• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

খেলাপির জিলাপি: প্রচারে প্রসার

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ১৪ জুন ২০২৪

আপডেট: ১৫:২২, ১৪ জুন ২০২৪

ফন্ট সাইজ
খেলাপির জিলাপি: প্রচারে প্রসার

খেলাপি হওয়াও হালফ্যাশনের মতো একটা স্মার্টনেস। তা কেবল ঋণে নয়; কথা-কাজসহ আরো অনেক কিছুতেই। কথা খেলাপ, কাজ খেলাপে তেমন পুঁজি লাগে না। কথা দিয়ে কথা না রাখা, কাজ না করে ফেলে রাখার খেলাপিপনা একদম সোজা। পাওনা টাকা না দেয়া মানে ঋণ খেলাপি হওয়া কিঞ্চিত কঠিন। এতে কিছু পুঁজি-পাট্টা এবং বিশেষ কমিউনিকেশন লাগে। কোনো বিজ্ঞাপন দরকার হয় না। নিজের প্রচার-প্রসার বা ভাইরালের জন্যও তা লাগসই। শতভাগ পরীক্ষিতও। মানুষ কেবল খাওয়ার জন্য বাঁচে না। সম্মান চায়, ক্ষমতা চায়, নিরাপত্তা চায়, আরামও চায়। ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে এসবের নিশ্চয়তাও মেলে। ঋণ নিয়ে খেলাপি করে সৌখিন গরুর খামার করলেও প্রচার মেলে। রক-আন্ডারটেকার- হলিউড কিছিমের রেসলিং রিং কাঁপানো নাম নইলে সুলতান, নবাব, তুফান, রাজা-বাদশা-সম্রাট নামে তা বাজারে তুললে আরেক দফায় ভাইরাল। কালাপাহাড়-লালপাহাড় দিপজল-শাকিব খান, জায়েদ খান, পরিমনি, তাহেরি নামকরণে আরো জম্পেশ। নিজে ভাইরাল, ক্রেতারও নাম ফাটে। 

নিন্দা, সমালোচনা ইত্যাদিতে প্রচার-প্রসারের এ কদাকার পথে ‘খেলাপি ঋণ মডেল’ই এখন দেশের জন্য একটা বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। এ মডেলের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকেরও জানা। সর্বশেষ হিসাবে তিন মাসেই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। দেশে এর আগে, খেলাপি ঋণ এই মাত্রায় আর ওঠেনি। সরকার নিজেও এ স্মার্টনেসে আসক্ত। 

হলমার্কের তানভীর, তার স্ত্রী জেসমিনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হলো সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে- মেরে দেয়ার জন্যে। তবে এবারের এই রায়ের বিশেষত্ব হলো- এই মামলায় হলমার্ককে অন্যায্য সুবিধা দেয়ার অভিযোগে আদালত সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডিসহ আরো দশজনকে দীর্ঘমেয়াদী জেল দিয়েছে। মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে দিনের পর দিন এইটা জানান দেয়া হচ্ছে যে, ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীরা অন্যায়ভাবে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয় না। বাস্তবতা হলো-ব্যবসায়ী ছাড়াও এই কথিত ঋণের পার্সেন্টেজ রাজনৈতিক আর ব্যাংকাররাও পায়। একটা অশুভ নেক্সাস সৃষ্টির মাধ্যমে এই অর্থ ব্যাংক থেকে বের করা হয়- ঋণের নামে। ব্যাংক কি তাহলে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদেরকে ঋণ দেবে না? ঋণ না দিলে- ব্যাংক চলবে কিভাবে? লুট বা পাচারই বা হবে কোত্থেকে?

গত এক দশকে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, পি কে হালদারসহ কত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম জেনেছে মানুষ! এর বাইরে ফারমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পিপলস লিজিংসহ আর্থিকখাতের আরো বেশকিছু অনিয়ম-অর্থ লুটপাটের টুকটাক হিসাবও জেনেছে। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুট ও পাচারের ক্ষত করোনা মহামারি বা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষতের চেয়ে কম নয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ সংগ্রহ করে। সেই ঋণ কিছু বেশি দামে গ্রহীতাদের কাছে বিক্রি করে। এর মধ্যে সিআরআর, এসএলআর থাকার কারণে, সব আমানত ঋণ হিসেবে দিতে পারে না। ঋণের অর্থ ব্যবসায়ীদের কাছে দেয়া অনেকটা নিরাপদ হলেও শিল্পে বিনিয়োগ করা- বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্টই ঝুঁকিপুর্ণ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতকারীদের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাংকের আমানত অনেক বেশি হওয়া সত্বেও- ক্ষুদ্র শিল্প ব্যবসাগুলোকে ঋণ দিতে ব্যাংক বরাবর অনাগ্রহী। দিলেও সতের রকম ফ্যাকড়া তুলে কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। এরপরে যাদের কাছে ঋণ দেয়, তাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কোল্যাটারাল সিকিউরিটি নেয়া হয়। এর বিপরীতে বড় শিল্পগুলোর ঋণ আদায়ের হার ৮০% নীচে। তারপরেও ব্যাংকগুলো তেলা মাথায় তেল দেয়া নীতি অনুসরণ করে। জিলাপির মতো প্যাঁচে তাদেরকে ছাপ্পড় ভরে ঋণ দেয়। কিন্তু পর্যাপ্ত জামানত না থাকায়, ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারে না। শেষতক তাদেরকে সুদ মওকুফ সুবিধা আর ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংক ঋণের লেজার স্থিতি ঠিক রাখতে হয়।

এমন জিলাপি কার না খেতে মন চাইবে? সরকারের নামিদামি প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি, বিটিএমসি, বিএডিসি, বিটিবি, বিসিআইসি, বিএসএফআইসি, বিআরটিসি, টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে চোখ কেবল কপালে নয়, মাথা ছেদ করে পেছনেও চলে যাওয়ার উপক্রম হতে পারে। শুধু বেসরকারি কোম্পানি নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাগুলো এখন ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কাছে আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এখন ঋণখেলাপি। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই জিলাপির খেলাপি কেবল বাড়ছেই। ব্যাংক খাতের এই ক্ষত দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের শর্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক নির্দেশনার অভাবে উলটো তা আরও বেড়েছে। কমার লক্ষণ নেই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন 

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: