• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না

জসিম মল্লিক

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না

নারীদের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা কে না জানে। অনেক ঘটনা আছে আমার জীবনে যেখানে নারী মূল ভূমিকায়। আমার প্রতি নারীদের আনুকল্যের ঘটনাও কম না। আমার কৈশোর কাল থেকেই এমন দেখে আসছি। ছোটবেলায় আমি দেখতে বেশ ভাল ছিলাম। নাদুস টাইপ ছিলাম। একবার কয়েকজন মিলে আমাকে মেয়ে সাজিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। এটার নেতৃত্বে ছিল রুবি। আমরা সবাই প্রায় সমবয়সী। খেলার সাথী। আমাদের বিশাল বড় পরিবার। সেখানে গন্ডায় গন্ডায় ছেলে মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের বাড়ির মেয়েরা সবাই খুব রূপসী। আমাকে দেখে মা চিনতেই পারেন নি সেদিন। মাকে ভাল বোকা বানানো গেছিল। 


স্কুলে পড়ার সময়ও অনেক মেয়ে আমাকে দেখে মুখ লুকিয়ে হাসত। কেনো কে জানে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল খাল। সেখানে আমরা দলবেঁধে সাঁতার কাটতাম। খালের পাশ ঘেষেই রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একদল মেয়ে স্কুলে যেতো প্রতিদিন। তারমধ্যে একটা মেয়ে ছিল অতিশয় রুপসী।এতোটাই  যেনো মনে হতো চোখেৱ সামনে একটা লাউডগা দুলছে। বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের ড্রেস ছিল গোলাপী রঙের। সাদা চুড়িদার, গোলাপী জামা আর সাদা ওড়নায় দারুণ ফুটে উঠত ফুলের মতো মেয়েগুলো। যেনো এক একটা গোলাপ ফুল হেঁটে যাচ্ছে। লাউডগাৱ সাথে আমার প্রায় চোখাচোখি হতো!

যখন বিএম কলেজে পড়ি তখন এক আধটু লেখালেখি শুরু করেছি। বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব করি। একদল ছেলে মেয়ে নিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করি। কলেজের ম্যাগাজিনে লিখি। আমার সঙ্গী ছিল বুকভিলার রুপক, পান্না সহ আরো অনেকে। একদল মেয়েও ছিল। সবসবময় আমাকে ঘিরে থাকত মেয়েগুলো। তারমধ্যে দু’ একজনের আমার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। আমারও কি ছিল না! ছিল। একজন আমাকে সবসময় বই দিত পড়তে, পত্রিকা থেকে লেখার কাটিং এনে দিত। সবসময় বলত, আমি যেনো ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করি। শুধু চিঠি পত্রের মধ্যে যেনো সীমাদ্ধ না থাকি। যেনো গল্প উপন্যাস লিখি। 
আর একটি মেয়ে সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমিও তাকাতাম। লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে বড় বড় চিঠি দিত, চমৎকার বাক্য, শব্দ চয়ন আর সাহিত্যে ভরা চিঠি। সেসব চিঠিতে কখনো প্রেম ভালবাসার কথা থাকত না। আমি রিপ্লাই দিতাম। ততদিনে আমাদের বাড়িতে ফোন এসে গেছে। মেয়েটি বেশ দাপুটে ছিল। পয়সাওয়ালার মেয়ে। ডাক্তার কন্যা। কলেজের পর আমার সাথে তার ফোনে কথা হতো খুউব। কেউ কেউ হুটহাট বাড়িতেও চলে আসত। মা তাদের পরম যত্নে আপ্যায়ন করত। 

তারপর একদিন আমি খুউব আকস্মিক ঢাকা চলে আসলাম। আমি লেখক হতে চাই এই দুর্নিবার নেশা আমাকে টেনে নিয়ে আসল ঢাকা। বরিশালের বন্ধু, একদল প্রেমিক, মা, ভাই বোন আর বাড়ির খেলার সাথীদের ছেড়ে চলে আসলাম ঢাকায়। এক অনিশ্চিত জগতে পা রাখলাম। ঢাকায় এসেও  অনেক নারীর সহযোগিতা পেয়েছি। নাজমা খালা, বানী আপা ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৮৪ সালে আমি একটি কবিতার গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলাম। সেটির প্রকাশনার সব খরচ দিয়েছিলেন বানী আপা। অথচ বানী আপা ছিলেন আমার একজন ছাত্রীর মা। আমি একটা টিউশানি করতাম গোপীবাগে। একবার একটা সাহিত্য পত্রিকা করলাম। নাজমা খালা তখন বিটপিতে চাকরি করেন। তিনি কয়েকটি বিজ্ঞাপন যোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমার বেশ কয়েকজন নারী পত্রবন্ধু ছিল তখন। বিচিত্রায় লেখার কল্যানে অনেকের সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠেছে ততদিনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও একদল মেয়ে বন্ধু আমাকে ঘিরে থাকত, যেমনটা ছিল বরিশালে। পড়া শুনার চেয়েও হাকিম চত্বর আর টিএসসিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম। সাহিত্য নিয়ে কচকচানি কৱতাম। দু' একজন মেয়ে বন্ধুর সাথে আলাদা হয়ে যেতাম। গল্প করতাম। বয়সটাই ওরকম। ক্যাম্পাসে নারী বন্ধুদের মধ্যে হঠাৎ একদিন জেসমিন নামে একটি মেয়েৱ সাথে পৱিচয় এবং অচিৱেই সে আমার মন জয় করে ফেলল। আমাৱ কৱুণ দশা দেখেও মেয়েটি পিছপা হয়নি।
বিদেশে আসার পরও আমি নারীদের অনেক ভালবাসা আর আনুকল্য পেয়েছি। আমার লেখার পাঠক বা আমার বইয়ের ক্রেতা নারীরাই বেশি। কি দেশে কি বিদেশে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রতি সমব্যাথিও নারীরা বেশি। তারাই বেশি রেসপন্স করে। আমার নারী আত্মীয়রা আমার খুব অনুরক্ত। আমিও তাদেরকে ভালবাসি। তাদের যে কোনো প্ৰয়োজনে পাশে থাকি। 
আমার বোন সাজুর সবচেয়ে অহংকারের নাম ছিলাম আমি। আমার মা ছিল আমার পৃথিবী।মা চলে যাওয়ায় আমাৱ পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছিল। এখনও আমার মেয়ে অরিত্রি কখন আসবে সেজন্য সপ্তাহ জুড়ে আমি অপেক্ষা করি। জেসমিন যতই সারাক্ষন আমার ভুল ধরুক, যন্ত্রণা দিক আমি তার উপর একশতভাগ ডিপেনডেন্ট। সে ব্যতীত আমাৱ জীবন অচল। আবার নারী কর্তৃক আমি যেমন অনেক কষ্ট পেয়েছি, তেমনি কষ্ট দিয়েছিও। তা সত্বেও নারীদের যে কোনো অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই। কোনো ক্ষোভ পুষে রাখিনা।
আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,
”এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছে,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখব না…”
ঢাকা ৬ ডিসেম্বর ২০২২২

মন্তব্য করুন: