• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কুড়িগ্রামে প্রশ্নফাঁস

অফিস সহায়ক ও শিক্ষকসহ গ্রেফতার ৬, শিক্ষা অফিসার বরখাস্ত

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ২২:৫৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
অফিস সহায়ক ও শিক্ষকসহ গ্রেফতার ৬, শিক্ষা অফিসার বরখাস্ত

কুড়িগ্রামর জেলার ভূরুঙ্গামারীতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার চাঞ্চল্যকর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের আরো দুই শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হলেও বৃহস্পতিবার তাদের প্রশ্ন ফাঁসের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। 

গ্রেফতারকৃতরা হলো নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া।

এর আগে বুধবার একই স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে এ মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬জনে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নতুন করে গ্রেফতারকৃত ৩ জনকে কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ আলসগীর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

অপরদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দায়িত্বে অবহেলা এবং অসদাচরণের দায়ে ভুরুঙ্গামারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 

জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংশোধিত পত্রের বরাতে জানান, স্থগিত চারটি পরীক্ষার নতুন সময় সুচি মোতাবেক আগামী ১০ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। 

এর মধ্যে গণিত (আবশ্যিক) ১০, কৃষি শিক্ষা (তত্ত্বীয়) ১১, রসায়ন (তত্ত্বীয়) ১৩ এবং পদার্থ বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় স্থগিত ৪টি পরিক্ষার প্রশ্নপত্রের সাথে নতুন করে জীব বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) এবং উচ্চতর গণিত (তত্ত্বীয়) সহ মোট ৬টি বিষয়ের ইতোপূর্বে সরবরাহকৃত প্রশ্নপত্র বাতিল করা হলো।

তাই আগামী ২৪/০৯/২২ তারিখের মধ্যে উক্ত বাতিলকৃত প্রশ্নপত্রসমুহ ট্রেজারী অফিসসমুহে কঠোর নিরাপত্তার সাথে আলাদা করে পৃথক ট্রাঙ্কে সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করা হলো। রংপুর বিভাগের  জেলা প্রশাসককে এ অনুরোধ জানানো হয়।

তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস স্বাক্ষরিত আদেশের বরাতে জানান, চলমান এসএসসি পরিক্ষায় ভুরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (চলতি দায়িত্ব) মোঃ আব্দুর রহমান কে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে সরকারি কর্মচারী) শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮এর (২)(খ) (আ) অনুসারে অসদাচরণের দায়ে তাকে ২২/০৯/২২ তারিখ হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

তিনি আরো জানান, প্রশ্ন ফাঁসের এঘটনায় শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালকের পক্ষে আমি (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল ইসলাম) বৃহস্পতিবার নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছি। সহকারী প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান সহ অন্যান্য শিক্ষকদের জবানবন্দী রেকর্ড করেছি।

 প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাথে জড়িত কেউ রেহাই পাবে না। এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত শিক্ষা বিভাগের কারো কোন দায়িত্বে অবহেলা অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির সাথে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে শিক্ষা বিভাগ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে।

জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম আরো জানান, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তিন সদদ্যের তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম পৌঁছেছেন। এ কমিটির আহ্বায়ক দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক মোঃ ফারাজ উদ্দিন তালুকদার। তদন্ত টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা) প্রফেসর মোঃ হারুন অর রশিদ মন্ডল এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোঃ আকতারুজ্জামান। তারা তাদের তদন্ত কার্যক্রমও শুরু করেছন।

এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী জানা, প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত মামলায় নতুন করে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এ নিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৬ জনকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। একজন আসামির রিমান্ড আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে করা হয়েছে।

একজন আসামির রিমান্ড আবেদন

কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্ব প্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী এক নম্বর আসামী নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের ৩দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। 

অপরদিকে আসামি পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভুরুঙ্গামারী কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক মোঃ সুমন আলী রিমান্ড এবং জামিন শুনানীর জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন।

উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ১ম এবং ২য় পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসলে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। ভুরুঙ্গামারী থানায় এ ব্যাপারে ৪জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০/১৫জনকে আসামী বুধবার পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স এ্যাক্ট ১৯৮০ এর ৪/১৩ ধারায় মামলা রুজু করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আদম মালিক চৌধুরী। পরে এসএসসি পরীক্ষার গণিত, পদার্থ,কৃষি এবং রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষনা করা হয়।

অভিনব কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস এবং যেভাবে রহস্য উদঘাটন হয়

ভুরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন বাছাইয়ের (সর্টিং) সময় ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ঐ কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আব্দুর রহমানের যোগসাজসে বাংলা ১ম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্নপত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন এবং প্যাকেট সীলগালা করে তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। 

বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষার দিন যথানিয়মে থানা থেকে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের খামটি কৌশলে সরিয়ে ফেলেন। এসময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নেপত্রের খাম গণনা করার নিয়ম থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলা করে তা করেননি।

পরে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের উত্তরমালা তৈরী করে ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে (চুক্তিতে সবসেট) ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া উত্তর পত্রের সাথে পরের দিন পরীক্ষার প্রদত্ত প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। পরে সামাজিক মাধ্যমে এসব উত্তর পত্র ছড়িয়ে পড়ায় তা নেবার জন্য শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকগণ ছুটোছৃুটি করেন। প্রতিটি উত্তরপত্রের কপি ২শ হতে ৫শ টাকায় বিক্রি হয় গোপনে। 

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটি স্থানীয় সাংবাদিকদের নজরে এলে বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবগত করা হলে তারা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেন। পরে ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষার  প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় নড়েচড়ে বসেন পুলিশ ও প্রশাসন। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষা দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা, সহকারী পুলিশ সুপার মোর্শেদুল হাসান, ওসি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালিয়ে গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র পায়। যে বিষয় গুলোর পরীক্ষা এখানো হয়নি। 

উল্লেখ্য, পুলিশ জানতে পারে একইভাবে ইংরেজি ১ম পত্রের পরীক্ষার প্যাকেটে এই প্রশ্নগুলো ঢুকানো ছিলো। আর এ প্রশ্নগুলো প্রধান শিক্ষকের কক্ষে রয়েছে নিশ্চিত হয়ে তারা অভিযান চালায়। পরে বিকালে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে থানায় আনলেও রাতে প্রধান শিক্ষককে আটক করা হয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে ছেড়ে দেয়া হয়।

পরে ইংরেজি শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক জোবায়ের হোসাইনকে আটক করে এবং বুধবার ভোরে হামিদুল ইসলাম, সোহেল আল মামুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। মামলার অপর আসামী ক্লার্ক আবু হানিফ পালিয়ে যায়। 

প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে নয়টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। 

এরপরই সিদ্ধান্ত হয় মামলা করার এবং প্রশ্ন ফাঁস হওয়া চারটি পরীক্ষা স্থগিত করার। পরে দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান দিনাজপুরে ফিরে গিয়ে বুধবার (২১/০৯/২২) বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং কৃষি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেন।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: