• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

জনকল্যাণ নিশ্চিতে দুর্নীতিবাজ ও অসৎদের দমন জরুরি

প্রসেনজিৎ হালদার

প্রকাশিত: ০১:২০, ৪ অক্টোবর ২০২৪

আপডেট: ১৬:০২, ৪ অক্টোবর ২০২৪

ফন্ট সাইজ
জনকল্যাণ নিশ্চিতে দুর্নীতিবাজ ও অসৎদের দমন জরুরি

ফাইল ছবি

প্রাচীন গ্রীস থেকে রাজনীতির উত্থান। জনমানুষের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করাই রাজনীতির উদ্দেশ্য। প্রাচীন গ্রীক বোদ্ধাগণ তেমনটিই প্রচলন করেছেন। হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলমান রয়েছে। দেশে দেশে রাজনীতির চর্চার উন্নয়নও হয়েছে। অনেক দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কারণে নাগরিক সেবা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পুঁজি বানিয়ে লাভবান হচ্ছে তৃতীয় সারির দেশগুলোর কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ ও অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তি। আমাদের দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব রয়েছে। সভা, সমাবেশ, মিছিল; আর বিরোধীদের নিয়ে বিষোদগার করাই যেন ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাহীনদের মূখ্য উদ্দেশ্য।

ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতবর্ষ মুক্ত হওয়ার কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাও স্বাধীন দেশের খেতাব লাভ করে। এরপর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হয়, প্রসারিত হতে থাকে রাজনীতির দুয়ার। জনগণের সেবার জন্য প্রার্থীরা নানান আশ্বাস দিয়ে ভোট কামনা করেন। এরপর ভোটে বিজয়ী হয়ে জনসেবায় মনোনিবেশ করেন। কেউ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হন, কেউ নিজেদের কল্যাণেই বেশি আগ্রহ দেখান। পঞ্চাশোর্ধ বছর ধরে চলমান গণতান্ত্রিক প্রথায় দেশের মানুষের যেমন উন্নয়ন হয়েছে, পক্ষান্তরে রাজনীতির সঙ্গে অসৎ ব্যক্তি যুক্ত হওয়ায় অবনতিও হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। টানা চারবারের ক্ষমতা ধরে রাখা তাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। বছরের পর বছর বিরোধীদের দমিয়ে রাখা, গুম-মামলায় জর্জরিত করা তাদের প্রথা হয়ে দাড়িয়েছিল। এইভাবে যখন দেড়যুগ চলমান তখন এক আন্দোলনে পালাতে হলো দেশজুড়ে ক্ষমতায় থাকা লাখ লাখ নেতাকর্মীদের। এই তালিকা থেকে বাদ পড়লো না ডাকসাইটে নেতা ও রাঘববোয়ালরা, নিখোঁজ হলেন তৃণমূলের কর্মীরাও। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। যদি ঘটতো সে তথ্যও নিশ্চয়ই থাকতো। অর্থাৎ, ২০২৪ সালের আগস্টের ৫ তারিখ যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা জেনে আপ্লুত হয়েছে রাজনীতি-গণতন্ত্র নিয়ে আগ্রহী পৃথিবীর শত কোটি মানুষ।

১৯৭১ সালের পর থেকে যে রাজনৈতিক দলগুলো দেশ শাসন করেছে তারা সকলেই একই পন্থা অবলম্বন করেছে। ক্ষমতায় বসার জন্য নানান তকমার ইশতেহার দিয়ে আশা দেখিয়েছে দেশবাসীকে। অথচ, প্রতিটি দলের নেতাকর্মীরা যখন ক্ষমতার অপব্যবহার শিখেছে তাদের আর তেমন ভালো কাজে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামদল কিংবা ধর্মীয় দলগুলোও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মত্ত হয়েছে। স্বৈরাচার দমনে বৃহৎ দলগুলো ঐক্যবদ্ধও হয়েছে, পতন ঘটিয়েছে। অথচ, এরপর যখন তারা ক্ষমতায় ফিরেছে; অতীত ভুলে গিয়ে, দেশের মানুষের সেবার শপথ ভুলে গিয়ে উন্নয়নের নাম করে দেশের বিপুল সম্পদ লুটপাট করেছে। বিদেশী ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রীক চিন্তায় মগ্ন হয়েছে অসৎ রাজনীতিবিদরা। সাধারণের সম্পদ লোপাট করে অন্য দেশে পাহাড় গড়েছে। অথচ, এই সম্পদ দেশে থাকলে সাধারণ মানুষের কত উপকার হতো। কিন্তু, হয়েছে বিপরীত।

এখন বৈদেশিক ঋণের বোঝা দেশের সকল মানুষের ওপর চেপেছে। উন্নয়নের নামে শত শত প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে যেখান থেকে লুট করা হয়েছে লক্ষ-কোটি টাকা। দেশের মানুষ স্বৈরাচার দেখেছে, রাজনৈতিক নেতাও দেখেছে। সরকারি আমলা দিয়েও দেশ পরিচালনা করতে দেখেছে। কিন্তু, এতগুলো বছর শেষেও কয়দিন আগেও দেখেছে অগ্নিঝরা রাজপথ, লাশের মিছিল। আওয়ামী লীগ সরকারও ক্ষমতা দখলের আগে জনমানুষের কল্যাণের নিমিত্তের ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। এরপর ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করে তারা ক্ষমতায় আসীন হয়। তকমা দেখিয়ে কয়েক বছর হয়তো জনকল্যাণ করেছে। কিন্তু, এরপর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তা দেশবাসীর সকলেই জানেন। ‘পুরোনো কাঁসুন্দি ঘাটলে এর ঝাঁঝ বৃদ্ধি পায় না’, উল্টো তা থেকে দুর্ঘন্ধ বের হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। দেশবাসির কল্যাণে তারা বিপুল প্রকল্প পাশ করিয়েছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, সমুদ্রের তলদেশে টানেল, স্যাটেলাইট, অসংখ্য পাকা রাস্তা, ভর্তুকি-প্রণোদনা ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়তো সত্যিই তারা জনকল্যাণে কাজ করেছে। কিন্তু, সাধারণ মানুষ তো অবকাঠামো দিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ করে না। তারপর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি-লুটের চিত্র ফুটে উঠেনি। 

মৌলিক চাহিদার প্রথমটি খাদ্য। বলা হয়েছিল, ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’। কিন্তু, তাই যদি হতো তাহলে সাধারণ আর ধনীশ্রেনির মানুষের এতো পার্থক্য কেন? একদল বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে টাকা শেষ করতে পারে না। অন্যদল টাকার অভাবে নিম্নমানের পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীও কিনতে পারে না। প্রথম যে শর্ত, সেই শর্তই পূরণ করতে পারেনি বিগত সরকার। অন্য যা আছে তার বিশ্লেষণ করলে চক্ষুশূল অবস্থা।
দেশের জাতীয়, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন নির্বাচনেও ভোট চুরিসহ নানা টালবাহানা হয়। অর্থের বিনিময়ে ভোট ক্রয়, খুন, মারধর, ভাংচুর, লুটপাটও অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার ছিল। জনসেবার স্বার্থে প্রার্থী নির্বাচন করার প্রক্রিয়া ও নির্বাচিত হওয়ার পরও সেবার নামে অনিয়ম, দুর্নীতি, চুরির ঘটনা ঘটেছে বছরের পর বছর। দেড় দশকে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থ সম্পদ যাদের ছিল তারাই ক্ষমতা দখল করেছে বারবার। এরপর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের অর্থ-সম্পদ হরিলুট হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু, সেদিন পিছনে পড়েছে, পালিয়েছে লুটপাটকারীরা। আর তাই, এখন আশার আলো দেখা সময়।

দুঃখে বিষয়, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসৎ আমলারাও অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সাব-রেজিস্টার অফিস, সমাজসেবা, অডিট অফিস; এসব স্থানে ঘুষ-দুর্নীতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে এখনও অনেক স্থানে মুখোশধারী ঘুষখোর রয়ে গেছে। মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েও তা রোধ করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি ঘুষবাণিজ্যও ‘ওপেন সিক্রেট’। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থলের বিড়াল বের হয়ে আসছে। আমলাদের সম্পদের হিসাব দাখিল করতে বলা হয়েছে যে সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। এখন সিদ্ধান্ত মোতাবেক তা বাস্তবায়ন করাই হবে উত্তম কাজ।

নির্বাচনের নামে সহিংসতার চিত্র নতুন কোন ঘটনা নয়। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, ককটেল বিস্ফোরণ এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মোহড়া দিতে দেখা গেছে বহুবার। গুলি করে, কুপিয়ে হত্যার চিত্রও পুরোনো। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে ইউপি সদস্য নির্বাচনের ভোটেও হাঙ্গামা লেগে থাকে। দায় নিয়ে বা না নিয়ে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য পদত্যাগ করেছেন। যদি তারা কাজে স্বচ্ছ, ন্যায়পরায়ণ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে নির্বাচন করতো তাহলে তাতে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকতো। যদিও প্রেস ব্রিফিংয়ে সে দায় দলগুলোর ওপরই দিয়েছে কমিশন। বস্তুত, আস্থা-বিশ্বাসের জায়গা তারা ধরে রাখতে পারেনি। যে কারণে পরপর কয়েকটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দায় নেওয়া বা না নেওয়া কমিশনের ব্যাপার। কিন্তু, যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায় না লোকসমাজে তা নিয়ে হৈ চৈ করার কিছু নেই। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর তারা অতীতের ঘটন-অঘটন বিচার করবেন বলেই বিশ্বাস সকলের।

একটি বিষয় পরিস্কার করা দরকার। তা হলো, সঠিক চর্চার অভাবে সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ববোধের জায়গা থেকে সরে এসেছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা। আগে যারা ত্যাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই দলের অনেকেই ক্ষমতার লোভে চোখে পর্দা লাগিয়ে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছেন। বিরোধীদের দেখভাল তো দূরের কথা, মামলা-হামলা দিয়ে তাদের ঘরছাড়া করে দেশান্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন, শীর্ষ নেতার পদ-দেশ ত্যাগের পর সবাই গর্তে ঢুকেছেন। কারও খোঁজ নেই। প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতা দখলে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অন্যায় করা সেই দলের কোন নেতাকর্মীকে পাওয়া যাচ্ছে না, রাঘববোয়ালরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তৃণমূলকে বিপদে ফেলে। এই-ই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ! যদি কিছুটা ভালো কাজও তারা করতো, হয়তো সাধারণ মানুষের মুখে ইতিবাচক দুই-একটা কথা অন্তত শোনা যেত। কিন্তু, তেমন হয়নি। প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে থাকা মানুষগুলোর মুখেও শুধু ধিক্কার।

বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে শুধু অর্থ-সম্পদ লুট করা হয়েছে। সাধারণের দুর্গতি এতই চরমে উঠেছে যে তা বলার জোঁ নেই। সবাই বলছে, উন্নয়নের নাম করে বিদেশ থেকে ডলার এনে তা লুট করে দেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে ঋণের বোঁঝা চাপানো হয়েছে। সেই অর্থ পাচার করে একাধিক দেশে বাড়ি বানিয়ে রেখে রাতারাতি পালিয়েছে নেতারা। এত চুরি তারা করেছে, যা পুকুর নয় সমুদ্র চুরির সামিল।

বিগত বছরগুলোতে জীবনমানের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্ব পরিক্রমায় বাংলাদেশ ‘মডেল’-এ রূপান্তর হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বলা হয়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু, যে পরিমান অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে, তাতে মাথাপিছু আয় বাড়ার সুযোগ কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর অর্থনীতিবিদদের কাছে পাওয়া যাবে। কিন্তু, সাধারণ মানুষের হাতে যদি পর্যাপ্ত টাকা থাকতো, চাহিদা অনুযায়ী যোগান নিশ্চিত করা হতো তাহলে বোঝা যেত যে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু, চিত্র উল্টো। এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে সবকিছু নতুন করেই সাজাতে হচ্ছে। ঋণের বোঁঝা ঘাড়ে নিয়েই দেশ সংস্কার করতে হচ্ছে। এখন ভালোয় ভালোয় মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলেই মঙ্গল। স্বাভাবিক এই কারণে বলতে হচ্ছে, অর্থ লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর যে বিদ্ধস্ত অবস্থা, তাতে সাধারণ মানুষ অস্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করছে। এখনো অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা।

আসলে যারা প্রকৃতঅর্থে জনসেবা দিতে আগ্রহী তাদেরই ক্ষমতায় দেখতে চায় দেশবাসী। নীতি-নৈতিকতা বর্জন করে প্রতারণা-মিথ্যাচার করা কোন ব্যক্তি যেন ক্ষমতার চেয়ার আর বসতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে নতুন সরকারকে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রার্থী বাছাইয়েও সংস্কার জরুরি। এত সম্ভাবনার দেশে মানুষ কেন হাহাকার করবে? কয়েকজন মানুষ দেশের অঢেল সম্পদ লুট করলো, আর ক্ষমতাসীন বড় চেয়ারধারীরা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, কিছুই করলো না। পরে তো ঠিকই কেঁচো খুড়তে সাপ বের হলো। দেশের যুবসমাজ; যারা এক লাখ টাকা হলেই উদ্যোক্তা হতে পারে, তাদের ঋণ দেওয়া হলো না। অথচ, হাজার হাজার কোটি টাকা গ্রাস করলো এক-দুই কোম্পানি। যে কারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল অতি প্রত্যাশিত। এখানে কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। শিক্ষার্থী আর দেশের সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনের ভিত ছিল। সে সুফল এখন থেকেই পেতে শুরু করেছে সকলে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলেই বিশ্বাস।

একচেটিয়াভাবে বিগত কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে। কুশপুত্তলিকার মতো বিরোধীদল সাজানো হয়েছে। নামে নির্বাচন হলেও সে উৎসবে সামিল হতে পারেনি সাধারণ মানুষ। শক্তিশালী বিরোধীদলও ক্ষমতাসীনদের কারচুপি, অন্যায়, মামলা-হামলা-খুনের ভয়ে রাজপথে নেমে হেনস্তার শিকার হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে নামতেই পারেনি। যদি বিশ্বাস করা যেত, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাহলে কোনদলই নির্বাচনের বাইরে থাকতো না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্ষমতাসীনদের ভুলত্রুটিগুলো কেবল তাদের চোখেই পড়ে। কিন্তু, পরপর কয়েক নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধীদের এমনভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে যে, তারা মুক্তি পায়নি। ভালো-মন্দ নিয়ে কোন কথাও বলতে পারেনি। অন্যদিকে, একের পর এক ক্ষমতাকে আলাদীনের চেরাগ বানিয়ে নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করেছেন ক্ষমতাসীনরা। তাতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন হলো কি হলো না তা তাদের দেখার বিষয় ছিল না। 

এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কত জলঘোলা হলো। বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের দাবিতে বেশ কিছুদিন আন্দোলন-বিক্ষোভ চালিয়ে গেল। কিন্তু, তাতেও কোন ধরণের ভ্রুক্ষেপ করেনি বিগত ক্ষমতাসীনরা। তারা সময় অনুযায়ীই নির্বাচন দিতে সক্ষম হয়েছে। একতরফাভাবে বিজয়ের পর মন্ত্রীসভাও গঠিত হয়েছে। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু, তা আর হলো না। একই ধাঁচের মন্ত্রীপর্ষদ দেখলো দেশবাসী। সাধারণ মানুষ তো কোন কথাই বলতে পারলো না বরং পুলিশ-আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করে সব পক্ষের মুখ বন্ধ করে রাখা হলো। সাইবার আইনের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাকস্বাধীনতাও। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হলো আওয়ামী লীগের স্নেহভাজন ও চাটুকারদের। প্রতিটি প্রকল্পেই অবাধে করা হলো লুটপাট। নামমাত্র উন্নয়ন হলো, বাড়তে থাকলো দুর্ভোগ। এক সময় তা পৌঁছে গেল চরমে। 

এ বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পুরোনো প্রায় সকল চিত্র উল্টে গেল। অনিয়মকারীরা পালিয়ে গেল। যারা পারলো না তাদের হতে হলো শিকলবন্দী। এখন এরাই বিচারের মুখোমুখী। আর যাই হোক, অন্যায় করলে আজ অথবা কাল বিচারের মুখোমুখী হতেই হবে, এই-ই বিধান। 
বিগত সময়ে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই কোন না কোন পর্যায়ে মড়িয়া হয়েছেন। যে বা যারা তাদের নিয়ে বিরোধপূর্ণ কথা বলেছেন গুম-খুন হওয়ার ভয় তাদের সব সময় পিছনে পিছনে ছিল। আয়নাঘরের যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা থেকে শত শত ইতিহাস বের হয়ে আসছে। কথা বলা বা বাকস্বাধীনতা এতদিন কোথায় ছিল? কেউ ভয়ে এ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেনি। আর যে তুলেছে তার কপালে জুটেছে অসংজ্ঞায়িত অত্যাচার। ভোগান্তির শিকার হয়েছে প্রতিবাদী মানুষগুলো। 

নিরাপত্তাহীনতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সম্পদহানি, খুনের মতো ঘটনা ছিল নিয়মিত। লোকচক্ষুর অন্তরালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশটা তাদের নিজস্ব সম্পত্তি মনে করেছে। একেকজনের নামে যে লুটপাটের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা ভয়ানক। একজন কর্মচারী হয়ে কিভাবে এত সম্পদ তারা লুট করেছে তা অজানা নয়। চোরের দোসর চোর। যারা পালিয়েছে তারা সকলেই একজন আরেকজনের আত্মীয়, সম্পর্কে অথবা দুঃসম্পর্কে।

নিত্যপণ্যের বাজার, তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ; বিগত সরকারের লোকজন এহেন কোন জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি-অনিয়ম করেনি। অন্যদিকে, বিরোধীপক্ষ যখন তাদের কাজে ভুল ধরেছেন তখনই তারা গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। এদেশের রাজনীতিতে যেন কারও ভুল ধরিয়ে দিতে মানা, অন্যায়! দীর্ঘ বছর মামলা, হামলা, জীবন নিয়ে শঙ্কা ছিল অবধারিত। টানা প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যে নিগ্রহের শিকার হয়েছে পৃথিবীর অন্য দেশে এমন কোন নজির আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার, বড় দলের নেতাদের সঙ্গে মিটিং ও যোগসাজস করেও বিরোধী ‘ডামি দল’ বানানো হয়েছে। 

সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। এরপর যাদের হাতে ক্ষমতা যাবে তারা যেন দেশ তথা দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে হেলাফেলা না করে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে সংবিধানে নুতন বিধান ও আইন যুক্ত করতে হবে। অন্যায় ধরা পড়লে বিধি অনুযায়ী তদন্ত করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেকটি কাজের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোও অতি জরুরি। যে কোন প্রকল্প পাশ করার আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনমত নিতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি কাজ যেহেতু সাধারণ মানুষের কল্যাণের নিমিত্তেই হয়, তাই ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলতে তাদের অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি জরুরি। সবকিছু ছাপিয়ে এখন নিত্যপণ্যের মূল্য কমানো, জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; সর্বপরি দেশের সার্বিক মঙ্গলের লক্ষ্যে কাজ করাই নতুন সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। তারা সেই চেষ্টাই করবেন বলে বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ।

আমলাদের দুর্নীতিও আলোচিত ইস্যু। চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস কিংবা ঘুষ-অনিয়ম করে যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের দিয়ে ভালো কিছু আশা করা দুষ্কর। তারাই কর্মচারী হয়ে, নাগরিক সুবিধা দিতে এসে অন্যায্য দাবি করেন। ঘুষ খেয়ে আমলাদের আত্মীয়-স্বজনও ফুলে-ফেঁপে। প্রশাসনের অনেক কর্মচারীই অবাধে দুর্নীতি করে লুট করেছেন পাহাড়সম সম্পদ। এককালে যিনি বছরের পর বছর পদপ্রাপ্ত হয়েছে, তিনিই প্রমোশন পেতে পেতে চূড়ায় উঠেছেন। যিনি ছিলেন অন্য কর্মচারীর আদর্শ, তিনিই খোদ দুর্নীতিতে জড়িয়ে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক বনেছেন। অতঃপর সেই দলের অনেকেই ছেলে-মেয়ে বউ নিয়ে দেশান্তর হয়েছে। কিন্তু, সময় বদলে গেছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মে যারা নিয়োজিতদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা জরুরি। দেশটা সাধারণ মানুষের। এরা যেন কোনভাবে-কোন কারণেই বঞ্চিত না হন; তা আমলাদের কাজের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে।

মূলত ক্ষমতাধর শীর্ষ অসৎ ব্যক্তিরাই দুর্নীতি-অপকর্মের মূল হোতা। অসুবিধা হচ্ছে- কে সৎ আর কে অসৎ তা খুঁজে বের করা যা অত্যন্ত কঠিন। এতকাল যে অন্যায় করেছে, আর যে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিল তাদের যোগসূত্র বা মিল দেখা গেছে। যারা সততার সঙ্গে কাজ করেছে তাদের কোথাও যেতে হয়নি। এমনকি তাদের গায়ে কেউ একটু আচড়ও দেয়নি। অর্থাৎ, সৎ-যোগ্য মানুষগুলো স্বপদেই বহাল আছে। কিন্তু, জটিলতা হচ্ছে, এর ভিড়েও অনেক অসৎ মানুষ মুখোশ পড়ে আছে। একটু খোঁজ নিলেই সবার তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব। নতুন সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে বলেই বিশ্বাস। কারণ, সবাই স্বস্তি চায়। একটু ভালো থাকার আশ্বাস চায়। গুটিকয়েক অসৎ মানুষের জন্য লক্ষ-কোটি মানুষ যেন সুবিধাবঞ্চিত না হন সে বিষয়টি ভাবাও অত্যন্ত জরুরি।

দেশটাকে লুটের রাজ্যে পরিণত করে, অঢেল সম্পদ চুরি করে যারা পালিয়েছে তারাও হয়তো আবার দেশে ফিরবে। কিংবা তাদের আর না ফিরলেও চলবে; কিন্তু, যারা দেশে অবস্থান করছেন তাদের নিয়ে ভাবাই যৌক্তিক। রাজনীতি যে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য নয় তা পরিস্কার করার সময় এসেছে। ত্যাগী মানুষ ক্ষমতায় বসলেই কেবল দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। একই সঙ্গে অপরাধ করে ধরা পরার পর উপযুক্ত সাজা পাওয়ার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আনতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতাও অনেক। তাদেরও উচিৎ এজাতীয় ব্যক্তি যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তা নিশ্চিত করা। কারণ, আমরা দেখেছি বিগত সময়ে যারা ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই অনিয়মকারী। এই দলে নীতিবান মানুষের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ অতীতের পুনরাবৃত্তি চায় না।

যে গণতান্ত্রিক দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা শক্ত, আইনের যথাযথ প্রয়োগ বিদ্যমান, স্বচ্ছতা-জবাদিহীতা যেখানে প্রত্যক্ষ, সেখানে দুর্নীতি-অপকর্ম অনেক কম। পক্ষান্তরে দুর্বল প্রশাসন, অদক্ষ জনবল, অসৎ উদ্দেশ্য, ঘুষ দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া; ইত্যাদি কারণে দুর্বল হয় রাষ্ট্রযন্ত্র-প্রশাসন। এদের দিয়ে আর যাই হোক স্বচ্ছ এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আশা করা দুষ্কর। অন্যায়-অপকর্মের মাধ্যমে যারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে তা বাজেয়াপ্ত করার সময় এসেছে। এখনই অসৎদের শাস্তি দেওয়ার উপযুক্ত সময়। যাদের দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দিয়ে লাল তালিকাভুক্ত করতে হবে। সুযোগ হলে দেশে ফিরিয়ে এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। সম্পদ বাজেয়াপ্তের পর যোগ্যদের তা বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে অল্প সময়ে তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করতে হবে। মোদ্দা কথা, কাজ দিয়ে তাদেরই প্রমাণ করতে হবে যে, প্রতিষ্ঠানটি ‘নখ-দন্তবিহীন’ নয়। কারণ, এই কমিশনের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। 

সবশেষে বলতে হয়, দেশের সম্পদ জনগণের। লুটপাট কিংবা বিদেশে পাচার যা হওয়ার হয়েছে। এখন তা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যা আছে সেখান থেকে একচুলও যেন আর নষ্ট না হয় তার নিশ্চয়তা দিতে হবে ক্ষমতাধরদের। জনসম্পৃক্ত যেকোন বিষয় পরিস্কারভাবে জানার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহীতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রকাশ্যে আনতে হবে প্রতিটি উন্নয়নকর্মের চিত্র। আসন্ন দিনগুলোতে দুর্নীতি-অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে না পারলে কোনভাবেই সাধারণের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। এজন্য মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বচ্ছতা অতি জরুরি। যারা পাপের অর্থে ভর দিয়ে জীবন পার করছেন, তাদের জানা প্রয়োজন; ‘পাপ বাবা কেউ ছাড়ে না’। আর, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অঢেল সম্পদ নয়, দরকার উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(prosenjit8000@gmail.com)

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: