৬ দফা দাবি বাস্তবায়নে শহীদ মিনারে স্বাস্থ্য সহকারীদের অবস্থান কর্মসূচি

নিয়োগবিধি সংশোধন বেতন বৈষম্য নিরসন ও টেকনিক্যাল পদমর্যাদা প্রদানসহ ৬ দফা দাবি বাস্তবায়নে শহীদ মিনারে স্বাস্থ্য সহকারীদের শান্তিপূণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। 

শনিবার (২৯ নভেম্বর) সকাল থেকে দিনব্যাপী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট এসোসিয়েশনের ব্যানারে উক্ত অবস্থান কর্মসূচিতে দেশের ৬৪ জেলা থেকে হাজার হাজার স্বাস্থ্য সহকারী, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা ব্যানার, ফেস্টুন ও মনিপাতা নিয়ে এতে অংশ নেয়।

এর আগে গত ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট এসোসিয়েশনের নেতারা জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ৬ দফা দাবি বাস্তাবায়নের জিও (প্রজ্ঞাপন) আকারে প্রকাশের সময় বেধে দিয়ে এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্য সহকারী জিনিয়া মিলি বলেন, আমরা স্বাস্থ্য সহকারীরা সরকারি ছুটি ব্যতীত সারা মাস রৌদে-বৃষ্টিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে মা ও শিশু রেজিস্ট্রেশন করে টিকা প্রদান করি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাজের বিনিময়েই বিশ্বে টিকাদানে বাংলাদেশ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এ তৃণমূল স্বাস্থ্য সহকারীদের পরিশ্রমের সাফল্যের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন ভ্যাকসিন হিরো সম্মাননা, সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ হয়েছে বিশেষভাবে সম্মানিত। যাদের কাজের বিনিময়ে স্বাস্থ্য বিভাগ গর্বিত আজ তারাই অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি আমাদের স্বাস্থ্য সহকারী পদটি টেকনিক্যাল পদমর্যাদাসহ বেতন আপগ্রেডেশনের, কিন্ত এ দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক বলে প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসই দীর্ঘ ২৭ বছর পার করে দিয়েছেন।

সহকারী স্বাস্থ্য পরির্দশক মনির হোসেন বলেন, দীর্ঘ ২০ বছর পর আমার সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু বেতন বাড়েনি এক পয়সাও। বরং আমার নিজ জেলা থেকে অন্য জেলায় পদায়ন দিয়েছে। আমার জানা মতে, আমাদের মতো এমন বৈষম্যের শিকার অন্য কোনও বিভাগ নেই।

স্বাস্থ্য পরিদর্শক আবু কালাম বলেন, ছয় হাজার জনগোষ্ঠির জন্য একজন স্বাস্থ্য সহকারীর পদ সৃষ্টি হলেও বর্তমানে একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে ২০ থেকে ৩০ হাজার জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। অথচ সরকারি নিয়ম অনুসারে সেখানে পাঁচ থেকে ছয় জন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োজিত থাকার কথা।

প্রজাতন্ত্রের পদোন্নতি বিধি অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী তিন থেকে সাত বছর পরপর পদোন্নতি পান। কিন্তু  একজন স্বাস্থ্য সহকারী ২০ বছরেও পদোন্নতি পেয়ে সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক হতে পারি না। যদিও পদোন্নতি পান তাহলে স্বাস্থ্য পরিদর্শক হতে আরও কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে এমন সময় পদোন্নতি পায়, যখন চাকরির বয়স বাকী থাকে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাস। তবে যদিও পদোন্নতি হয় বেতন বাড়ে না এক পয়সাও। উপরন্তু বদলি করা হয় অন্য জেলা, উপজেলায়।

হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক ওয়াসি উদ্দিন রানা জানান, ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আমাদের বেতন বৈষম্য নিরসন করে টেকনিক্যাল পদমর্যদার দাবি বাস্তবায়নে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছর অতিবাহিত হলেও, সে ঘোষণার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে আজও বাস্তবায়ন হয়নি। যার ফলে ২০১৬ সালে ২৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য সহকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট এসোসিয়েশন ঢাকা বিভাগের এক সমাবেশে করেন। উক্ত সমাবেশ তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদের দাবি যৌক্তিক বলে ঘোষণা দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়ে ছিলেন কিন্তু তার কোন প্রতিফল পায়নি এ স্বাস্থ্য সহকারীরা।

পরে ২০১৭ সালে ৩০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য সহকারীদের সংগঠন পুনরায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারী দেশের এক লাখ ২০ হাজার আউটরিচ রুটিন টিকাদান কেন্দ্রে সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচী (ইপিআই) বন্ধ রেখে বেতন স্কেলসহ টেকনিক্যাল পদমর্যাদা দাবিতে কর্মবিরতির ডাক দেন।

এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি মেনে নিলে তারা কর্মবিরতি স্থগিত ঘোষণা করেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ফল পায়নি এ স্বাস্থ্য সহকারীরা।

একই দাবিতে আবারও ২০২০ সালে কর্মসূচিতে গেলে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি এবং স্বাস্থ্য সহকারীদের সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে উক্ত সভার রেজুলেশনের মাধ্যমে তাদের দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু তারও কোন বাস্তবায়ন করেনি।

চলতি ২০২৫ সালে আবারও তারা একই দাবি বাস্তবায়নে গত ২৫ মে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালনকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ তিন মাসের মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের দাবি বাস্তবায়নের কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

অবশেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করলে গত ২৬ জুলাই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এক মাসের মধ্যে দাবি বাস্তবায়নের সময় বেধে দিয়ে স্বাস্থ্য সহকারীরা গেল ১২ অক্টোবর থেকে যে টিসিভি ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো, তা সামনে রেখে ১ অক্টোবর থেকে সারা দেশের ১ লাখ ২০ হাজার আউটরিচ টিকা কেন্দ্রে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)ও সদ্য সমাপ্ত হওয়া টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) কর্মসূচির সব রিপোর্ট তৈরি ও প্রদান বন্ধ রেখে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি শুরু করেন।

এ কর্মবিরতির ফলে তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ৬দিন বন্ধ থাকার পর পরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে ৬ অক্টোবর মহাখালি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আলোচনায় বসে দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসে একমাসের জন্য স্থগিত করা হয়। আমরা তাদের আশ্বাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি পর্যায়ে সারাদেশের প্রায় ৫ কোটি শিশুদের টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) টিকা সফল ভাবে সম্পন্ন করেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসের দৃশ্যমান কোন প্রতিফলন দেখায়নি। তাই বাধ্য হয়ে ফের এ কর্মবিরতিও অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য সহকারীদের ৬ দফা দাবি:

১. নিয়োগবিধি সংশোধন করে স্নাতক বা সমমানের যোগ্যতাসংযুক্ত করে ১৪তম গ্রেড প্রদান।
২. ইন-সার্ভিস ডিপ্লোমা সম্পন্নকারীদের ১১তম গ্রেডসহ টেকনিক্যাল পদমর্যাদা দেওয়া।
৩. পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উচ্চতর গ্রেড নিশ্চিত করা।
৪. সকল স্বাস্থ্য সহকারী, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য পরিদর্শককে প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্নাতক স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা।
৫. বেতন স্কেল পুননির্ধারনের সময় প্রাপ্ত টাইম স্কেল বা উচ্চতর স্কেল সংযুক্ত করা।
৬. ইতোমধ্যে ইন-সার্ভিস ডিপ্লোমা (এসআইটি) কোর্স সম্পন্নকারীদের সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।

স্বাস্থ্য সহকারীদের নেতারা আরও জানান, আমরা প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠিকে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে কর্মবিরতিতে যেতে চাইনি, কর্মকর্তারা আমাদের এ অবস্থান কর্মবিরতি দিতে বাধ্য করিয়েছেন। আমাদের নিয়োগবিধিসহ বিভিন্ন দাবিতে পর্যায়ক্রমে আবেদন করা সত্ত্বেও এক একবার এক এক অজুহাতে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে থামিয়ে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত পাঁচ বার আমরা কর্মকর্তাদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে তাদের কথা রেখেছি কিন্তু কর্মকর্তারা আমাদেরকে দেওয়া তাদের কথা রাখেনি, কিন্তু এবার আমরা সবাই অনড় অবস্থানে।

আমরা বার বার শুধু কর্তৃপক্ষের আশার বাণীই শুনে যাচ্ছি। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এ বার আর আশার বাণীতে বিশ্বাসী নয়, বাস্তবায়ন চাই। আমাদের যৌক্তিক ৬ দফা দাবি জিও (প্রজ্ঞাপন) আকারে প্রকাশ না হওয়ার পর্যন্ত আমাদের এ অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মবিরতি চলবে।