• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বললেন, ‘বুড়িগঙ্গায় গবেষণার প্রয়োজন নেই

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ২২:০৬, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

ফন্ট সাইজ
গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বললেন, ‘বুড়িগঙ্গায় গবেষণার প্রয়োজন নেই

শ্যামপুরের শতাধিক ডাইং কারখানার তরল বর্জ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এতে রঙ মিশ্রিত পানির কারণে বেগুনি রঙ ধারণ করেছে বুড়িগঙ্গা। আছে দুগন্ধও। 

বুড়িগঙ্গার পানিতে ডায়িং কারখানার দূষণ নিয়ে দুই বছর ধরে গবেষণা করেছে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিভাগ এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর বিজ্ঞানীরা। মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সেই গবেষণার ফল প্রকাশের জন্য নদীর তীরেই আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলনের। সংবাদ সম্মেলন উপলক্ষে সাংবাদিকদের নিয়ে সেখানে গিয়ে দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখে পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানান, এই নদীর পানি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে কতো খারাপ অবস্থা।

গবেষকদের এই কথায় সায় দেন সেই নদীর নৌকা চালক ও জেলেরা। তারাও বলেন, গবেষণা ছাড়াই বলে দেওয়া যাবে এই নদীতে প্রাণ বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।

মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) শ্যামপুর ফায়ার স্টেশন ঘাট এলাকায় এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকালে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম ও বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সদস্য এবং বিভিন্ন গণমামাধ্যমের কর্মীরা দোলেশ্বর গুদারাঘাট থেকে নৌকা যোগে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে ডায়িং শিল্পের দ্বারা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে নদীর পানির অবস্থা বর্ণনা করেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি জানান, পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে চালানো গবেষণায় বুড়িগঙ্গার শ্যামপুর অংশের পানি সবচেয়ে নিচের ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন তারা। যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে বলেও জানান তিনি।

ড. কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমরা জানি পিএইচের আদর্শ মান ৭ এর থেকে বেশি প্রদর্শন করলে তা ক্ষারধর্মী এবং কম প্রদর্শনকরলে তা অম্লধর্মী। বুড়িগঙ্গার পানির পিএইচ পরিমাপে আমরা দেখতে পাই শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির পানিতে পিএইচের মান প্রাকবর্ষা, বর্ষা ও বর্ষাপরবর্তী মৌসুমে যথাক্রমে ৭.৬, ৬.৭ এবং ৮.৫।  সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শ্যামপুরের পানি বর্ষার সময় অম্লীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। এছাড়া, বর্ষার পূর্বে এবং বর্ষার পরে সেই পানি ক্ষারীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। 

পানিতে টিএসএস এর আদর্শ মান ১০। শ্যামপুরের পানিতে টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস এর পরিমাণ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে তিন ঋতুতে যথাক্রমে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শ্যামপুরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে টিএসএস বা টোটাল সাসপেন্ডেড সলিডস পাওয়া যায় যা পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানির নিচে নদী তলে পাতলা আস্তরণ সৃষ্টি করে।

‘প্রাকবর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডি-এর পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই তিন ঋতুতে সিওডি-এর পরিমান যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। যা আদর্শ মান ৪ এর চেয়ে বহু গুণে বেশি। জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডি-এর পরিমান পরীক্ষা করে দেখা যায় ওই তিন সময়ে বিওডি-এর পরিমান যথাক্রমে ৮৭,৭২, ও ১০৬, যা আদর্শমান ০.২ এর তুলনায় অত্যাধিক বেশি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় প্রকার অক্সিজেন চাহিদা অত্যন্ত বেশি, যা এই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকাকে নির্দেশ করে।’

পানিতে নাইট্রোজেনের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, পানিতে অ্যাম্যোনিয়ার আদর্শমান ০.৫। অথচ ৩টি ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে অ্যাম্যোনিয়ার পরিমাণ ৪.৮, ৪.২, ও ২.৮ পাওয়া গেছে। যা আদর্শ মানের চেয়ে বহুমাত্রায় বেশি। উচ্চমাত্রার অ্যাম্যোনিয়া শ্যামপুরের পানিতে নাইট্রোজেন দূষণকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য দূষণীয়। 

শ্যামপুরের পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় তেল ও প্রিজ পাওয়া গেছে বলেও তুলে ধরা হয় গবেষণায়। তেল ও গ্রীজ নদীতে স্বাভাবিক আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে এবং পানির উপরিভাগে একটি আস্তরণ তৈরি করে। পানিতে তেল ও গ্রীজের আদর্শ মান ০.০১। অথচ পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৩টি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ যথাক্রমে ২.৬, ১.৯, ও ৫.৬।

‘পানীয় জলে ফেনলের উপস্থিতি মানবদেহে বিভিন্ন অসুখ যেমন ডায়েরিয়া, লিভারে স্থায়ী সমস্যা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। পানিতে ফেনলের আদর্শ মান ধরা হয়  ০.০০২। অথচ শ্যামপুরের পানিতে তিন ঋতুতে যার মান যথাক্রমে ০.১৪, ০.৪৩৫ ও ০.২ পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় ফেনল শ্যামপুরের পানিকে আরও বিষাক্ত এবং পানের অনুপোযোগী করে তুলেছে।’  

গবেষণা পদ্ধতি প্রসংগে তিনি জানান, শ্যামপুরের দূষণের বাস্তবিক অবস্থা বিচারে তাঁরা বিভিন্ন ঋতুতে পানিতে প্রাপ্ত ৯টি ভিন্নভিন্ন রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করেন। পরবর্তিতে এক্সপ্লোরেটোরি স্ট্যাটিস্টিকাল পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির রাসায়নিক উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করে পানির একটি গুনমান সূচক দাঁড় করানো হয়। ৪টি ভিন্নভিন্ন ইন্ডেক্সিং পদ্ধতির মধ্য থেকে সবচেয়ে আধুনিক ও উপযোগী পদ্ধতি সিসিএমই ওয়াটার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি পানির গুনমানের ঋতুগত এবং স্থানিক পার্থক্যসমূহের বহুমাত্রিক কারণগুলি ব্যাখ্যা করে এবং এইভাবে এটি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় নদীর পানির শ্রেণী এবং অবস্থা শ্রেণীবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। স্থানিক এবং কালিক প্রেক্ষাপটে পানির গুণমানসূচক (WQI) গণনা করার জন্য CCME কৌশলটিতে জলের জৈব এবং অজৈব উভয় পরামিতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলেও জানানো হয়। 

সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে শরীফ জামিল বলেন, শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ পরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে না। পানির দিকে তাকালেই দেখা যায় এর রঙ গোলাপী। আমরা শ্যামপুর ডায়িং এর রাসায়নিক দূষণের প্রতিবাদ করি। তবে আমরা চাই না ডায়িং শিল্প বন্ধ হোক। আমরা চাই টেকসই উন্নয়ন, আমরা চাই নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসুক। এখন মানুষের কিডনী রোগ এবং ক্যান্সারের প্রবণতা বেড়ে গেছে এই দূষণের কারণে। 

‘এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা বলতে চাই, অবিলম্বে নদী দূষণে দায়ী ডাইং কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে; ডাইং কারখানাগুলোকে অবশ্যই বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে হবে; এবং জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বুড়িগঙ্গা আমাদের প্রাণ, বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ, আর তাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে সংহতি বক্তব্য প্রদান করেন বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য মো. সেলিম, বাপা’র সিনিয়র সদস্য হানিফ সহিদ এবং যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট রাওমান স্মিতা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য দেওয়ান নূর তাজ আলম, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. কামরুজ্জামান এবং প্রকল্প পর্যবেক্ষক ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা  এম এম কবির মামুন।

 

বিভি/কেএস/রিসি 

মন্তব্য করুন: