• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

নামসর্বস্ব হাসপাতালের দুর্নীতির চিত্র: পর্ব-০১

ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে দালালসর্বস্ব ৭ হাসপাতালঃ জিম্মি রোগীরা (ভিডিও)

সাদ্দাম হোসাইন ও আহসান হাবীব

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ৩ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ২৩:১৮, ১২ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ

ক্যামেরা দেখেই তেড়ে এলেন তিনি। ক্যামেরা কেড়ে নিতেও চেষ্টা করলেন। লেলিয়ে দিলেন সংগে থাকা সাঙ্গপাঙ্গদের। কেন এভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন তারা, জানা গেলো একটু পরে।

১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানী টিম হাজির হয় রাজধানীর শ্যামলীস্থ মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১ নামের ভবনের সামনে। এই ভবনের চারটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে চলছে সাতটি হাসপাতাল। মাসখানেক আগে নানান অনিয়মের অভিযোগে এসব হাসপাতাল সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

গত ২৮ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি টিম ওই ভবনের হাসপাতালগুলো পরিদর্শনে যায়। এ সময় নানান অনিয়ম দেখতে পান তাঁরা। হাসপাতালগুলোর কোনোটিতে ছিলেন না বিএমডিসি অনুমোদিত চিকিৎসক, কোনোটিতে ছিলেন না পর্যাপ্ত নার্স। ল্যাব থাকলেও ছিলেন না টেকনোলেজিস্ট। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় নেওয়া হতো বাড়তি ফি। কোনোটিতে পাওয়া গেছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে স্থাপিত আইসিইউ বেড। এসব অনিয়মের কারণে প্রাইম অর্থোপেডিক ও জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঢাকা হেলথ কেয়ার হসপিটাল, রিমেডি কেয়ার লিমিটেড, লাইফ কেয়ার জেনারেল হসপিটাল, যমুনা জেনারেল হসপিটাল, রয়াল মাল্টিকেয়ার স্পেশালটি হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগোনস্টিক সেন্টার এবং রাজধানী ব্লাড ব্যাংক ট্যান্সফিউশন সেন্টারকে গত ১০ আগস্ট কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হাসপাতালগুলো মাসখানেকের ব্যবধানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই চালু করা হয়েছে- এমন তথ্য পেয়ে অনুসন্ধানে নামে বাংলাভিশন ডিজিটাল। হাসপাতালগুলো পরিদর্শনকালে দেখা যায়, দালালের মাধ্যমে একজন রোগী ও তাঁর স্বজনরা মুক্তিযোদ্ধা ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রাইম হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। হাসপাতালটির ভেতরে আগে থেকেই, বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজনরাও অবস্থান করছিলেন। ভবনটির তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা হেলথ কেয়ার হসপিটালেও রোগী এবং তাদের স্বজনরা চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছেন। অথচ তখনও প্রাইম কিংবা ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

আরও পড়ুন: আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি করে টাকা হাতাচ্ছে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতাল

অনুসন্ধানকালে কয়েকজন ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনের সংগে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যারা দালালের মাধ্যমে উল্লেখিত হাসপাতালে এসে জিম্মি হয়েছেন এবং সর্বস্ব হারাতে বসেছেন। একজন রোগীর স্বজনের সংগে কথা বলার সময় হঠাৎ উপস্থিত হন আব্দুর রাজ্জাক নামের এই ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি বন্ধ হওয়া প্রাইম হাসপাতালের মালিক। গত বছর ১৪ মে র‌্যাবের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম-এর অভিযানে আটক হন তিনি। পরে জরিমানা দিয়ে রেহাই পেলেও ফের একই অনিয়মে জড়ান। এসব অনিয়মের চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখেই তেড়ে আসেন আব্দুর রাজ্জাক।

ওই দিন সকাল থেকে হাসপাতাল চালু থাকলেও দুপুরে বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানী টিমের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রাইম হাসপাতালে থাকা রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করে পালিয়ে যান তাঁরা। এসব বিষয়ে ক্যামেরায় কোনো কথা বলতেও রাজি হননি তারা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর হাসপাতালগুলো খুলে দেওয়ার পর আবারও বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানী টিম হাজির হয় রাজধানীর শ্যামলীস্থ মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১ নামের ভবনে। কেমন চলছে একমাস আগে বন্ধ করে দেওয়া প্রাইম অর্থোপেডিক ও জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

১৫ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানী টিমের সংগে প্রাইম হাসপাতালের মালিক আবদুর রাজ্জাক-এর সংগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দূর থেকে দেখেছেন জানিয়ে নিজেকে কণ্ঠশিল্পী পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি বলেছিলেন, আব্দুর রাজ্জাক-এর সংগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভুল বুঝাবুঝি থেকে হয়েছে। তিনি রাজ্জাক-এর হাসপাতালে টেস্ট রিপোর্ট নিতে এসেছিলেন। তাই রাজ্জাককে ছিলেন। এজন্য রাজ্জাক-এর বিষয়ে কোনো নিউজ না করতে অনুরোধ করেন তিনি। কিন্তু ঘটনার ১০ দিন পর আবারও অনুসন্ধানী ক্যামেরায় ধরা পড়লো সেই ব্যক্তি। তবে এখন তাঁকে দেখা গেছে প্রাইম হাসপাতালের পরিচালনার কাজে। অনুসন্ধানকালে তাঁকে দেখা গেছে তিনি কর্মচারীদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন পরচিয় ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবশে করতে না পারেন।

২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানের টের পেয়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রাইম হাসপাতাল। এখন পরিচয় ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেন না। এসব বিষয়ে প্রাইম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

এতো অনিয়মের মধ্যেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালগুলোকে ফের পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনুমতির পরও দালালের মাধ্যমে ভাগিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন মিঞা  বলেন, অনিয়ম পেলে আবারও ব্যবস্থা নেওয়া নেবেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ মনে করেন, কঠোর শাস্তির বিধান না থাকায় এমন অনিয়ম ঘটছে। তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল খাতের বিশৃঙ্খলার লাগাম টেনে ধরতে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সেই আইন বাস্তবায়নে আলাদা অধিদফতর গঠন করতে হবে। 

বিভি/এসএইচ/এএইচ/এসডি

মন্তব্য করুন: