দায় ফ্যাসিস্টের ঘাড় অন্তর্বর্তীর
ওনার মানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কোনো চাওয়া-পাওয়া’ ছিল না! বাংলার মানুষের মুখে ‘হাসি ফোটানোই’ ছিল তার একমাত্র চাওয়া। তিনি ক্ষমতা চান না, ক্ষমতার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই- এ কথাও শুনিয়েছেন শত শত বার। বাস্তবটা একদম তার বিপরীত। তিনি আসলে ক্ষমতাই চেয়েছেন। তাও এবসলিউট ক্ষমতা। তা অর্থে-বিত্তেও। রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাত ও পাচার বিষয়ক কমিটি শ্বেতপত্র কমিটি এর কিছু তথ্য উদ্ধার করেছে। সেখানে গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের ৪০ শতাংশ অর্থই আমলাদের লুটপাটের কথা আছে।
এর আগে, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলয়ের মধ্যে থাকা সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ছয় হাজার কোটি টাকা পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার ও বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। তার পরিবারের কয়েক সদস্য ও নিজস্ব ঘরানার কয়েক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে এসব অর্থ। রিপোর্ট বলছে, এই ব্যক্তিদের নামে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল অট্টালিকা পর্যন্ত রয়েছে। এই সম্পত্তির বেশিরভাগ কেনা হয়েছে যুক্তরাজ্য ও দেশটির বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এ রকম একটা অবস্থার মাঝে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের স্বগতোক্তি লুটপাটকারীদের সম্পদ অধিগ্রহণ করতে না পারলে কিসের বিপ্লব?
সত্যিইতো লুটপাটকারীদের বিচার করতে না পারলে কিসের বিপ্লব! পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা বা লুটপাটকারীদের বিচার কি আসলে সম্ভব? পাচারকারীদের নাম এবং তারা একেকজন যে পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে তা সর্ব সাধারণের সামনে প্রকাশ করলে মানুষ অন্তত তাদের বদনখানি দেখতো। আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় শেখ পরিবারের একজন সদস্যও পাকড়াও হয়নি। তারা আগেভাগে চলে গেছে না তাদেরই পাচার করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে? নিস্পত্তিহীন এ প্রশ্নের মাঝেই বিপ্লবের চেতনা নিয়ে কোনভাবেই আপাতত আর নতুন টাকা ছাপানো হবে না বলেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু তিনি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দুর্বল ধসে পড়া ব্যাংকগুলোকে বাইশ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা ছাপিয়ে কথিত 'তারল্য সহায়তা' দিলেন। সেই সাথে বললেন,প্রয়োজনে আরও টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়া হবে।
ভালোমানের ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ব তারল্যের একটি অংশ ধার হিসেবে দিয়ে এর আগে সহায়তা করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু বিষয়টা অর্থ উপদেষ্টা পছন্দ করেননি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন,ঋন দেয়া টাকাটাও তো এই ব্যাংকগুলো খেয়ে ফেলবে? তখন কি হবে? এ প্রশ্নের ফয়সালার আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তা কতটা সঙ্গত হলো ? এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। পরিণতিতে এরইমধ্যে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর জেরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে মন্দা ভর করেছে। দ্রব্যমুল্য বেড়ে গেছে। সেইসাথে খেলাপি ঋণ বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে। এখন এইভাবে নতুন করে টাকা ছাপানোর কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ছে বাড়ছে অবস্থা। বিগত সরকারের শেষদিকে এইভাবে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছিল। যার সিংহভাগে থাবা বসিয়েছেন প্রভাবশালীরা। ঋণের নামে এ টাকা তুলে পাচার করেছেন তারা। সেই ব্যাংকগুলোর দায় এখন সরকারের ঘাড়ে। আবার এসব ব্যাংককে রক্ষাই সরকারের উদ্দেশ্য হলে এতো কথা কেন? বিগত সরকার ও সরকার দলীয় দুর্বৃত্তদের দোষারোপই বা কেন? টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে কেন এদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে? এই টাকাগুলো আবার যে লুটপাট হবে না, পাচার হবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতির শীর্ষে ছিল ব্যাংকিং খাত। মন্দঋণ দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু বা ১৪টি মেট্রোরেল করা যেত, - এমন তথ্য শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির। সরকারি ব্যয়ের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ তছরুপের তথ্য দিয়ে কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, চুরি-দুর্নীতিতে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদেরও ছাপিয়ে গেছে আমলারা। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে রূপ নেয়া দুর্নীতি রোধে সরকারকে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ তার। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সংস্কার বিপদসংকুল হয়ে পড়ার সমূহ শঙ্কা ঘুরছে। অর্থনীতি না জানা না বোঝা ব্যক্তিরাও জানেন, টাকা ছাপালে অবশ্যই টাকা সরবরাহের কারণে মূদ্রাস্ফীতি বাড়ে। আর সুদের হার বাড়লে ব্যবসাহিক খরচ বেড়ে উৎপাদন কমবে, বেকারত্ব বাড়বে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এসবের যোগফলে বেকারত্ব অবধারিত। ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাওয়াও স্বাভাবিক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/এআই
মন্তব্য করুন: