• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোটি টাকা পাচার

প্রকাশিত: ১৮:২২, ১২ নভেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৬:২৯, ১৩ নভেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোটি টাকা পাচার

মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘বিকাশ’-এর মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। দেশে বসে বিদেশে অর্থ পাচারের এই কৌশল দীর্ঘদিন ধরে চললেও সম্প্রতি বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র নজরে এসেছে। অর্থ পাচার সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ পাচার করা একটি চক্রের সন্ধান পায় সংস্থাটি।

সিআইডি বলছে, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিকাশ-এর মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট চালু করে সেই অ্যাকাউন্ট দেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা পাচার এবং হুন্ডির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন একটি চক্রের কয়েকজন সদস্যের সন্ধান মিলেছে। চক্রের সদস্যদের দ্বারা ইতোমধ্যে কোটি টাকার উপরে বিদেশে পাচার করার তথ্য মিলেছে। তাদের অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে এমন তথ্যে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি।

সিআইডি’র সাইবার ইনভেস্টিগেশন শাখার একটি সূত্র জানায়, বিকাশের সাধারণ গ্রাহক অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনে লিমিট রয়েছে। একটি সাধারণ অ্যাকাউন্ট দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা যায়। বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে লেনদেনের ক্ষেত্রে লিমিট থাকে বেশি। তাই লাখ লাখ টাকা লেনদেন করতে অর্থ পাচারকারী চক্রটি বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। 

বিকাশ বলছে, যে কেউ চাইলেই বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এটি মূলতঃ ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এ অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য প্রদানের পাশাপাশি যে ব্যবসায়ের জন্য এটি ব্যবহৃত হবে সেই ব্যবসার অনুকূলে বৈধ ট্রেড লাইসেন্স, সেই ব্যবসায়ে প্রতিমাসে কী পরিমাণ লেনদেন হয় তার তথ্য এবং প্রতিষ্ঠানটির দৃশ্যমান কার্যালয়ের ঠিকানা দিতে হয়। এসব তথ্য প্রদান করে কোনো ব্যক্তি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টের জন্য আবেদন করার পর বিকাশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের সত্যতা সরেজমিনে নিশ্চিত হয়ে তারপরই মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার অনুমতি দেন। অন্যদিকে, কোনো মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট যদি অনুমতি পাওয়ার পর অস্বাভাবিক লেনদেন করে তবে সেই অ্যাকাউন্টকে সন্দেহজনক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নজরদারি করে বিকাশ। পাশাপাশি সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের অনিয়মের প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর কাছেও সেই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে অবহিত করে বিকাশ।

কিন্তু এতো নিয়ম থাকার পরও কিভাবে বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে দিনের পর দিন বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে? সেই বিষয়টি অনুসন্ধান করছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। 

সিআইডি বলছে, এই ধরনের ঘটনায় বিকাশের কেউ জড়িত রয়েছে কি না এবং এই ধরনের ঘটনায় বিকাশের কোনো গাফলতি রয়েছে কি না সেটিও তদন্ত করছে সংস্থাটি।

সিআইডি’র সাইবার ইনভেস্টিগেশন শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, সম্প্রতি এজেন্টেদের সংগে প্রতারণাকারী একটি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদেরকে সহযোগিতাকারী হিসেবে বিকাশের একজন টেরিটরি ম্যানেজারকে ২ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়েছিলো। যদিও গ্রেফতারের আগেই তাকে বিকাশের চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে বিকাশে চাকরি করাকালেই বিভিন্ন এজেন্টদের তথ্য প্রতারক চক্রের কাছে টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করতো। বিকাশের সাবেক এমন একজন কর্মকতাকে গ্রেফতারের পর বর্তমানে সন্ধান পাওয়া মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ পাচার চক্রের বিষয়েও আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা এই বিষয়ে বিকাশের কোনো গাফলতি রয়েছে কি না সেটি খতিয়ে দেখছি। চক্রের সদস্যরা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে শিগগিরই এই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হবে। পাশাপাশি আমরা এই বিষয়ে বিকাশ কর্তৃপক্ষকেও ডাকবো। তাদের কাছ থেকে জানতে চাইবো- এই ধরনের ঘটনায় তারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছে।

মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কিভাবে অর্থ পাচার করা হচ্ছে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ধরুন, একজন লোক সিঙ্গাপুর থাকেন। সেখানে তিনি আয় বর্হিভুত কোনো একটি ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবেন ১ কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকা তিনি বৈধ প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে সেখানে পাঠাতে গেলেই ধরা পড়ে যাবেন। তাই তিনি বৈধ প্রক্রিয়ার বিপরীতে বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টাকাগুলো লেনদেন করছেন।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে থাকা ওই ব্যক্তি দেশে থাকা মাচেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ পাচারকারী চক্রের কাছে ১ কোটি টাকা দিলে, ওই চক্রের সিঙ্গাপুরে থাকা সদস্যরা তাকে সিঙ্গাপুরের টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের টাকা দেশে রয়েছে। মাঝখান দিয়ে এক কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরে থাকা কোনো প্রবাসী যদি তার বৈধ আয়ের ২ লাখ টাকা দেশে পাঠাতে চায় তখনও একই প্রক্রিয়ায় ওই সদস্যরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সিঙ্গাপুরের টাকাটা গ্রহণ করে। চক্রের দেশীয় সদস্যদেরকে বলে দেওয়া হয় অমুককে দুই লাখ টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তখন আগের ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া ১ কোটি টাকা থেকে দুই লাখ টাকা তাৎক্ষণিক নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে সিঙ্গাপুরের টাকাটা আর দেশে আসছে না। ফলে রেমিট্যান্সবঞ্চিত হচ্ছে দেশ।

মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ পাচার চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডি’র সাইবার ইনভেস্টিগেশন শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, এমন একটি চক্রের সন্ধান আমরা পেয়েছি। চক্রের সদস্যদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিষয়টি এখনও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স বিভাগের কর্মকতা শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, যদি কেউ বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ পাচার বা অন্য কোনো অপরাধ করে থাকে তবে সেটি যদি বিকাশ বুঝতে পারে তাহলে বিষয়টি তাৎক্ষণিক বিএফআইইউ-এর কাছে অবহিত করা হয়। এছাড়াও যদি নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্তকারী কোনো সংস্থা বিকাশ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চায় সেক্ষেত্রেও পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়।

তিনি বলেন, মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট যারা ব্যবহার করেন, তারা বৈধ প্রক্রিয়ায় অনুমোদন পান। কিন্তু অনুমোদন পাওয়ার পর ওই অ্যাকাউন্ট দিয়ে কিসের জন্য অর্থ লেনদেন হচ্ছে সেটি অনেক সময় ‍বুঝা যায় না। ধরুন, কেউ মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খুললো তার সুপার শপের ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রির টাকা লেনদেনের জন্য। তিনি বিকাশকে জানালেন প্রতিদিন তার তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা লেনদেন হবে। সেই হিসেবে তাকে অ্যাকাউন্টটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো। তিনি যদি ওই অ্যাকাউন্ট দিয়ে ওই পরিমাণ টাকা লেনদেন করেন অর্থ পাচারের কাজে তাহলে তো তাকে ধরা সম্ভব না। কিন্তু যখন কেউ প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকার পরিবর্তে ১০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন তখনি বিকাশ সেই অ্যাকাউন্টকে সন্দেহজনক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এছাড়া কেউ যদি গভীর রাতেও লাখ লাখ টাকার লেনদেন করে সেই অ্যাকাউন্টগুলোকেও তালিকাভুক্ত করে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণে ‍যদি কোনো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় তখনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ-এর কাছে বিষয়টি অবহিত করা হয় এবং উনারা এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিকাশের যে কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের কথা বলা হচ্ছে, তার ক্ষেত্রেও বিকাশ কর্তৃপক্ষ যখনই জানতে পেরেছে সে অপরাধ করছে সেই মুর্হূতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেই সংগে তদন্ত সংস্থাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে।

বিভি/এসএইচ/এসডি

মন্তব্য করুন: