• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভারত থেকে আনা গরুর পঁচা মাংস খাওয়ানো হয় রেস্টুরেন্টগুলোতে

শুভ খান

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ৬ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ১৯:১৩, ৭ আগস্ট ২০২২

ফন্ট সাইজ

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলের রেষ্টুরেন্ট ডি বাদশ মালিক বাদশা মিয়া জানালেন, ক্রেতাদের খাওয়াতে শনি আখড়া থেকে গরুর মাংস কেনেন তারা। শুধু তিনি একা নন মতিঝিল-গুলিস্তান ও সায়দাবাদসহ আশপাশের সব রেষ্টুরেন্ট গরুর মাংস দিয়ে যায় শনি আখড়া ও জুরাইনের কয়েকজন মাংস বিক্রেতা। ওনার কথা শুনে প্রশ্ন জাগে মতিঝিল এলাকায় অসংখ্য মাংসের দোকান থাকলও ওনারা গোস্ত আনেন কেন কয়েক মাইল দুর থেকে। এত দুর থেকে গরুর মাংস আনার রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে বাংলাভিশনের টিম ক্রইম এন্ড করাপশন।

পরের দিন ভোরের সূর্য উদয় হওয়ার সাথে সাথে মাঠে নামি আমরা। গন্তব্য মতিঝিল-সায়দাবাদ-যাত্রাবাড়ি ছাড়িয়ে শনিআখড়া। কিছু সময় খোঁজা খুঁজির পর আমাদের কাছে তথ্য আসে এসব মাংস নাকি জুরাইনের বিক্রামপুর প্লাজার পিছন দিকে একটি মার্কেট রয়েছে। সেখান থেকেই এই মাংস কাটা কাটি শেষে ভ্যান গাড়ি বা সিএনজিতে করে পৌছে দেয়া হয় রেষ্টুরেন্টগুলোতে। ঐ এলাকায় পৌঁছতেই আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান মাংসের দোকানের মালিক। 

তবে ভারত থেকে আসা প্যাকেট গুরুর মাংসের দেখা মিললো দোকানে। পানির ড্রামে ভিজিয়ে রাখা মাংসের উৎকট পঁচা গন্ধে আশপাশে যাওয়া কষ্ঠকর। রং দেখেও বুঝতে বাকি রইলোনা ভারত থেকে আনা প্যাকেটজাত এই মাংস আর খাওয়ার উপযুক্ত নেই। মালিক পালিয়ে যাওয়ায় আশপাশের মানুষও ক্যামেরায় কথা বলতে রাজি হয়নি। এখলাস উদ্দিন নামে একজন বললেন কিছুক্ষণ অবস্থান করলে আপনারই দেখতে পাবেন পঁচা-গলা মাংসের বিকিকিনি।

এরমধ্যে একজন ভ্যান ড্রাইভারকে পেলাম যিনি মাংসের চালান নিতে এসেছেন জুরাইনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান ফুটপাতের ভাতের হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত রেষ্টুরেন্টগুলোতেও তারা পৌঁছেদেন খাওয়ার অযোগ্য এই মাংস।

ঘটনা স্থলে থাকা অবস্থায় আমাদের কাছে খবর আসে প্রায় ৩০০ মিটার দুরে জুতার মার্কেটের পিছনেই নাকি এই মাংসের আরো কয়েকটি দোকান রয়েছে। তথ্য পেয়ে আমরা হাটতে শুরু করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম সবগুলো জুতা-স্যান্ডেলের দোকান। নেই কোন কাঁচা বাজার। মনে প্রশ্ন জাগলো সেখানে কেনো থাকবে মাংসের দোকান! তবে কিছুক্ষন খোজা খুজির পর এই জুতার মার্কেটের একদম শেষে গিয়ে দেখা মিললো সেই প্যাকেট জাত গরুর মাংসের। 

সাধারণত এখানে কোন খুচরা কাস্টমার আসেন না এবং আসারও কথা না। কেনো না এই দোকান গুলো মূলত লোক চোক্ষুর আড়ালেই থাকে। এখান থেকেই রেষ্টুরেন্টগুলোতে মাংস পাঠানো হয়। আমাদের ক্যামেরায় ধরা পড়লো তেহেরির দোকানের জন্য মাংস ছোট ছোট টুকরা করছেন কশাইরা। এখানেও ড্রামের ভিতরে একই ভাবে মাংস ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। ড্রামে আছে নষ্ট গরুর কলিজাও! এগুলোও নাকি পাঠনো হয় রাজধানীর বিভিন্ন খাবার হোটলে। তবে সেখানেও কথা বলতে রাজি নন কেউ, সবাই নাকি কর্মচারী মূল মালিক নাকি এখানে নেই। 


পাড়া-মহল্লায় সাধারণ গরুর মাংস দোকানগুলো নিজেরাই গরু জবেহ করে, কেটে ঝুলিয়ে বিক্রি করে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস রেষ্টুরেন্টগুলোও সেখান থেকেই মাংস নেয়। কিন্তু রাজধানী ফুটপাথের ভাতের হোটেল কিংবা অভিজাত রেষ্টুরেন্ট সব জায়গায়ই খায়াওয়ানো হয় এরকম খাওয়া অযোগ্য মাংস। ভারত থেকে আসা এই মাংসের দাম কেমন জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা জানান, মান বেদে ৪০০ থেকে সাড়ে ৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় এগুলো। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম প্যাকেটের গায়ে মেয়দ উর্তীনের তারিখ শেষ না হলেও মাংস পঁচে গেছে। এখন এটি সংরক্ষণ জনিত অবহেলা না অন্য কোন কারণ বলতে পারলেন না বিক্রেতারা।

এক দুপুর শনি আখড়া-জুরাইনে কাটিয়ে দুপুরে আমারা আবার যাই তুমুল ব্যস্ত মতিঝিলের অফিস পাড়ায়। পূরো রাজধানী এমনি সারাদেশ থেকে সেখানে লাখো মানুষ প্রতিদিন আসেন নানা কাজে। ব্যাংক-বিমা পড়ায় রেষ্টুরেন্টগুলো দুপুরে বিকি-কিনি হয় বেশ। মধ্যভিত্তরা ভীর করেন রেষ্টুরেন্টে আর অল্পআয়ের মানুষ ফুটপাথের ভাতের হোটেলগুলোতে। প্যাকেট জাত গুরুর মাংস সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই সেগুলোতে খেতে আসা সাধারণ মানুষের।

ভারত থেকে আসা এসব মাংসের বিষয়ে কিছু হোটেল ব্যবসায়ী স্বীকারও করেন। তবে দাবি করেন গরুর তেহেরি আর কালভূনায় ব্যবহার করা হয় এই প্যাকেট জাত মাংস। এদের কথা মত কয়েকটা তেহেরির দোকান গেলাম তবে ক্যামেরার সামনে কেউ স্বীকার করেনি এসব অখাদ্য মানুষকে খাওয়ানো দায়। 

কেবল তেহারি কেন, বেশি-বেশি মশলা দিয়ে রান্না অথবা কালাভূনা করায় বোঝার উপায় থাকে না পঁচা-গলা মাংসই আপনি-আমি গলদকরণ করছি। রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা খাবার অযোগ্য মাংস ক্রেতাদের খাওয়ানোর কথা স্বীকার না করেলেও প্যাকেট জাত মাংসই যে তারা রান্না করেন তা স্বীকার করেছেন কেউ কেউ।

কেবল তেহারি কেন, বেশি-বেশি মশলা দিয়ে রান্না অথবা কালাভূনা করায় বোঝার উপায় থাকে না পঁচা-গলা মাংসই আপনি-আমি গলদকরণ করছি

এই প্যাকেটজাত মাংসের বিক্রেতারা জানিয়েছে আমদানিকারকদের কয়েকটি কোল্ডস্টোরেজ আছে তেজগাঁও শিল্প এলকায়। সাত রাস্তা এলকায় বাবলি মসজিদের অপজিটের একটিতে আমরা প্রথমে যাই। পৌঁছা মাত্রই আমাদের সামনে দিয়ে একটি ফ্রিজার পিকআপ বের হতে দেখলাম। এতক্ষণ খোলা থাকলেও আমাদের উপস্থিতি দেখে দ্রুত আটকে যায় মেইনগেট। তাই কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। মজার বিষয় হচ্ছে মাংসের কোল্ডএস্ট্রোরেজের গেটে লেখা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশোপের নাম।

গেটের ঠিক অপর পাশের এক রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় আমাদের। তিনি জানালেন সারা দেশে এখান থেকে মাংস বাজারজাত হলেও এখানকার কর্মকর্তা কর্মচারিরাই নাকি এসব মাংস খান না। তাই তিনি এগুলো বিক্রি করেন না।
 ভারত থেকে আসা এই মাংস গরুর নাকি অন্যকোন প্রাণীর তা যেমন জানা নাই কারো। তেমনি এগুলো ইসালামী রীতি মেনে সঠিক ভাবে জবাহে করা হয়েছে কিনা তাও অজানা। কেউ কেউ শংকা প্রকাশ করে বলেছেন ভারতে যেহেতু গরু জবাই নিষিদ্ধ তাই মরা বা অসুস্থ্য গরু-মহিষের মাংসও হতেপারে এগুলো। এমনি ইউটিউভ ও ফেসবুকে ভিডিও রিপোর্ট দেখে এগুলো ঘোড়া, মহিষ বা অন্যসব বন্য প্রাণীর মাংস হওয়া অসম্ভব না বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাভিশনের অনেক দর্শক। 
 

মন্তব্য করুন: