• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

শ্রীজ্ঞান যতীন সরকার

লুৎফর রহমান রিটন

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ১৮ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ১৯:৫০, ১৮ আগস্ট ২০২২

ফন্ট সাইজ
শ্রীজ্ঞান যতীন সরকার

বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় শ্রীজ্ঞান যতীন সরকার ও মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে লুৎফর রহমান রিটন। সময়কাল ২০০৮

যতীন নামটি প্রথম দেখি খুব ছেলেবেলায়, হারমোনিয়মের মধ্যে, কাঠখোদাই লেটারিং কিংবা স্টিলের পাতে লেখা ছিলো-যতীন এ্যান্ড কোং । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পীরা গাইছেন আর আমি গান শোনার পাশাপাশি লক্ষ করছি হারমোনিয়মটি যতীনের কিনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো হারমোনিয়মটি যতীনেরই। আমার শিশুমনে তখন প্রশ্ন জেগেছিলো একজন যতীনের অনেকগুলো হারমোনিয়ম নাকি যতীনের একটি হারমোনিয়মই ব্যবহার করছে সবাই? যতীন একজন নাকি অনেকজন?
এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। শিশুদের বিভ্রান্ত করতে বড়দের পটুত্বের সীমা নেই। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন-যতীন একজনই এবং যতীনের একটিই হারমোনিয়ম এবং আমি সেই একটি হারমোনিয়মই দেখছি বারবার। ভদ্রলোকের কথা আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে আসছিলাম।

বাংলা একাডেমি পুরস্কারের ক্রেস্ট হাতে শ্রীজ্ঞান যতীন সরকারের সঙ্গে মঞ্জুরে মাওলা ও লুৎফর রহমান রিটন। সময়কাল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
একদিন, আমি তখন কিশোর, একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছি আমি মৌচাকের মোড় থেকে রামপুরা টেলিভিশন ভবনের দিকে। যাচ্ছি রিকশায়। সহসা আমার চোখ আটকে গেলো একটি সাইনবোর্ডের দিকে। সাইনবোর্ডে লেখা-যতীন এ্যান্ড কোং। আরে! এতো দেখছি বাদ্যযন্ত্রের একটি ছোট্ট দোকান!
রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লাম। দোকানের ভেতর থরে থরে সাজানো অনেকগুলো হারমোনিয়ম।
কয়েকটির পিঠ দেখা যাচ্ছে আর তাতে লেখা যতীন এ্যান্ড কোং! আমি বুঝে গেলাম সেই ভদ্রলোক আমাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। যতীনের হারমোনিয়ম একটি নয়, অনেকগুলো।
আমার তখন ডানা মেলবার দিন। রঙ তুলি আমাকে টানে। গল্প কবিতা আর ছড়া আমাকে টানে। আর প্রবলভাবে টানে গান। ভর্তি হয়েছি র্যাংনকিন স্ট্রিটের সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেনের ক্যাম্পাসের কচি-কাঁচার মেলায়। আমার গানের শিক্ষক সুখেন্দু চক্রবর্তী। হারমোনিয়ম বাজিয়ে বাজিয়ে আমাদের গান শেখান সুখেন্দু স্যার। যে হারমোনিয়মটি তিনি বাজান সেটিও যথারীতি যতীনের।
এভাবেই আমার জীবনে যতীনের আগমন।
ক্রমশঃ বড় হচ্ছি। স্কুল পালিয়ে বাংলাদেশ পরিষদ লাইব্রেরিতে বসে ঘাড় গুঁজে সারাদিন বই পড়ে বিকেলে বাড়ি ফিরি সুবোধ বালকের মতো। এই লাইব্রেরিতে আসার কল্যাণেই খোঁজ পেলাম আরেক যতীনের। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়া টগবগে কিশোর তরুণ আর যুবকদের তালিকায় আবিস্কার করি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনকে। ভারতের প্রথম শহীদ মঙ্গল পান্ডে,ক্ষুদিরাম,প্রফুল্ল চাকী, কানাই, সত্যেন, চারুচন্দ্র বসু, মদনলাল ধিংড়া, অনন্ত লক্ষণ কানহেরে,বিনায়ক দেশপান্ডে, বালমুকুন্দ, সীতারাম রাজু, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, বিনয়, বাদল, দীনেশ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, উধম সিং, কল্পনা দত্ত, সূর্যসেনদের পাশাপাশি পেয়ে যাই যতীন দাস নামের তৃতীয় আরেক যতীনকে। যাঁদের আত্মত্যাগ আর অকাতর রক্তপাতের ফসল এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা।
ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা যতীন এবং হারমোনিয়মের পেছনে সেঁটে থাকা যতীনের পর আরো একজন যতীনের উপস্থিতি আমি লক্ষ করি পত্রিকার পাতায়। দৈনিক সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকার সাময়িকী পাতায় তাঁর লেখা গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়। তবে আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ি তাঁর একটি ধারাবাহিক রচনা-ব্যাকরণের ভয় অকারণ (নাকি গল্পে গল্পে ব্যাকরণ? ), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশু পত্রিকায়। আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলার ছলে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের মতো নিরস একটি বিষয়কেও প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি, ছোটদের কাছে।
কিন্তু জীবিত এই যতীনের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছিলাম এর অনেক পরে, যিনি আমাকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
আমি তখন লেখক হবার স্বপ্নে বিভোর। সবকটা দৈনিকের ছোটদের পাতা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত সংকলনে নিয়মিত হাজির থাকি ছড়া নিয়ে। সময়টা সত্তুরের দশকের শেষপ্রান্ত, ১৯৭৯।
লিটিলম্যাগে লেখালেখির সুবাদে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় সরকার জসীম, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল(বিখ্যাত সাংবাদিক), নাসরীন জাহান(বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক),আতাউল করিম সফিকসহ ময়মনসিংহের কয়েকজন কিশোর-তরুণ ছড়াকারের সঙ্গে। সফিক আমাকে আমন্ত্রণ জানালো ওদের একটি অনুষ্ঠানে। ময়মনসিংহে ছড়া সংসদ গঠন করেছিলো সফিকরা।
ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সেই অনুষ্ঠানে সভাপতির আসনে ছিলেন যতীন সরকার নামের একজন সুদর্শন অধ্যাপক। শাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত সামান্যদীর্ঘ ঘনকালো চুল ও গোঁফের সঙ্গে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই মানুষটিকে সামনা সামনি দেখে এবং তাঁর কথা শুনে আমিতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অতিনগণ্য তরুণ এক ছড়াকার আমি, যার লেখা একটি বইও প্রকাশিত হয়নি তখন পর্যন্ত, (আমার প্রথম বই বেরিয়েছিলো ১৯৮২ সালে) কিন্তু কি গভীর মমতা আর আন্তরিকতায় তিনি আমার লেখার মূল্যায়ন করলেন! পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত আমার ছড়াগুলো তাঁর মতো একজন মণীষী এতোটা মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেন জেনে বিষ্ময়ে অভিভূত আমি। বাংলা ছড়ার ইতিহাস আমার কিঞ্চিৎ জানা ছিলো কিন্তু তিনি তাঁর সভাপতির ভাষণে ছড়া বিষয়ে এমনই পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন যে আমার মুগ্ধতা শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হলো।
আমাকে নিয়ে অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করলেন তিনি। ভবিষ্যতে ছড়ার ক্ষেত্রে আমার দায়িত্বের কথাও আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমি অনেকটা হতচকিত এবং কিছুটা বিব্রতও বোধ করলাম তাঁর বক্তব্যে।। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে তাঁর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো-সফিক আমাকে নিয়ে যাবে যতীন সরকারের বাড়িতে, বিকেলে।
প্রসন্ন সেই বিকেলে গিয়েছিলাম যতীন স্যারের বাড়িতে। অমায়িক আন্তরিকতায় এগিয়ে এসে আমাদের তিনি নিয়ে গেলেন বৈঠকখানায়। বেশ প্রশস্ত একটি টেবিলকে ঘিরে অনেকগুলো শাদামাটা কাঠের চেয়ার।
ঘরের আসবাবপত্রে বাড়তি জৌলুস নেই। পোড়ার দেশের বিধান অনুযায়ী একজন সৎ ও মেধাবী অধ্যাপকের খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ থাকতে নেই, থাকার মধ্যে তাঁর থাকবে বিপুল মেধা আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার চে বিপুল দারিদ্র্য। না, আমি বলছি না যতীন স্যারের অর্থনৈতিক দারিদ্র্য আমি অবলোকন করেছি। তবে বলতে চাইছি যতীন স্যারের হাঁটুসমানযোগ্য শহুরে সংস্কৃতিবানরাও তুলনায় যাপন করেন অধিকতর বিলাসবহুল জীবন। ওপরচালাকীতে পরিপূর্ণ রাজধানীর বিবৃতিবাজ স্বার্থপর বুদ্ধিজীবীরা নিভৃতচারী মফস্বলবাসী একজন যতীন সরকারের মেধার দীপ্তি আর প্রখর প্রজ্ঞার কাছে পরাভূত হন কিন্তু যতীন সরকার হন বঞ্চিত, তাঁর সমুদয় প্রাপ্য থেকে। কিন্তু তাই বলে না পাওয়ার বেদনায় মুষড়ে পড়েন না যতীন সরকার। বেদনায় কাতর কিংবা গাঢ় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন না যতীন সরকার। আমরা লক্ষ করি মফস্বলবাসী একজন মানবতাবাদী কমিউনিস্ট, আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক লেখক দার্শনিক যতীন সরকার নিরবে নিভৃতে জাতির মনন ও মেধার বিকাশে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন নিষ্ঠা সততা আর বিপুল মেধার অকৃপন সমন্নয়ে।
১৯৭১-এ এই কী ভয়ংকর নিপীড়নের শিকারই না হয়েছিলেন এই জ্ঞানতাপস! 
০২
এরপর দীর্ঘকাল আমার সঙ্গে আর দেখা হয় না যতীন স্যারের।
কিন্তু আমি তাঁর লেখা পাঠ করি নিয়মিত। তাঁর লেখা পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন পড়েছি। বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য পড়েছি। ২০০১ এর মধ্য জুন থেকে আমি প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছিলাম। আমার দুঃসহ প্রবাস জীবনেও আমি যতীন সরকারের আলোকচ্ছটা থেকে বঞ্চিত ছিলাম না। ইন্টারনেটের কল্যাণে পত্র-পত্রিকায় যতীন স্যারের লেখা আমি পেয়ে যাই অবলীলায়, আটলান্টিকের এপারে বসেও।
সাপ্তাহিক ২০০০-এ তাঁর ধারাবাহিক আত্মকথা পাকিস্তানের ভূতদর্শন ও পড়েছি গভীর আগ্রহ নিয়ে, আমার দুঃসহ প্রবাস জীবনে।
এই রচনাটি লিখবার সময়েও মাঝপথে বিরতির কালে আমার পড়ার সৌভাগ্য হলো তাঁর লেখা একটি বুক রিভিউ (গল্পের আধারে নির্মম বাস্তবের আলোকচিত্র, দৈনিক সমকাল,০৬ জুন ২০০৮)। নতুন পত্রিকা সাপ্তাহিক এর আত্মপ্রকাশ সংখ্যায় পড়লাম তাঁর লেখা বিনষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা।
বলছিলাম, দীর্ঘকাল দেখা হয় না যতীন স্যারের সঙ্গে। প্রায় তিরিশ বছর পরে অবশেষে দেখা হলো, ২০০৮এর ফেব্রুয়ারিতে। সাড়ে ছয় বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে আমি বাংলাদেশে ফেরার ছাড়পত্র পেলাম।
চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলে কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস আমাকে পাসপোর্ট দিচ্ছিলো না।
১/১১ এর পর তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আমি বহু কাঙ্খিত পাসপোর্টটি পেলাম (অগ্রজ এক প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিকের আন্তরিকতা ও সক্রিয় ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কল্যাণে) ২০০৭এর নভেম্বরে, এবং নভেম্বরেই বাংলাদেশে গেলাম। ফেব্রুয়ারির এক থেকে ঊনত্রিশ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেলে বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রাঙ্গন থেকে চ্যানেল আই একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতো সরাসরি। বইমেলা প্রতিদিন নামের লাইভ সেই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতাম আমি। লেখক-শিল্পী-প্রকাশক পাঠকদের সাক্ষাৎকার এবং নতুন বইয়ের খবর থাকতো সেই অনুষ্ঠানে। এক দুপুরে আমার মুঠোফোন বেজে উঠলো। অপর প্রান্তে এককালের বহুল পরিচিত ছাত্রনেতা লোটন। আলমগীর শিকদার লোটন। এখন পাবলিশার। লোটন জানালো-বই মেলায় বিকেলে সে অধ্যাপক যতীন সরকারকে নিয়ে আসছে, ময়মনসিংহ থেকে। শুনে তো আমি মহা উল্লসিত। লোটনকে বললাম স্যারকে আমাদের চ্যানেল আই-এর অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসতে। ফোনে যতীন স্যারকেও আমি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানালাম। প্রায় তিরিশ বছর পর কথা হলো স্যারের সঙ্গে।
বিকেলে স্যার এলেন আমাদের অনুষ্ঠানে। আমাকে সামনা সামনি দেখতে পেয়ে সে কী আনন্দ যতীন স্যারের চোখে মুখে! দেখলাম আমার সম্পর্কিত যাবতীয় খোঁজ খবর স্যারের জানা। এমন কি আমি যে দেশে ফিরতে পারছিলাম না সেই খবরটিও। এমনকি চ্যানেল আই-এর বইমেলা প্রতিদিনের কয়েকটি পর্বও তিনি দেখেছেন।
যতীন স্যারের সাক্ষাৎকার নেবো আমি, কিন্তু আগে থেকে কোনো প্রশ্ন নির্ধারিত থাকেনা এই অনুষ্ঠানে। স্যার তবুও জিজ্ঞেস করলেন কোন বিষয়ে আমি জানতে চাইবো। আমি বললাম তাতো জানি না স্যার, আমি শুধু এইটুকু জানি যে আমি অধ্যাপক যতীন সরকারের সাক্ষাৎকার নেবো। এবং আমি আরো জানি যে আমার সব প্রশ্নের উত্তরই পন্ডিত যতীন সরকারের জানা। এমন কোনো প্রশ্ন আমার নিজেরই জানা নেই যার উত্তর যতীন সরকার জানেন না। শুনে স্যার হাসলেন। নিষ্পাপ শিশুর মতো সরল স্নিগ্ধ হাসি। বললেন-তুমি তো একদম আগের মতোই আছো!
লাইভ অনুষ্ঠানে অনেক কথা হলো যতীন স্যারের সঙ্গে। এই অনুষ্ঠানেও আমাকে নিয়ে বিপুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন তিনি। আমাদের কথা সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশে। একুশের চেতনা,বাংলা একাডেমীর বইমেলা, তরুণ প্রজন্ম, নানান বিষয়ে আমরা কথা বলছি। হঠাৎ প্রশ্ন করলাম-প্রায় বছর পঁচিশ আগে মাসিক শিশু পত্রিকায় বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে আপনি অসাধারণ একটি ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলেন। তাই না স্যার?
--আরে তোমার মনে আছে সেই কথা!
--কেনো থাকবে না? আপনার লেখাটির সঙ্গে শিল্পী আসেম আনসারী চমৎকার ইলাস্ট্রেশন করতেন।
--হ্যাঁ, তুমি আমাকে বহু পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে!
--তো ছোটদের জন্যে আগামীতে তেমন কোনো পরিকল্পনা কি আপনার আছে? আর কিছু কি লিখবেন
তাদের জন্যে?
আমার আচমকা প্রশ্নের কারণেই হোক কিংবা তাঁর পূর্ব পরিকল্পনার কারণেই হোক পৃথিবীর নানান প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দর্শকরা জানলেন একটি বইয়ের কথা। যতীন সরকার বললেন, -হ্যাঁ, দর্শন বিষয়টাকে ছোটদের বোঝানোর জন্যে, ছোটদের উপযোগী দর্শন বিষয়ক একটি বই লিখবো।
০৩
দিন দশেক পর আবার ফোন লোটনের। স্যার আবার আসছেন বইমেলায়। লোটনই তাঁকে নিয়ে আসছে।
লোটনকে বললাম আমাদের অনুষ্ঠানস্থলে ফের স্যারকে নিয়ে আসতে। স্যার এলেন। সেই বিকেলে স্যারের সঙ্গে আরো একজনকে পেলাম বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। আমার বাম পাশে যতীন সরকার এবং সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ক্যামেরা অন হলো। আমি বলতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে বললাম,--প্রিয় দর্শক, আজ আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন এমন দুজন লেখক, কিছুকাল আগে ঢাকার বিখ্যাত একটি দৈনিক পত্রিকা বর্ষসেরা গ্রন্থের লেখক হিশেবে যাঁদের পুরস্কৃত করেছে, এঁরা হচ্ছেন,সৃজনশীল শাখায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং মননশীল শাখায় অধ্যাপক যতীন সরকার। আজ আমরা পেয়েছি দুজনকেই একসঙ্গে...সৃজনশীল আর মননশীল এই দুটির পার্থক্য বা এই বিভাজনকে আপনি কিভাবে দেখেন? আমার প্রশ্নের জবাবে যতীন সরকার সহাস্যে বললেন,
--হ্যাঁ, প্রথম আলো পত্রিকাটি সৃজনশীল আর মননশীল শাখায় আমাদের দুজনকে মনোনীত করেছিলো। কিন্তু আমি মনে করি -যে ব্যক্তি মননশীল নয় তাঁর পক্ষে সৃজনশীল হওয়া সম্ভব নয় আবার সৃজনশীল না হলে মননশীল হওয়াওতো সম্ভব না!
এই হচ্ছেন যতীন সরকার।
০৪
এ বছর ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করলো। আমি তখন সরাসরি বইমেলা প্রতিদিন অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছিলাম। অনুষ্ঠানটির শেষ পর্যায়ে আমি যখন অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছি তখন প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমাদ মাযহার হন্তদন্ত হয়ে ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে পড়লো এবং একটুকরো কাগজ দেখিয়ে বললো-এইমাত্র বাংলা একাডেমী মঞ্চে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ২০০৭ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেই খবরটি চ্যানেল আইএর দর্শকদের জানাতে চায় সে। মাইক্রোফোনটি নিজের হাতে নিয়ে মাযহার অত্যন্ত নার্ভাস ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পাঠ করলো--এ বছর বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবিতায় মঞ্জুরে মাওলা, প্রবন্ধে যতীন সরকার (স্যারের নামটি শুনে কী যে খুশি হলাম!) এবং শিশু সাহিত্যে.... শিশুসাহিত্যে.... বলতে বলতে মাযহার ডানে বামে তাকাচ্ছে....।
ঘটনা কী? চ্যানেল আইএর যে কর্মীটি মঞ্চে ঘোষিত পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম কাগজে টুকে এনেছে সে শুধু শিশুসাহিত্য বিভাগটির নামই লিখেছে। কিন্তু এই বিভাগে পুরস্কারটি কে পেয়েছে তাড়াহুড়োয় সেটাই লেখেনি। মাযহার রীতিমতো ঘামছে। সরাসরি সম্প্রচার বলে কথা। দর্শকরা তার ঘর্মাক্ত এবং টেনশন জর্জরিত মুখটি অবলোকন করছেন। এমন ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করলো বাদল চৌধুরী নামের চ্যানেল আইএর সেই কর্মীটিই, যে মাযহারকে কাগজের টুকরোটি সরবরাহ করেছে।
ক্যামেরাম্যানের পাশে দাঁড়িয়ে সে মাযহারকে বারবার বললো-রিটন ভাই, রিটন ভাই। এবং মাযহার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ঘোষণা করলো আমার নামটি। অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে থাকা মেলায় আগত লোকজন করতালিতে মুখর হয়ে আমাকে অভিনন্দিত করলো। মাযহার আমার অনুভূতি জানতে চাইলো।
আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি পুরস্কার প্রাপ্তিতে। প্রাপ্তির এই আনন্দ আমার দ্বিগুণ হয়ে গেছে যতীন সরকারের কারণে। একজন যতীন সরকারের সঙ্গে পুরস্কৃত হওয়া বলে কথা! সরাসরি সম্প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে আমি আমার পুরস্কারটি আমার বন্ধু এবং স্ত্রী শার্লিকে উৎসর্গ করার কথা ঘোষণা করলাম। বইমেলা মাঠে সদ্য ঘোষিত পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের মধ্যে একমাত্র আমিই উপস্থিত আছি এটা স্যাটেলাইট টিভির তরুণ রিপোর্টার বন্ধুরা জানতো। ঝাঁক বেঁধে ওরা এসে ছেঁকে ধরলো আমাকে। ওদের কয়েকজন শার্লিকেও চেনে। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশেষ করে নজরুল কবীরের প্ররোচনায় উৎসর্গের কথাটিও রিপিট করতে হলো।
রাতে চ্যানেল আই ভবনে পৌঁছে আমি ফোনে অভিনন্দন জানালাম ময়মনসিংহে অবস্থানরত অধ্যাপক যতীন সরকারকে। টিভির কল্যাণে খবরটি তিনি জেনেছেন আগেই,সন্ধ্যায়। আমি তাঁকে ফোনে অভিনন্দিত করছি আর ওদিক থেকে আনন্দে উপচে পড়ছেন যতীন সরকার--শিশুসাহিত্যে তুমি পুরস্কারটি পাওয়াতে আমি যে কী খুশি হয়েছি রিটন......।
০৫
২৮ ফেব্রুয়ারি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান বিকেল চারটায়। বাংলা একাডেমী থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে অন্তত তিরিশ মিনিট আগে আসতে। এই তিরিশ মিনিট মহাপরিচালকের রুমে চা পানের অলিখিত আমন্ত্রণ। কিন্তু আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তুমুল আড্ডায় মেতে রয়েছি বাংলা একাডেমী প্রেসের ব্যবস্থাপক মোবারক হোসেনের কক্ষে। এক ফাঁকে মোবারক অবশ্য মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদকে টেলিফোনে জানিয়ে রেখেছে আমি অনুপস্থিত নই। মহাপরিচালকের কক্ষে আমি যাচ্ছি না কারণ আমি চাইছিলাম আমার সঙ্গে যতীন সরকারের দেখা হোক অনুষ্ঠান মঞ্চে।
চারটে বাজতে দশ মিনিট বাকি।
দর্শকসারিতে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর ভাইসহ আমার লেখক বন্ধুদের সঙ্গে বসে আছি। মঞ্চ থেকে আমাদের নাম ঘোষণা করে একে একে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হলো। মঞ্চে সাজানো পাঁচটি চেয়ার। আমি চাইছিলাম যতীন সরকারের পাশের আসনটিতে বসতে। প্রথমটায় আগেই আসন গ্রহণ করেছেন মহাপরিচালক, দ্বিতীয় চেয়ারে বাংলা একাডেমীর সভাপতি প্রফেসর মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ। তাঁরা দুজন দাঁড়িয়ে সম্মানিত করছেন পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে ক্রেস্ট-সার্টিফিকেট-চেক হস্তান্তরের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় তৃতীয় এবং চতুর্থ চেয়ারে বসলেন মঞ্জুরে মাওলা এবং যতীন সরকার। অতঃপর আমার পালা। বাকী এবং একমাত্র শুন্য
পঞ্চম চেয়ারটিতে আসন পেলাম। এবং সেটা আমার পরম আরাধ্য শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক যতীন সরকারের পাশে। মঞ্চে আমি আসন গ্রহণের আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন যতীন সরকার। সস্নেহে আমার পিঠে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন তিনি--আমি তোমাকে তিরিশ বছর আগেই শনাক্ত করেছিলাম, ময়মনসিংহে.....।
পরদিন বেশ কয়েকটা দৈনিকে আমাদের ছবি ছাপা হলো। পুরস্কারের ক্রেস্ট হাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি অধ্যাপক শ্রীজ্ঞান (স্যারের ছাত্র কবি নির্মলেন্দু গুণের দেয়া অভিধা) যতীন সরকারের পাশে! নিজেকে আমি আবিস্কার করি পরম সৌভাগ্যবান একজন হিশেবে। এই রকম মুহূর্ত জীবনে বার বার আসে না।
০৬
ছেলেবেলায় যতীন এ্যান্ড কোং বিষয়ে আমার শিশুমনে জাগা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পরিণত বয়েসের এক ভদ্রলোক মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছিলেন। আজ এতোকাল পরে এসে আমার মনে হচ্ছে--ছেলেবেলায় আমাকে বিভ্রান্তকারী সেই ভদ্রলোক আমাকে বলা মিথ্যা বাক্যটির শুরুই করেছিলেন একটি সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে-‘যতীন একজনই।’
হ্যাঁ, যতীন একজনই। যতীন সরকার একজনই আছেন আমাদের। তিনি অদ্বিতীয়।
জয়তু যতীন সরকার।

লেখক : ছড়াকার

মন্তব্য করুন: