পূর্ব-পশ্চিম ব্যালেন্সের চ্যালেঞ্জে সরকার
বৈশ্বিক মেরুকরণের একটি পার্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বশক্তিতে বড়দের লড়াইয়ে বাংলাদেশ এক পক্ষ হয়ে গেছে তা আর বলার-বোঝার বাকি নেই। বাংলাদেশ তা কিভাবে সামলাবে-এ প্রশ্নের কিছুটা জবাব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কিছুটা দিয়েছেন। নির্বাচনে জয় উপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানাতে ৯ জানুয়ারি গণভবনে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, বিদেশি প্রভুদের পরামর্শ মেনে চললে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। তার কোনো প্রভু নেই বলে দাবি তার। বাস্তবে বন্ধুরূপী প্রভূতে ঘুরছে বাংলাদেশের ভবিষ্যত। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন সব পক্ষই বিদেশি শক্তির নাগালে ধন্য হচ্ছে। ভারত-রাশিয়া-চীনসহ কিছু দেশ নির্বাচন ভালো হয়েছে বলায় ক্ষমতাসীনরা খুশি। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ বিপরীতটা বলায় খুশি বিএনপি, জামায়াতসহ কিছু দল।
বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মনমর্জির এই দুই স্পষ্টতা বন্ধুত্বের না প্রভূত্বের তা ব্যাখ্যার দরকার করে না। স্পষ্ট বা ভ্যানুটা বাংলাদেশের রানৈতিক দলগুলোই ঠিক করে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তা আরো পাকাপোক্ত করে দেয়া হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দমনপীড়ন নিয়ে ছিল সোচ্চার।
আরেকদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া। নির্বাচনের পর তা একদম প্রকাশ্যে। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েক দেশ নির্বাচনের বেসরকারি ফরাফলের পরপরই শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের বিজয়ে উল্লাসের প্রকাশ ঘটায়। এসব দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা কেবল সমর্থন-বিবৃতি নয়, গণভবনে সশরীরে ছুটে যেতেও দেরি করেননি।
বেসরকারি ফল প্রকাশের পরই রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন্স, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতেরাও বাদ যাননি।
ভোটগ্রহণের আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে রাশিয়ার পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে ওয়াই শুটব বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আয়োজনও চমৎকার ছিল। এই ঘোর সমর্থনের বিপরীতে অবস্থান জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের। তারা মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।
নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা ব্যক্ত করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি সহিংস আচরণ পরিহারের আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
আর যুক্তরাজ্য বলেছে, এ নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মান পূরণ হয়নি। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস- এফসিডিওর মুখপাত্র বিবৃতিতে ভোটের আগে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি।’ সব দল অংশ নেয়নি বলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট দেয়ার যথেষ্ট বিকল্প ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিবৃতিতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন মর্মাহত হয়েছে এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেয়ায়। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোটো নিনো জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন মহাসচিব।
এ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওএইচসিএইচআর গত সোমবার (৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷ বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দেশের প্রতিশ্রুতি নবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভোলকার তুর্ক৷ বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান ফলকার টুর্ক বলেছেন, ‘ভোট শুরুর আগের কয়েক মাস হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে বা ভয় দেখানো হয়েছে৷ এই ধরনের কৌশল সত্যিকারের আন্তরিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয় ৷ এমন প্রতিক্রিয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বা ইইউ কি সম্পর্ক ছিন্ন করবে?
বিৃতিতে কিন্তু, সে ধরনের আভাস-ইঙ্গিত নেই। বরং মানবাধিকার, বাণিজ্য ও উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা আছে। এও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে তারা সকল রাজনৈতিক দলকে তাদের মতপার্থক্য দূর করতে এবং একটি অভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করবে। পক্ষে-বিপক্ষের সব প্রতিক্রিয়াকেই সরকার তার জন্য শুভ মনে করে। দেশে তার প্রতিপক্ষ নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে বিপক্ষরা নির্বাচনের সমালোচনা করলেও সরকারকে সমর্থন না দেয়া বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো কোনো বার্তা দেয়নি। এটি সরকারের জন্য অবশ্যই স্বস্তির। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে বা আরো উন্নত হবে, সেই আশা করে সরকার। সেই মশলা সরকারের কাছে রয়েছেও। সরকার এবং তার ঘরানার কূটনীতিকরা মনে করেন, ভয়ের কিছু নেই। তাদের হিসাব একদম সোজা। ভারতের সাথে জাপানও অভিনন্দন জানিয়েছে। জাপান-ভারতকে ছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্ব ভাবা যায় না। আর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিবৃতিও অনেকটা ভারসাম্যমূলক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ভোটের ২৪ ঘণ্টা পর নির্বাচনকে ‘অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না’ বলে উল্লেখ করলেও এগুলো খুব জোরালো কণ্ঠের দাবি ছিল না। বরং তাদের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কীভাবে ভোটপূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসা যায় তার একটা ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। বিবৃতিগুলোতে ভাষার ব্যবহার এমনভাবে করা হয়েছে তাতে সমন্বয় বা সমতা তৈরির দিকে জোর দেয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ সরকার এখন কিভাবে নেবে, সামলাবে, আপোস করবে না, মোকাবেলা করবে-অপেক্ষা করে দেখার বিষয়।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: