• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইভ্যালি’র গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবে কে? 

প্রকাশিত: ১০:০১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৪:৫১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
ইভ্যালি’র গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবে কে? 

গ্রাহকের সংগে প্রতারণা মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন। আদালতের নির্দেশে তাদের তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির মালিকরা গ্রেফতারের পর বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের জন্য গ্রাহকদের দেওয়া টাকার কী হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। গ্রাহকরা বলছেন, ডেসটিনির মতো হয়তো ইভ্যালিও টাকা মেরে দেবে। এ নিয়ে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছেন তারা। 

কোম্পানিটির ধানমন্ডির অফিসে গ্রাহকরা আন্দোলন করলে ইভ্যালি’র কর্মকর্তা ফেসবুক পেইজে পোস্ট দিয়ে কর্মীদের পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বাসায় থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। গ্রাহকদের অধিকাংশই আসছেন কীভাবে টাকা অথবা পণ্য পাবেন সেই তথ্য জানতে। বিষয়টি নিয়ে ইভ্যালি’র জনসংযোগ কর্মকর্তাসহ একাধিক কর্মীর সংগে যোগাযোগ করা হলেও কেউ কোনো জবাব দেননি।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইভ্যালি’র কয়েকজন কর্মী বাংলাভিশন ডিজিটালকে জানান, ইভ্যালি’র দেনা ৪০৩ কোটি টাকা বলা হলেও এটা সত্য নয়, আসলে দেনার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। শুধুমাত্র একটি ফার্নিচার কোম্পানির বকেয়া আছে প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি। তাদের মতো আরো কয়েকটি কোম্পানি আছে, যাদের পাওনা তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য মতে, গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থা মিলিয়ে ইভ্যালি’র দেনা এখন প্রায় ৫৪৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক রয়েছে দুই লাখের বেশি। যদিও ইভ্যালি বলছে, তারা এখন পর্যন্ত ৭০ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়েছে। এপ্রিল থেকে তিন লাখ গ্রাহকের অর্ডার নিশ্চিত করা হয়েছে। 

গ্রাহকরা টাকা বা পণ্য ফেরত পাবেন কীভাবে বিষয়টি জানতে প্রতিবেদকের সংগে কথা হয় কোম্পানিটির ব্র্যান্ড ম্যানেজার এইচ এম তানজিলের। তিনি জানান, ‘এই বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার রাখি না। মেহেদী নামে অপর একজনের মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে তার সংগে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। তবে সেই মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ওই নাম্বারে এসএমএস পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 

এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কার্যালয়ে অভিযোগ করতে আসা তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা মামুন আর রশিদ বিপ্লব বাংলাভিশন ডিজিটালকে জানান, ইভ্যালিতে ৭৫ হাজার টাকার টাকা অগ্রিম হিসেবে একটি হিরো হোন্ডার ও ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি টিভিএস মোটরসাইকেল অর্ডার দিয়েছি। প্রায় পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করছি। ইভ্যালি’র অফিসে গিয়ে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু এখন আর আশা করতে পারছি না। 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. নাহিম বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের দুটি মোটরসাইকেলে অর্ডার করেছি। চার দফা মোটরসাইকেল দুটি দেওয়ার তারিখ জানালেও আজও পাইনি। 

নূর আলম নামে একজন গ্রাহক জানান, ভোক্তা অধিকারে এসেছি অভিযোগ করতে। একটি মোবাইল সেট কেনার জন্য টাকা দিয়ে দুই মাস অপেক্ষায় আছি। প্রথমবার যে তারিখ দেওয়া হয়েছিলো সেই তারিখ বাড়িয়ে নেওয়ার পরও মোবাইল পাইনি। আসলে আমি কি মোবাইল পাবো?

এদিক ইভ্যালি’র ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে গিয়ে দেখা যায়, আজও ইভ্যালিতে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি)-তে শপিংয়ের আহ্বান জানিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধের কথা বলা হয়েছে!  

একই পোস্টের নিচে কিছু গ্রাহক তাদের পণ্য চেয়ে না পাওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন। প্রতি উত্তরে ইভ্যালি’র পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টরা পণ্য ডেলিভারি না দিতে পারার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন।  

রিমান্ডে থাকা ইভ্যালি’র মালিক মোহাম্মদ রাসেল করোনা’র কারণে স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় পণ্য ডেলিভারি দিতে পারেননি বলে জানিয়েছে। যাদের পণ্য ডেলিভারি দিতে পারেননি তাদের অনেকের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যারা ডেলিভারি পাননি ভবিষ্যতে টাকা পেয়ে যাবেন বলে দাবি করেন তিনি। এখানে প্রতারণার কোনো বিষয় ছিলো না বলেই দাবি তাঁর। 

গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে রাসেল দাবি করেন, জুলাই মাস থেকে এই পর্যন্ত মোট তিন লাখ অর্ডার ডেলিভারি করা হয়েছে। পণ্য কেনাকাটায় ১০ শতাংশ অ্যাডভান্স দেওয়া সংক্রান্ত ইভ্যালি’র যে নিয়ম ছিলো তা বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া নির্দেশনা পর বন্ধ হয়ে যায়।  ইভ্যালির ওপর ব্যাংক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় নগদ জমার পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে রিফান্ড প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে যায়।

ইভ্যালি’র আইনজীবী ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান আসাদ সাংবাদিকদের জানান, ‘গ্রাহক, মার্চেন্টরা টাকা পান, এটা তো অস্বীকার করা হয়নি। এটা ব্যবসায়িক চুক্তি। গ্রাহকের টাকা বা মালামাল ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া আছে। কারো সংগেই প্রতারণা করা হয়নি। এই পর্যন্ত ৭০ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়েছি। এপ্রিল থেকে তিন লাখ গ্রাহকের অর্ডার নিশ্চিত করা হয়েছে। সব গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, ‘কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারে পড়ে অনেকে কম দামে পণ্য কিনে সেগুলো আবার বাজারে বিক্রির মাধ্যমে বেশি মুনাফা করতে চেয়েছেন। তাদের অনেকেই এখন অভিযোগের স্তুপ নিয়ে আসছেন। যা নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। কিন্তু এসব গ্রাহক যখন পণ্য ক্রয় করেছিলেন তখন একটিবারের জন্যেও ওই কোম্পানিটির পণ্য ক্রয়ের শর্তগুলো পড়েননি। সেদিক বিবেচনায় নিলে দেখা যায় এটা স্বেচ্ছায় টাকা জলে ঢালার মতো। তারপরও ভোক্তা অধিকার গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের উদ্যোগ নেবে।’

ভোক্তা অধিকার সূত্র জানায়, চলতি বছরের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে ইভ্যালি’র বিরুদ্ধে। গত জুন পর্যন্ত চার হাজার ৯৩২টি অভিযোগ পড়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। গত জুলাইয়ে আরও পাঁচ শতাধিক অভিযোগ আসে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজারে। 

গত ১৭ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অডিট রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালি পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩.৯৪ কোটি টাকা নিয়েছে। তবে সবাইকে পণ্য সরবরাহ করেনি। এই সময় মার্চেন্টারদের কাছ থেকে ইভ্যালি পণ্য ক্রয় বাবদ বকেয়া রয়েছে ১৮৯.৮৫ কোটি টাকা। ইভ্যালি’র চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি টাকা। যা দিয়ে কোম্পানিটির বকেয়ার মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা যাবে। তারপরও দেনা থেকে যায় প্রায় ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ইভ্যালি’র আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে প্রথম বছরে ইভ্যালি’র লোকসান হয়েছিলো এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা। গত ১৪ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংক-এর প্রতিবেদনের আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালি’র মোট আয় (রেভিনিউ) ২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এই সময়ে কোম্পানিটির বিক্রি ব্যয় হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা।

ইভ্যালি’র রেপ্লিকা ডাটাবেজ-এর তথ্যানুসারে জানা গেছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালি’র মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিলো ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ জন। ক্রয়াদেশ বাতিল, ইভ্যালি’র দেওয়া ক্যাশব্যাক, বিক্রি করা গিফটকার্ডের সমন্বয়ে এসব গ্রাহকের ভার্চ্যুয়াল আইডিতে মোট ৭৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মূল্যমানের অর্থ ইভ্যালিতে সংরক্ষিত ছিলো। অথচ ওই দিন শেষে কোম্পানিটির ১০টি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিলো মাত্র ২.০৪ কোটি টাকা।

বিভি/এইচএস/এসডি

মন্তব্য করুন: