‘একটি ক্যাডারের কাছে দেশ-জাতি জিম্মি থাকতে পারে না’
নাসির উদ্দিন
অসম্ভব সাহস আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্ত আজো মিশে আছে বাংলার মাটিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল এক বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। কিন্তু এর বদলে সম্পদের কেন্দ্রীভবন, সামরিক–বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র, লুটপাট এবং অবিচারের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল প্রিয় মাতৃভূমিতে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও স্বাধীনতার মূলচেতনা বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে পারনি আমরা।তাই ২০২৪-এ এসে কোটা আন্দোলনে নেমে শহীদ হন অনেকে। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফারহান, রাহাতদের মতো হাজারো তরুণের রক্তাক্ত দেহ কাঁধে নিতে হলো এই জাতিকে। ২০২৪এর এই রক্ত অধিকতর শোকাতুর করেছে আমাদের। কারণ ঘাতকের বুলেট আমাদের টাকায় কেনা, আর গুলি ছুড়েছেন আমাদের শাসক। ফ্যাসিস্ট শাসক রাষ্ট্রের সকল কাঠামোকে ভেঙ্গে জনগণের রাষ্ট্রকে লুটেরা কিছু লোকের রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এখন প্রয়োজন তার মৌলিক পরিবর্তন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট সংবাদ মাধ্যমে আসলো সেদিন। তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রয়েছে সংস্কারের জন্য। সেখানে একটি প্রস্তাব হচ্ছে-বিসিএস সাধারণ শিক্ষা এবং স্বাস্থ ক্যাডারকে ক্যাডার কাঠামোর আওতার বাইরে নিয়ে আসা। এছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে। এছাড়া সরকারি উপসচিব তদুর্ধ পদগুলোতে কোটা প্রথার পুন:বিন্যাস প্রস্তাব। শুধু প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ রেখে বাকি ২৫ ক্যাডারের জন্য মেধার ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ।
দেশে ৬০ হাজারের অধিক ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন। স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সবচেয়ে বড় দুটি ক্যাডার।এই দুটিকে আলাদা করার চেষ্টা চলছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মিলেই আছেন ৫০ হাজার।জনপ্রশাসনকে করায়ত্ত করতে সবচেয়ে বড় বাধা এই দুটি ক্যাডার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানকে তারা হুমকি দিচ্ছেন। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।কি করে নামাতে হয় তাদের নাকি জানা আছে। এটি ফ্যাসিস্ট সরকারের ভাষা। এটি ক্যাডার সার্ভিসের ভাষা হতে পারে না। ক্যাডার সার্ভিসের সমতা বিধান যুক্তিযুক্ত। কোটা প্রথা তুলে দেয়া দরকার। রাজতন্ত্র, দাসতন্ত্র থেকে দেশকে মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
মেধার মাধ্যমে যোগ দিয়ে পরে কোটায় যাচ্ছেন তাঁরা। ঐতিহাসিকভাবে প্রচণ্ড বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার প্রশাসন ছাড়া অপর ২৫ক্যাডারের সদস্যরা। রক্তঝরা বাংলাদেশে রক্তের উপর দাঁড়িয়ে একটি পক্ষ বলছে তারা ছাড়া কেউ উপসচিবের উপরের পদগুলোতে যেতে পারবেন না। তাদের জন্য শতভাগ কোটা সংরক্ষণ করতে হবে। নাগরিকরা মনে করেন,হাসিনা সরকারের সাথে তাদের ছিল অনৈতিক দেয়া-নেয়ার ডিল। সেই সুবাধে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর ভোটারবিহীন নির্বাচনগুলোতে ন্যাক্কারজনকভাবে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। তাদের কলমের খোচায় ৩শত ভোট, কখনো ৩হাজার, ৩০ হাজার বা কখনো ৩ লাখ দেখানো হয়েছে। ওই পক্ষ আবার ঝেকে বসেছে। তারা বলছেন, নতুন বাংলাদেশে অতো সংস্কার মানবেন না, তাদের শতভাগ কোটা চাই।
কোটা হচ্ছে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। যারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।দূর্ভাগ্য আমাদের সবচেয়ে সুবিধাভোগী একটি পক্ষ তারা এখনো কোটা চাচ্ছে ।এর কারণ একটাই রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে সচিবালয় থেকে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত। তারা নিজেদের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবেন। জনগণের টাকায় প্রভু পোষা হচ্ছে। সচিবালয়ে কারো সহজ প্রবেশাধিকার নেই। তাই তৈরী হয়েছে দালাল শ্রেনী। বৃটিশ-পাকিস্তানি ভাবধারায় চলছে জনপ্রশাসন। তাই উপসচিব থেকে উপরের পদগুলো কোটার পরিবর্তে মেধার মাধ্যমে পদায়নে সমস্যা দেখছে ক্যাডারটি।
কৃষকের দেশ, শ্রমিকের দেশ বাংলাদেশ। কাদের শ্রমের টাকায় আমরা প্রভু লালন করছি। রাজনীতিবিদরা তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বিশেষ ক্যাডারের সাথে করে দেয়া-নেয়ার ডিল। তাদের এই ডিল তারা যুগে যুগে অব্যাহত রেখেছে। নাগরিকরা এর অবসান চান। সাম্যের কথা, বিজ্ঞানের কথা, প্রযুক্তির কথা হলো- পেশা যার, মন্ত্রণালয় তার।
প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের নিউক্লিয়াস হলো ক্যাডার সার্ভিস সমূহ। তার উপরে রয়েছে সরকারের সুপরিয়র সার্ভিস। যা উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারের নির্দিষ্ট সেক্টরের পরিকল্পনা গ্রহণ, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্যাডার সার্ভিস গঠিত হয়। একটি ক্যাডারভুক্ত সদস্যরাই অভিজ্ঞতা অর্জন ও পদোন্নতির মাধ্যমে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত যাওয়ার অধিকারী হবেন।
দুঃখজনক হলো-আমাদের দেশে প্রতিটি সেক্টরে নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন শুধু প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা। জনকলাণমূলক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পেছনে এটি মূল অন্তরায়। ক্যাডারগুলোর মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল বৈষম্য তৈরী হয়েছে। তাই দেশের সফলতা এখন জাল পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবব্ধ।
সরকারের কাছাকাছি থাকার সুবাদে সকল ক্যাডারকে অবহেলিত করে প্রশাসন ক্যাডার সরকারের কাছ থেকে অধিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। ২০১৫ এর পে স্কেলে কেবলমাত্র উপসচিবের গাড়ি কেনার জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা ধার দেয়া এবং সেই গাড়ি পরিচালনায় মাসিক ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। নিজেদের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনৈতিক সুবিধা দেয় প্রশাসন ক্যাডার। দিনের ভোট রাতে হওয়া তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিশেষকরে পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ক্যাডার মন্ত্রণালয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে। যেখানে অন্যদের সেই সুযোগ নেই। তাদের পোস্ট না থাকার পরও পদোন্নতি হয় দ্বিগুণ, তিনগুণ। অন্য ক্যাডারের পোস্ট থাকা সত্বেও পদোন্নতি হয় না। প্রশাসন ক্যাডারের সবাই এক ব্যাচে একইসাথে পদোন্নতি পেলেও পদ খালি থাকার পরও ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হয় না অন্যদের। গাড়ির প্রাধিকার। উপসচিব পদের সবাই গাড়ি পাচ্ছে, লোন পাচ্ছে, সাথে সাথে রক্ষনা-বেক্ষণ খরচ পাচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। প্রশাসনের মতো অন্য ২৫ ক্যাডারও একই সুযোগ সুবিধা চান উপসচিব লেভেলের কর্মকর্তারা। কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে মেধা যোগ্যতা প্রজ্ঞা দিয়ে কাজ করতে চান তারা।
দেশে বিরাজমান ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে মাত্র একটি ছাড়া ২৫টি ক্যাডারের চাকরিজীবীরা প্রচণ্ড বঞ্চিত ও চরম বৈষম্যের শিকার। মেধাভিক্তিক সাম্যের বাংলাদেশ চাইলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য অবশ্যই নিরসন করতে হবে।একটি ক্যাডারের কাছে পুরো দেশ-জাতি জিম্মি থাকতে পারে না।বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে ফ্যসিস্টের সহযোগী ও প্রধান সুবিধাভোগী প্রশাসন ক্যাডার।
সংস্কার নয়,সবেমাত্র প্রস্তাব। সেটাও পেশ হয়নি।তাতেই কমিশন প্রধানকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটাম! যে কোটার জন্য ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। সেই কোটা লালন করতে চান কেন তারা? আমরা বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশে কোন বৈষম্য চাই না।সকল ধরণের ক্যাডারের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: