এবারের মুদ্রানীতির লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট মুদ্রানীতি প্রণয়নে বড় চ্যালেঞ্জ (ভিডিও)
করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য এবং ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সুদের হার এবং অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ৩০ জুন নতুন মূদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব পাচ্ছে রফতানি আয় বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করার দিকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই এবারের মুদ্রানীতির মূল কাজ। বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে আমেরিকায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ব্রিটেনে ৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের মুদ্রাস্ফীতিও আমাদের প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। যে কারণে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন অনেকটাই নিরাপদ জোনে আছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে চলতি বছরের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। যার এপ্রিলে ছিলো ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
তারা আরও বলছেন, নানা কারণে মুদ্রানীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করা। এ ক্ষেত্রে সংকোচনমূলক বা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি কোনোটাই পুরোপুরি গ্রহণ করা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায় রেপো রেট বাড়লে ব্যাংকগুলো কলমানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এজন্য দেখা যায় মুদ্রানীতিতে দুটির সমন্বয় করার দরকার হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কমাতে হবে। অন্যান্য আমদানির চাপের কারণে বিনিময় হার বেড়ে গেছে। যার প্রভাবও মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ছে। সেজন্য চেষ্টা করতে হবে আমদানি কীভাবে কমানো যায়। রফতানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে যা যা করা দরকার তা দিক নির্দেশনা থাকবে মুদ্রানীতিতে। সবচেয়ে বড় কথা সুদের হার আরও কমাতে হবে। এজন্য কিছু সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সার্বিকভাবে সুদের হার বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, এজন্য সময় লাগবে। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু খাত নিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন- কৃষি, এসএমই, কুটিশিল্প এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের ওপর আরও বেশি সুবিধা কীভাবে দেওয়া যায় সেদিকে খেয়াল রেখে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মূদ্রানীতি করতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মনিটারি ও ফিসক্যাল পলিসির মধ্যে সমন্বয় হওয়া দরকার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে, তারপরও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ যুক্ত। অথচ উন্নত বিশ্বে এটা ৬০ শতাংশের বেশি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অথর্নীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক নানা কারণে এবার অর্থনৈতিক বিষয়গুলো খুব চ্যালেঞ্জিং। যে কারণে মুদ্রানীতি কিছুটা জটিল আকার ধারণ করেছে। আর্থিক কোনো একটি সূচক নির্ধারণ করতে গেলে তার ওপর আরেকটির প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ ঠিক রাখার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। আবার বিনিময় হার দেখতে গিয়ে আমদানি-রফতানির দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ডলারের সংকটের বিষয়ও মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সব মিলিয়ে আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো একটু জটিল আকার ধারণ করেছে। এর আগে কখনোই এমন জটিল পরিস্থিতি ছিল না।
ড. মো. আইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অর্থনীতি দুটি নীতির মাধ্যমে চলে। একটি রাজস্বনীতি আরেকটা মুদ্রানীতি। সাধারণত মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক করে থাকে। মুদ্রার যোগান, চাহিদা এবং ঋণ বিষয়গুলো মুদ্রানীতিতে উঠে আসে। তবে এবারের মুদ্রানীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অর্থাৎ মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সে উদ্দেশ্যে এবারের মুদ্রানীতির ঘোষণা করা হবে বলে প্রত্যাশা। যেন বিনিয়োগের অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনীতির গ্রোথটা ধরে রাখা যায়। যদিও মূল্যস্ফীতি অন্য দেশগুলোর তুলনায় খুব একটা বেশি হয়নি। তারপরও আমরা মনে করি মূল্যস্ফীতি গবিব মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়।’
মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূদ্রাস্ফীতি যে বেশি সেটি আমি বলবো না। কারণ বর্তমানে আমেরিকায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ব্রিটেনে ৮ শতাংশ, পাকিস্তান ১৩ শতাংশ। সে দিক থেকে আমরা নিরাপদ জোনে আছি। তবে আমাদের মনিটারি ও ফিসক্যাল পলিসি এই দুটির নীতির মধ্যে সমন্বয় হতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার হয় না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি আমাদের গবিব মানুষদের জন্য স্বস্তিদায়ক না। দেশে মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ টার্গেট করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। যার কোনোভাবেই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে বছর শেষে সেটা বুঝা যাবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ জুন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ৪১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। গত মে পর্যন্ত যা ছিল ৩২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। এর মানে শেষ সময়ে এসে ঋণ দ্রুত হারে বাড়ছে। চলতি জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি মিলে জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এইচএস/এনএ
মন্তব্য করুন: