• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কবি আবুল হোসেনের জন্মশতবর্ষ

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ২০ আগস্ট ২০২২

ফন্ট সাইজ
কবি আবুল হোসেনের জন্মশতবর্ষ

কবি আবুল হোসেন

জীবনসায়াহ্নে এসে আবুল ভাই আমাকে বলেছিলেন, নিরর্থক মনে হয় জীবন। কী আজকের নবীনরা জানেন না যে, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকরা যখন নবীন ছিলেন, তখন এই কবি আবুল হোসেন ছিলেন তাঁদের মেন্টরের ভূমিকায়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ_ এই তিন কবির সঙ্গে তিনি ছাড়া আর আমাদের কোন কবির সাক্ষাৎলাভ ঘটেছে?


পনেরই আগস্ট ছিল কবি আবুল হোসেনের জন্মশতবর্ষ। তাঁকে নিয়ে অনেক লিখেছি, বারবার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমার তোলা ছবিটির সঙ্গে তুলে দিচ্ছি একটুকরো লেখা যেটায় জীবনের নিরর্থকতা এবং অর্থময়তা নিয়ে কিছু আলাপ আছে।

কবির জন্মোৎসবের আগে
২০১২ সালের আগস্টে কবি নব্বুই পূর্ণ করবেন-- এ এক আনন্দ সংবাদ। নিঃশব্দ অভিভাবকের মতো তাঁর উপস্থিতিও কবিসমাজের জন্য পরম স্বস্তির। আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মোৎসব পালন করা হবে কবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কেন অনিচ্ছা সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ওই জন্মোৎসবের কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর বাসভবনে যাই। শুক্রবার সেদিন, সকাল দশটা। তিনি নাস্তার টেবিলে। আমি সোজা তাঁর শোবার ঘরে গিয়ে বসি। কেয়ারটেকার ছেলেটি যেয়ে খবর দেয়। অন্য সময় দেখেছি তাঁকে সাহায্য করা লাগে। সেবার দেখলাম ওয়াকার নিয়ে তিনি নিজেই হেঁটে এলেন। বসলেন চেয়ারে। এই চেয়ারেই দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকেন। সামনে টিভির বিশাল স্ক্রিন। আলাপচারিতার মাঝখানে তিনি আকিস্মকভাবে বলে ওঠেন, ‘কবিতা লিখতে পারছি না। পড়তেও পারি না চোখের সমস্যার কারণে। সারাদিন টিভির বড় পর্দার সামনে বসে থাকা। নিরর্থক মনে হয় জীবন।’
তাঁর কথায় চমকে উঠি, কষ্ট পাই। কী করে তাঁকে বলি, জীবন কখনও থেমে যেতে পারে, জীবনের ভার বহন করা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। তবু জীবন নয় নিরর্থক। কিন্তু বলতে পারি না। কে তাঁকে কী শোনাবে? তিনি বিলক্ষণ সমঝদার মানুষ। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একই কক্ষে বসবাস করতে করতে, আর কবিতার সঙ্গে দূরত্ব রচিত হতে হতে একজন কবির এমনটা মনে হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আমি জানি, কথা বলতে বলতে এক পর্যায় তিনি উষ্ণ হবেন, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যাবেন। তখনই মোক্ষম কথাটা তাঁকে বলার সুযোগ পাব-- দ্যাখেন আবুল ভাই, জীবন নিরর্থক নয়।
এবার যেহেতু তাঁর নব্বুই পূর্ণ হচ্ছে, এটা একটা মাইলফলক। এই জন্মদিনকে তাই স্মৃতিময় করে রাখতে চান তাঁর পরিবারের সদস্যরা। বিশেষ করে সম্প্রতি আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে আসা তাঁর কন্যা। বহু বছর আবুল ভাই তাঁর জন্মদিন পালন করেন না। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, পঁচাত্তর সালের পর থেকেই তিনি আর জন্মদিন করেন না। তাঁর জন্মতারিখটি যে পনেরই আগস্ট! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার মতো চিরকলঙ্কময় তারিখটিতে কীভাবে তিনি আনন্দ করবেন? ওই দিন আমাদের জাতীয় শোক দিবস। তবু সেদিন কেউ কেউ ঘটা করে জন্মদিনের আয়োজন করে, উৎসব করে। এসবের বিপক্ষে তাঁর নিজের এই জন্মদিন পালন থেকে বিরত থাকা কি এক ধরনের প্রতিবাদ নয়?

কবি আবুল হোসেনের ৯০ তম জন্মদিনের আয়োজন
সম্ভবত ২০১২ সালের জন্মদিনটিতেই নয়, তাঁর পরিবারের সদস্যরা জন্মদিনের আয়োজন করছেন পনেরই আগস্টের পরে কোনো এক সন্ধ্যায়। 
কবি আবুল হোসেন আমাকে দেখেই খুশি হয়ে বলছিলেন, তোমার কথা গতকাল ভাবছিলাম। বয়স তাঁর শরীরে কামড় বসালেও মন তাঁর বুড়িয়ে যায়নি। আর জ্ঞান ও বিবেচনাবোধ তাঁর টনটনে। ভুল বলা বা বাড়িয়ে বলা তাঁর স্বভাবে নেই। সত্যিই তিনি আমার কথা আগের দিন ভাবছিলেন! একটু অবাক হই। পরে বুঝতে পারি উপলক্ষ ছিল স্মরণের। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অতিথিদের তালিকা করা হচ্ছে। কবির পুত্রবধূ খসড়া লিস্ট তাঁকে দেখালে সেখানেই তিনি আমার নামটা পান। এভাবেই আমার কথা ভাবা। তবে সেইসঙ্গে একথাও জানাতে ভুললেন না, তুমি খুব কম আস। তোমরা এলে ভালো লাগে। খুবই স্বাভাবিক চেনা মানুষের সান্নিধ্য তাঁকে স্বস্তি দেয়। ভালো লাগে তাঁর। ঘণ্টাখানিক গল্প করে আমি যখন উঠে আসছি, তখন বারবার বললেন, খুব ভালো লাগলো তোমার সঙ্গে কথা বলে। তখনই তাঁর কথার মৃদু উত্তর দিতে চেষ্টা করি। বলি, এই যে ভালা লাগার কথা বললেন। আমার মতো আপনার কাছে কেউ কেউ তো আসেন। তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে আপনার ভালো লাগে। এই ভালো লাগা কি নিরর্থক? বলেন, জীবন কি নিরর্থক?
তিনি একটুখানি হাসেন। অস্ফুট স্বরে বলেন, না নিরর্থক নয়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন: