে যাই। 

‘সাত সাগরের মাঝি’র অমর স্রষ্টা, ‘হাতেম তায়ী’র মহান রূপকার, ‘লাশ’, ‘ডাহুক’ আর ‘ঝরোকার’ কবি আমার এতো কাছে বাবরী চুল দুলিয়ে কথা বলছেন! এই ছিল আমার কাছে অনাস্বাদিত স্বপ্ন।
 
আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে কবির রাতজাগা পাখির মতো উজ্জ্বল দু’টি চোখ। সে চোখে প্রচন্ড অস্থিরতা। আরব্যোপন্যাসের সিন্দাবাদ নাবিকের মতোই তাঁর সারা অবয়বে গভীর অতৃপ্তি আর সুদূরচারী কল্পনার সীমাহীন আর্তি। বিস্মিত আনন্দিত পলকহীন চোখে সমুদ্রচারী নাবিককে দেখছিলাম। কবি কথা বলছিলেন আর রাতজাগা চোখের অস্থিরতা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর জিজ্ঞাসার বিদ্যুতমোহন দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছিলো। আনন্দ-উদ্দীপনায় চঞ্চল হচ্ছিলেন কবি। কখনও বেদনামথিত হাহাকার অস্থির করে তুলছিল তাঁকে। কবি-হৃদয়ের সেই আবেগ-উত্তাপে আমরা গলে গলে একাকার।
 
কবিকে কাছে থেকে প্রথম দেখার সেই স্মৃতি আজও আমার হৃদয়ে আলোর পাখির ডানা ঝাপটায়। এর পর বারবার কবির কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কখনও কারো সাথী হয়ে, কখনো দল বেঁধে। কখনও একাকী গেছি তাঁর কাছে। কবির সংগে সাক্ষাতকারগুলো ছিলো তাঁর স্বপ্নের অনির্বচনীয় আনন্দধারায় অবগাহনের অভিজ্ঞতা। প্রত্যয় ও প্রত্যাশায় এমন প্রাণময়, ওজস্বী, উদ্দীপ্ত ও বেগবান কোনো মানুষ আমি আর দেখিনি। বিশাল কবি-সত্তার অধিকারী আর সেই সংগে প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ব্যক্তি মানুষ ফররুখ আহমদ। কবি-মানস ও ব্যক্তি মানসের অনুপম সামঞ্জস্য তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চিন্তা ও কর্মে, কথায় ও জীবনচর্চায় ধনুকের ছিলার মতো সটান মানুষ। পর্বতসম কবি ফররুখ আহমদ দূর থেকে জ্যোতির্ময়। কাছে থেকে দেখা মানুষ ফররুখ ছিলেন তেমনই আকর্ষণীয়। 

লাশ-এর কবি যখন লাশ হলেন
বাংলাদেশ আমলে সীমাহীন বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হন কবি। তাঁর বিরুদ্ধে অবরোধের দেয়াল তোলা হয়। রেডিওর চাকরিটি তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। চতুর্মুখী প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কবি আত্মসমর্পণ করেননি। আপন আলোকিত সত্তা বিসর্জন দেননি জড়ত্বের কাছে। ঘরে বসে তখনও একান্ত মনে তিনি কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। এসময়ে কবি স্বনামে কোথাও কোনো কবিতা ছাপতে দিয়েছেন মনে পড়ে না। এসময় তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা ’সোনার বাংলা’য় মুদ্রণ করার পাশাপাশি আমরা কিছু নতুন কবিতা সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’য় ছেপেছি ছদ্মনামে।
 
‘সোনার বাংলা’র ‘বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যায় আমরা একবার একপাশে রবীন্দ্রনাথ ও অন্য পাশে ফররুখ আহমদের ‘বৈশাখ’ কবিতা প্রকাশ করি। বৈশাখ নিয়ে দু’টি কবিতায় দু’টি জাতিসত্তার রূপটিও সেখানে চমৎকার ফুটে ওঠে। কবির মৃত্যুর বছর ‘চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে’র মৃত্যুছায়া গ্রাস করে বাংলাদেশকে। তখন আমরা ’সোনার বাংলা’য় ছেপেছিলাম ফররুখ আহমদ-এর ‘লাশ’ কবিতাটি। দেশে লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। তখন মনে হয়েছে কবি যেন ‘লাশ’ কবিতাটি এইমাত্র লিখে দিয়েছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে লেখা ফররুখ-এর ‘লাশ’ নতুন পরিস্থিতির সমান্তরালে দাঁড়িয়ে ‘মৃত সভ্যতার দাস’দের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করছিলো।
 
সেই দুর্ভিক্ষে সরকারের অর্থমন্ত্রী আবদুল মোমেন-এর জাতীয় সংসদে দেওয়া বিবৃতি অনিযায়ী ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আমরা আমাদের শিরোনামে শুধু প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘সাতাশ হাজার না সাতাশ লাখ?’ বিদেশি পত্রপত্রিকায় সে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলা হয়। ভারতীয় কোনো কোনো মাধ্যমে পঞ্চাশ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়। সে দুর্ভিক্ষ নিয়ে তখন বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণ প্রচুর লিখেছেন। ফটো সাংবাদিকদের তখনকার তোলা কিছু ছবি বিশ্বখ্যাত হয়েছে। কিন্তু কয়েক দশক আগের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে লেখা ফররুখ আহমদ-এর ‘লাশ’ কবিতার তুল্য কোনো কবিতা তখন ছাপা হয়নি। বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদ-এর কালজয়ী প্রতিভা আর তাঁর সর্বকালীন প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি তখন আবার সামনে আসে।
 
কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে মৃত্যুর ক’দিন আগে আমাদের বিশেষ অনুরোধে রোগশয্যা থেকে ‘সোনার বাংলা’র ‘ঈদ সংখ্যা’র জন্য একটি কবিতা লিখে দেন। এই কবিতার জন্য তিনি ‘আহমদ আবদুল্লাহ’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। আমার জানা মতে, এটিই তার লেখা শেষ কবিতা। (এই কবিতা সমেত সোনার বাংলার ১০ অক্টোবর ১৯৭৪ সংখ্যার একটি কপি আমি ১৯৯২ সালে আবদুল মান্নান সৈয়দকে তাঁর গবেষণার জন্য দিই)। 

১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় নারিন্দায় চাচার বাসায় টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ বজ্রপাত হলো। টিভির পর্দা জুড়ে কবি ফররুখ আহমদ-এর ছবি ভেসে উঠলো। বিটিভিতে ক’বছরে একবারও তার নাম শুনিনি। তাঁর ছবি দেখে কাউকে কিছু না বলে ছুটে বের হয়ে ইস্কাটনের দিকে ছুটলাম। ‘লাশ’-এর কবি সেখানে লাশ হয়ে শুয়ে আছেন।

তাঁকে ঘিরে কবির ভাগ্নে ডক্টর হাসান জামান, কথাশিল্পী শাহেদ আলী, কবি তালিম হোসেন, ডক্টর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সুরকার আজাদ রহমানসহ ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ জড়ো হতে শুরু করেছেন। 

পরদিন সকালে কবিকে ইস্কাটনের সরকারি বাসায় গোসল করানো হয়। সাদা কাফনে আবৃত কবিকে তিনতলা থেকে স্বল্প প্রস্থ সিঁড়ি বেয়ে কোলে করে নীচে নামানোর দায়িত্বটা রুরুদ্ধ আবেগে ছিনিয়ে নিলাম। চারদিক থেকে ভক্তরা জড়ো হলেন নিউ ইস্কাটন মসজিদের সামনে। সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলা আসেননি। কবি আজীবন রাজ-রাজড়াদের এড়িয়ে গেছেন। সেটা বুঝেই বোধ করি তারা ফররুখের লাশের কাছেও ঘেঁষতে সাহস করেননি।

কবির কবরের জায়গা নিয়ে কথা হচ্ছিলো সকাল থেকেই। কেউ কেউ বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে বা ফজলুল হক মুসলিম হল মসজিদের পাশে মুসা খান ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মাজারের পাশে কবর দেওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষের সাড়া মেলেনি। কবি শহরে কোনো জায়গা রেখে যাননি। ভাবনার অবসান ঘটাতে ছুটে এলেন কবি বেনযীর আহমদ। দু’হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ’আমার ভাইকে আমার কাছে নিয়ে যেতে দিন।’
 
জানাজা শুরুর সময় দূর থেকে একজন ছুটে এলেন। হাতে একটি আতরের শিশি। ‘সিরাজাম মুনীরা’র কবিকে তাঁর এক ভক্ত আতর পাঠিয়েছেন নবীর মদীনা থেকে। জীবিত কবি এই উপহার গ্রহণ করতে পারেননি। সে আতরে কবির কাফন সিক্ত হলো।
 
জানাজার পর লাশ নিয়ে মিছিল চললো কবি বেনযীর আহমদ-এর বাড়ির উদ্দেশে। ফররুখ আহমদ প্রথমে ঢাকায় এসে উঠেছিলেন কবি বেনযীর আহমদ-এর বাসায়। তখন তার বাসা ছিলো আগা মসিহ লেন। আর কবির শেষ-শয্যা রচিত হলো বেনযীর আহমদ-এর শাহজাহানপুরের বাড়িতে। 

কবির লাশ কবরে নামানোর সময় সামরিক বাদ্যে লাস্ট পোস্টের সুর মুর্ছিত হলো না। তবে হাজারো অশ্রুসিক্ত ভক্তের সংগে সমগ্র প্রকৃতি নিথর দাঁড়িয়ে সমুদ্রযাত্রী সিন্দাবাদ নাবিককে বিদায়ী সালাম জানালো।

লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া