• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অতিথি পাখির অভয়ারণ্য খ্যাত লেক ভরাট করে ভবন তুলছে জাবি

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১৩ জুন ২০২৪

ফন্ট সাইজ
অতিথি পাখির অভয়ারণ্য খ্যাত লেক ভরাট করে ভবন তুলছে জাবি

অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেক ভরাট করে ও পরিবেশের ক্ষতি করে ভবন নির্মাণ নয়; একাডেমিক ভবন নির্মাণ করতে হলে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির এসেসমেন্ট নিশ্চিত করা ও অবিলম্বে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবেশবাদীরা। জলাশয় ভরাটের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) লেকের পাড়ে মানববন্ধন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 'জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলন' ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি ছাত্রসংগঠন ও জাতীয় পর্যায়ের পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংহতি জানিয়ে অংশ নেন।

এ সময় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনের নেত্রী সৈয়দা রত্না, বায়মণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, শহীদ আনোয়ারা উদ্যান রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব, মিশন গ্রিন বাংলাদেশের সমন্বয়ক আহসান রনি ও  প্রজেক্ট টিম লিডার কেফায়েত শাকিল, নগর পরিকল্পনাবিদ রাকিবুল রনি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা) সহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ৩য় ধাপের বিভিন্ন স্থাপনার নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেছেন।

কলা অনুষদের বর্ধিতাংশ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেখানে কেবলমাত্র নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করেই নয়, উপরন্তু পার্শ্ববর্তী লেকটি ভরাট করে নির্মাণ কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঈদের ছুটির সুযোগে ফাঁকা ক্যাম্পাসে নতুন রেজিস্ট্রার ভবনের পার্শ্ববর্তী লেকে মাটি ফেলে অন্তত ৬০-৭০ ফুট ভরাট করে ফেলা হয়েছে। লেকটি প্রতি বছর হাজার হাজার অতিথি পাখির বিচরণস্থল হয়ে উঠে। পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা মনে করেন, জীববৈচিত্র্যের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটি লেককে এভাবে ভরাট করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জলাশয় সংরক্ষণ আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রাণ-প্রকৃতির আধার একটি ক্যাম্পাসের প্রশাসনের এহেন কর্মকাণ্ডে তারা ক্ষুব্ধ।

তারা গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদ এবং জীববিজ্ঞান অনুষদের বর্ধিতাংশ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থানও পরিদর্শন করেন। জীববিজ্ঞান অনুষদ প্রয়োজনীয় সার্ভে না করেই নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জলাশয় ভরাট করে গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের বর্ধিতাংশ নির্মাণেরও নিন্দ্য জানান ও তা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান। পরিদর্শন করে তারা জানতে পারেন, চারুকলা অনুষদ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সার্ভে করা হলেও কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কমিটি এখনও করা হয়নি। দলটি প্রকল্প পরিচালককে শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞদের সকল পরামর্শ মানা ও পরিবেশের ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার তাগিদ দেয়।

প্রতিনিধি দলটি জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলন' এর ব্যানারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে অংশ নিয়ে পরিকল্পিত উন্নয়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনে সংহতি জানায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ৩টি দাবি হলো- অবিলম্বে মাস্টারপ্ল্যানের দরপত্র আহ্বান, একাডেমিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির এসেসমেন্ট নিশ্চিত করা এবং মাস্টারপ্লান ছাড়া একাডেমিক ভবন ব্যতীত আর কোনো ভবন নির্মাণ নয়।

মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারিত হলে সেখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটা ও জলাশয় ভরাট করা যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, তা দৃশ্যমান। এরপরও গায়ের জোরে তড়িঘড়ি করে অংশীজনদের মতামতকে উপেক্ষা করে কাজগুলো করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের মহাপরিকল্পনার মতো একটা যৌক্তিক দাবিকে কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করছে। জাহাঙ্গীরনগরের জলাশয়ে প্রতিবছর অতিথি পাখি আসে। এর জাতীয় গুরুত্ব আছে। তারা কীভাবে এর গুরুত্বকে অস্বীকার করে? এখানে চলমান গোটা নির্মাণকাজের প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ। এর মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগরের পরিবেশগত ঐতিহ্য ও সংবেদনশীলতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হচ্ছে।

বাপা'র সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন প্রকৃতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে যে উন্নয়ন এর কর্মসূচি নিয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। এসব কর্মকাণ্ড যতটা না উন্নয়নমূলক, তারচেয়ে বেশি পরিবেশ বিধবংসী ও গুটিকয় ব্যক্তির পকেট উন্নয়নের জন্য। প্রশাসনের এমন কর্মকাণ্ড ক্ষমতার অপব্যবহার, একপেশে। আমরা আশা করি অবিলম্বে প্রশাসনের সুমতি ফিরবে এবং এমন পরিবেশ বিনাশী কর্মকাণ্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিরত থাকবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, কলা ও মানবিক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেভাবে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল, এখন তার উল্টো কাজ হচ্ছে। কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিন-চার মাস ধরে তারা (প্রশাসন) ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে সভা করে বলেছিল, তারা লেকে ভবন বানাবে না। কিন্তু ক্যাম্পাস যখন ছুটি হয়েছে এবং অনেক শিক্ষার্থী ছুটিতে বাড়ি চলে গেছেন। ঠিক তখন লেক ভরাটের কাজ শুরু করেছে তারা। ক্যাম্পাসে অপরিকল্পিতভাবে ১৭টি স্থাপনার কাজ করতে গিয়ে গাছপালা নিঃশেষের পর এখন তারা জলাশয়ে ভবন। বানাতে শুরু করেছে।

শহীদ আনোয়ারা উদ্যান রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক এবং তাদের দাবির সমর্থনে আমরা সকলে। সংহতি জানাই এবং জাহাঙ্গীরনগরে চলমান ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধকল্পে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির এসেসমেন্ট ছাড়া একাডেমিক ভবন নির্মাণের বিরোধীতা সত্ত্বেও লেক ভরাট করা প্রচন্ড অন্যায়। এমন অন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, প্রয়োজন বিবেচনায় একাডেমিক ভবনের বিরোধী আমরা নই। আমরা চাই, ক্লাসরুম সঙ্কট নিরসন হোক এবং তা করতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির এসেসমেন্টের মধ্য দিয়ে যেতে চাই।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান বলেন, আমরা দেখেছি জলাশয় ভরাটের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ অল্প বৃষ্টিতেই ভেসে যায়। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে পুনরায় লেক ভরাট করা হচ্ছে, যা প্রচণ্ড অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিনিধিদের কাছে একটি চিঠি প্রদান করে।

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: