• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চবির ওশেনোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব

২৩ পরীক্ষার্থীর খাতা ৮ মাসেও দেখা শেষ করতে পারেননি শিক্ষকরা

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ০০:২৬, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
২৩ পরীক্ষার্থীর খাতা ৮ মাসেও দেখা শেষ করতে পারেননি শিক্ষকরা

ছবি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে আর্থসামাজিক উন্নয়নে সমুদ্র অর্থনীতিতে জোর গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নানান বক্তব্যে বার বার উঠে আসছে সুনীল অর্থনীতি অর্জনের কথা। এজন্য সমুদ্র বিজ্ঞানী তৈরি করতেও জোর দিচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন সময় এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী দেওয়া বক্তব্য শুনে সমুদ্র বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগে ভর্তি হন মি. এক্স (ছদ্ম নাম)।

লক্ষ্য ছিল সমুদ্র বিজ্ঞানী হয়ে দেশের আগামীর সুনীল অর্থনীতি অর্জনপ্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু ২০১৯ সালে অনার্সের গণ্ডি পার হওয়ার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে তার ব্যাচের অন্য বিভাগের সব বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছেন, অথচ এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন মি. এক্স। সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বলছেন, আমার চাকরির বয়স আর মাত্র ৪ বছর আছে। আমি এখনো অনার্স পাস করতে পারিনি। প্লিজ আমাদের ফলাফল পেতে একটা কিছু করুন।

মি. এক্স এর ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ২৩ জন। গত বছরের ২০ এপ্রিল শেষ হয়েছে তাদের অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু এরপর আট মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মিলেনি কাঙ্খিত ফলাফল। এতে চাকরি আবেদনতো করতে পারছেনই না, কাগজে-কলমে ভর্তি হতে পারেননি মাস্টার্সে। যদিও অনার্সের ফল না দিয়েই তাদের মাস্টার্সে পড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মি. এক্সসহ তার বন্ধুদের অভিযোগ, ওই বিভাগের কতিপয় শিক্ষকই নিজেদের স্বার্থেরদ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীদের ফেলে রেখেছেন এমন অনিশ্চয়তায়।

শুধু মি. এক্স-এর ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নয় এই ফলাফলের দিকে চেয়ে আছে তাদের জুনিয়র আরও তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও। কারণ, বড় ভাইদের ফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হবে না তাদেরও। এভাবে সেশনজটে ঝুলে আছে ৪টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জীবন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০১৬-১৭ ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা চরমভাবে অবহেলিত। একদিকে শিক্ষক কম, তাও আবার যেই ৪ জন আছেন তাদের মধ্যে ২ জন আমাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকমতো নিতে না পারলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। কারণ ইতোমধ্যেই তারা আমাদের হুমকি দিয়েছেন যে কিছু বললে নম্বর কমিয়ে দিবেন বা ফেল করিয়ে দিবেন।

২০১৬-১৭ ব্যাচের আরেক ছাত্র বলেন, যেসব শিক্ষকরা অনিয়ম করছেন তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার শক্তি আমাদের নেই। আমরা একবার সেশনজট থেকে মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করতে চেয়েছি। কিন্তু যেসব শিক্ষক বাইরে ক্লাস নেন তারাই আবার আমাদেরকে হুমকি দিয়েছে প্রাকটিক্যাল ও ভাইবায় নম্বর কম দেবেন বলে। এজন্য আমরা এমনকি ভিসির কাছেও অভিযোগ দিতে সাহস পাই না। তাছাড়া আমাদের বিভাগীয় প্রধান ভিন্ন মতালম্বী হওয়ায় তিনি এসব সমস্যা নিয়ে চাইলেও কিছু করতে পারেন না, তার কথা গ্রহণও হয় না। ফলে আমরা অসহায় হয়ে আছি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১-১২ সেশন থেকে অনার্স ডিসিপ্লিন হিসেবে তৎকালীন মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিসারিজ ইনস্টিটিউট-এর অধীনে ওশানোগ্রাফি কোর্স চালু হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে ডিসিপ্লিনটি মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিসারিজ অনুষদের অধীনে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে মাত্র ৩ জন শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। এখন এ বিভাগটি চলছে মেরিন সায়েন্স থেকে আসা মাত্র ৪ জন শিক্ষক দিয়ে। বিভাগে নেই কোন পিয়ন, ল্যাব এসিসেস্ট এমনকি কোনো লাইব্রেরিয়ানও।

ওশানোগ্রাফি বিভাগের এই শূন্যতা পূরণ করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু বার বার নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ দেওয়ার পরও অদৃশ্য কারণে দুইজন শিক্ষক বার বার বাধা দেওয়ায় নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। সবশেষ নিয়োগ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হলেও উচ্চ আদালতে রিট করে সেটি বন্ধ করা হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই রিটের নেপথ্যে ছিলেন ওই বিভাগেরই দুই শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম এবং সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওই দুই শিক্ষকের পছন্দের প্রার্থী আবেদন করার যোগ্য না হওয়ায় তারা শিক্ষক নিয়োগে বাধা দিচ্ছেন। এমন কি শিক্ষক নিয়োগের ন্যুনতম যোগ্যতা কমিয়ে আনতেও নানানভাবে তদবির করছেন তারা। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মানাতে না পেরে মূলত উচ্চ আদালতের সম্মুখীন হয়েছেন তারা।

রিট যাচাই করে দেখা যায়, মেরিন সায়েন্সের গ্রাজুয়েটদের ওশেনোগ্রাফির শিক্ষক পদে অযোগ্য দাবি করে রিট দায়ের করেছেন তারা। যদিও উল্লেখিত দুই শিক্ষকই মেরিন সায়েন্স থেকে গ্রাজুয়েট হয়েই ওশানোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষক হয়েছেন।

শুধু তাই নয়, শিক্ষক সংকটের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। জানা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই তারা অবৈধভাবে কর্মদিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না নিয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেরিন ফিসারিজ একাডেমিতে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম বলছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ কর্মস্থলের বাইরে শুধু একই জেলার ভেতর অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটে ক্লাস নিতে পারবেন। কিন্তু অভিযুক্ত ড. মো. ওয়াহিদুল আলম এবং এনামুল হক চট্টগ্রামের বাইরে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন।

এত অনিয়ম কিভাবে চলছে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন সহসা শিক্ষক নিয়োগ জটিলতার সমাধান হবে জানিয়ে আর কোন বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। 

অভিযোগের বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম বাংলাভিশনকে বলেন, আমাদের অবহেলার অভিযোগটি সঠিক নয়। আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। কিন্তু শিক্ষক সংকট, খাতা মূল্যায়নের অটোমোশন পদ্ধতি না থাকা এবং গেস্ট টিচাররা সঠিক সময়ে খাতা না দেখে দেওয়া বা থিসিস পেপার আটকে যাওয়ার কারণে এই ফলাফল দিতে দেরি হচ্ছে। বিষয়টি আমরা শিক্ষক সমিতির মিটিংয়েও তুলেছি। আমরা অটোমোশন পদ্ধতি চালুর জন্য জোর দিচ্ছি সেটি হলেই খাতা দেখার দীর্ঘসূত্রিতা কমবে। 

পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই এনালগ পদ্ধতিতে চলছে, কিন্তু জট কেন শুধু ওশানোগ্রাফিতে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদেরতো লোকবলই নেই। রুম নেই। খুব কষ্ট করে আমরা চালাচ্ছি। নতুন নিয়োগ হলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই সংকটের মধ্যেও নিয়োগ আটকাতে রিট করেছিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিয়োগ আটকাতে চাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আইন আছে সেটি না মানার কারণে এই রিট করা হয়েছে।

নিজের প্রতিষ্ঠানে এত সংকটের মধ্যেও নিয়ম না মেনে অন্য প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সমুদ্র বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক সংকটে ভুগছে তাই তাদের অনুরোধে সেখানে ক্লাস নেই। তবে এর কারণে এখানকার ছাত্রদের কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ আমরা অনলাইনে দুএক ঘণ্টা তাদের দেই। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাম্পার হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল দিতে দেরি অন্য কারণে। 

অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে (যদিও বাংলাভিশনের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে) সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক বলেন, আপনারা এসে দেখে যান আমরা কি পরিমান পরিশ্রম করি। লোকবল কম হওয়ার কারণে আমাদের লোড আরও বেশি যায়। রিসোর্স সমস্যার কারণে এই সংকট হচ্ছে। আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। 

খাতা দেখতে দেরির বিষয়ে তিনি বলেন, আপনি যেটা বলছেন সেটা মিথ্যা নয়।  আমাদের শিক্ষক কম, মাত্র ৪ জন শিক্ষক আছে। অফিসিয়াল বিভিন্ন বিষয় আমাদের দেখতে হয়। তাই চাইলেও পারছি না। আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। এটা সুস্পষ্ট করে বলতে পারি।

রিট করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা আমাদের একটা স্ট্যান্ড ছিল। সে বিষয়ে আমরা মিডিয়ার পক্ষ থেকে সাপোর্ট পাবো আশা ছিল। কিন্তু পেলাম না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার-এর সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার মুঠোফোনে কল দেওয়া এবং এসএমএস করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১২ সালে বাংলাদেশের সমূদ্র অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশেনোগ্রাফি বিভাগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্তের আলোকে সে বছরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয় দেশের প্রথম ওশেনোগ্রাফি বিভাগ।

বিভি/এমআর

মন্তব্য করুন: