• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

মাল্টিটাস্কিং কি কর্মদক্ষতা বাড়ায় নাকি কমায়!

রাইয়ান আজমি

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ২৩:০৯, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
মাল্টিটাস্কিং কি কর্মদক্ষতা বাড়ায় নাকি কমায়!

মাল্টিটাস্কিং কি আমাদের আরও বেশি দক্ষ করে তুলছে বা আমাদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়াচ্ছে? নাকি ঘটনাটা সম্পূর্ণ এর বিপরীত? আসুন দেখি গবেষণা কি বলে:

মাল্টিটাস্কিংয়ের আভিধানিক অর্থ হলো একই সময়ে একাধিক কাজ করা। ধারণা করা হয় যে ১৯৬৫ সালে আইবিএম-এর একটি পেপারে আইবিএম/৩৬০ এর সক্ষমতা সম্পর্কে জানাতে প্রথম এই ‘মাল্টিটাস্কিং’ শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দের প্রয়োগ কিন্তু এসেছে আরও অনেক পরে। ’৬০ এর দশকে হিউম্যান মাল্টিটাস্কিং ছিল গবেষণার স্তরে। পরবর্তীতে আনুমানিক ১৯৯৮ এর দিকে হিউম্যান মাল্টিটাস্কিং নিয়ে বেশি বেশি চর্চা হতে থাকে।

তো যেমনটা বলছিলাম, মাল্টিটাস্কিং হচ্ছে একই সময়ে একইসঙ্গে একের অধিক কাজ করা। যেমন ফোনে কথা বলতে বলতে ল্যাপটপে কোনো কাজ সেরে নেওয়া কিংবা কফি খেতে খেতে সংবাদপত্র পড়া, আবার গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা অথবা গান শোনা এসবই মাল্টিটাস্কিং। কিন্তু কয়েকটা কাজ পর পর করা হলে তাকে মাল্টিটাস্কিং বলা যায় না। যেমন ধরুন আপনি কাপড় ইস্ত্রি করে এরপর ভাঁজ করে রাখছেন কিংবা চা খাওয়াটা শেষ করে পত্রিকা পড়ছেন তখন এগুলো মাল্টিটাস্কিং হবে না ।

বর্তমান সময়ে মাল্টিটাস্কিং এর ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভাবা হয় যে মানুষটা একইসঙ্গে যত বেশি কাজ সম্পাদন করতে পারে সে তত বেশি দক্ষ এবং কোনো প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে সে বেশি অবদান রাখতে পারে। তাই কর্পোরেট জগতে সবাই নিজেকে মাল্টিটাস্কার হিসেবে ভাবতে ও দেখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু আসলে কি তাই? 

মাল্টিটাস্কিং করা কি আদৌ সম্ভব?
এটা খুব অস্বাভাবিক যে একজন মানুষ একই সময়ে দুই বা তার অধিক কাজ একসঙ্গে করতে পারবে। আমাদের বেশিরভাগকে বড়জোর সিরিয়াল ইউনিটাস্কার বলা চলে। নতুন এক গবেষণায় বলা হয় যে বেশ কিছু কাজ একসঙ্গে করার ক্ষেত্রে আমরা মানুষেরা ততটা ভাল নই যতটা ভালো আমরা মনে করি। বিজ্ঞানীরা বলে মানুষ একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ বা মাল্টিটাস্কিং করে না। এর পরিবর্তে আমরা যা করি তা হলো আমরা আমাদের মনযোগকে এক কাজ থেকে অন্য কাজে খুব দ্রুত সরিয়ে নিই। আর একসঙ্গে বিভিন্ন কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা মনে করি  আমরা একই সময়ে সবকিছুতেই সমানভাবে মনোযোগ দিচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা তা করছি না ।

যেমন ধরুন, আপনি ই-মেইল লিখছেন এবং একইসঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। এখানে দুটো কাজ একসঙ্গে করা হচ্ছে বলে মনে হলেও আসলে এই দুটো কাজ একসঙ্গে সমান মনোযোগ দিয়ে করা সম্ভব নয়। এখানে আপনি হয়তো একটি কাজের প্রতি ফোকাস কমিয়ে দিয়ে আরেকটি কাজ করছেন, আবার অন্য কাজে ফিরে যাচ্ছেন।

দুটো কাজে একইসঙ্গে আপনি মনোনিবেশ করতে পারছেন না। কারণ, এখানে দুটি আলাদা কাজ করা হচ্ছে যার কারণে আমাদের মস্তিস্ককে আলাদাভাবে ভাবতে হচ্ছে। তাই বলে মাল্টিটাস্কিং যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার তা কিন্তু নয়।

আমাদের মস্তিষ্কের পক্ষে তথা আমাদের পক্ষে মাল্টিটাস্কিং করা সম্ভব যদি কোনো একটি কাজ মস্তিষ্কের উপর খুব একটা প্রভাব না ফেলে কিংবা খুব বেশি চিন্তাভাবনা করে কাজটি করা না লাগে। যেমন হাঁটতে হাঁটতে চুইংগাম খাওয়া খুব সাধারণ একটি ব্যাপার যেখানে চুইংগাম খেতে আমাদের খুব একটা চিন্তাভাবনা করতে হয় না বা মস্তিষ্কের উপর কোনো প্রভাব পড়ে না। সমস্যাটি আসে যখন দুটি কাজই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। কিংবা কাজগুলো করার ক্ষেত্রে আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে সজাগ থাকতে হয়।

কারণ, মানব মস্তিষ্ক দুটি কাজ একসঙ্গে একাগ্রতার সঙ্গে কখনোই করতে পারে না।

এর ফলে দুটি কাজের কোনটিই পূর্ণ মনোযোগ পায় না এবং পরিপূর্ণ দক্ষতার সঙ্গে একটি কাজও করা যায় না। একটি বই পড়ার সময় দুটি সংখ্যা গুণ করার চেষ্টা করুন, দেখবেন কোনটিই সঠিকভাবে করতে পারছেন না।

এম আই টি-র নিউরো সায়েন্টিস্ট অধ্যাপক আর্ল মিলারের মতে লোকেরা খুব ভালোভাবে মাল্টিটাস্ক করতে পারে না। কিন্তু যখন তারা বলে যে তারা পারে তখন তারা নিজেরাই নিজেদের বিভ্রান্তিতে ফেলছে।

মাল্টিটাস্কিং কি প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়?

মাল্টিটাস্কিং করার প্রবণতা মস্তিষ্কে এক বিরুপ পরিবর্তন নিয়ে আসে। যা হতাশা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতপক্ষে প্রোডাক্টিভিটি হ্রাস করে। কিছু কিছু গবেষণা বলে, মাল্টিটাস্কিং আপনার বোধগম্যতা, মনোযোগ এবং সামগ্রিক কর্মদক্ষতা হ্রাস করার মাধ্যমে প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়।

কারণ, মাল্টিটাস্কিং এর সময় বিভিন্ন কাজ একসঙ্গে করা হয় যেখানে আমরা খুব দ্রুত আমাদের মনযোগ এক কাজ থেকে অন্য কাজে সরিয়ে নেই এবং এর ফলে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। গবেষকদের মতে যারা মাল্টিটাস্ক করে তারা দ্রুত কাজ করে কিন্তু তাদের মাঝে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায় যারা নিজেদের খুব ভালো মাল্টিটাস্কার বলে দাবি করতো এবং বিশ্বাস করতো যে এটা তাদের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় তারা আসলে কাজের ক্ষেত্রে খারাপ করেছে, যারা একবারে একটি যারা একবারে একটি কাজ করে তাদের তুলনায়। মাল্টিটাস্কারদের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে সমন্বয় করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল এবং এক কাজ থেকে অন্য কাজে সুইচ করার ক্ষেত্রেও তারা ধীরগতির ছিল।

মস্তিষ্কের উপর মাল্টিটাস্কিং এর প্রভাব
মাল্টিটাস্কিং কেবল আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে শূন্যতাই সৃষ্টি করে না, এটি আমাদের মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করে। একাধিক কাজের মধ্যে খুব দ্রুত সুইচ করার ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনেটেড গ্লুকোজ ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যায় ফলে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে খুব দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

আমাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাসজনিত সমস্যার সঙ্গে মাল্টিটাস্কিং এর সম্পৃক্ততা আছে। দুই বছর আগে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা অন্তত একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ক্রমাগত একাধিক কাজ করে তাদের ওয়ার্কিং মেমোরি এবং লং টার্ম মেমোরিতে দুর্বলতা ছিল।

মাল্টিটাস্কিং এর সুফল
প্রতিটি কাজের ভালো-খারাপ দুটি দিক থাকে, ঠিক তেমনই মাল্টিটাস্কিংয়েরও কিছু ভালো দিক আছে। যা আমাদের  মাল্টিটাস্কার হতে উৎসাহিত করে, যেমন:

● সময় বাচায়: একসঙ্গে কয়েকটি কাজ করার মাধ্যমে আমরা কম সময়ে আমাদের কাজগুলো শেষ করতে পারছি। যদিও আমাদের সামগ্রিক কর্মদক্ষতা হয়ত এর ফলে হ্রাস পাচ্ছে। 

● প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে: মাল্টিটাস্কিং করার প্রবণতা প্রোডাক্টিভিটি কমায়। কিন্তু খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে এটি আমাদের প্রোডাক্টিভিটিকে বাড়িয়ে দেয় যেহেতু আপনি অল্প সময়ে কয়েকটি কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করছেন।

● মোটিভেশন: যখন আপনি অল্প সময়ে কয়েকটি কাজ করে ফেলবেন তখন ইন্সট্যান্টলি মোটিভেটেড ফিল করবেন কিছু সময়ের জন্য হলেও। কিন্তু মাল্টিটাস্কিংয়ের মাধ্যমে আমরা  দীর্ঘমেয়াদী কোনো উপকার পাই না বললেই চলে।

বিভি/এনএ

মন্তব্য করুন: