• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সেন্ট মার্টিন্স নিয়ে একটি স্বাপ্নিক পরিকল্পনা

ড. মাহবুব হাসান

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
সেন্ট মার্টিন্স নিয়ে একটি স্বাপ্নিক পরিকল্পনা

গত ডিসেম্বরে কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন্স-এ বেড়াতে গিয়েছিলাম সপরিবারে। বহু আগে কক্সবাজারে গেলেও সেন্ট মার্টিন্সে যাওয়া হয়নি। এখন মনে পড়ছে, না যাওয়ার কারণ। তখন সেখানে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। শুনেছিলাম ট্রলারে করে বা ছোট আকারের লঞ্চ-এ করে যেতে হতো। সেগুলো নাকি বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে এগোয় সেন্ট মার্টিন্সের দিকে। যাত্রীরা অনেকেই বমি করে ভাসায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেকে। ফলে ভ্রমণের যে আনন্দ ও স্বাদ, তা থাকে না। এই ভয়েই আমি এতোকাল সেন্ট মার্টিন্সে বেড়াতে যাইনি। এর সংগে ছিলো সামর্থ্যরেও প্রশ্ন।

এবার ভ্রমণের দায়-দায়িত্ব ছিলো আমার ভাতিজা মিশু ও আমার ছেলে অন্তুর ওপর। আমি নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরছি জেনেই মিশু-অন্তু বেড়ানোর প্ল্যান করে। জেনে খুশি হলাম, নিউ ইয়র্কের গৃহবন্দী জীবন থেকে দেশে ফিরেই সেন্ট মার্টিন্সের মতো চোখজুড়ানো দ্বীপে যাবো। ভাবতেই গায়ে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠেছিলো। দুই ডিসেম্বর ভোরে নেমেছি। ঘুমালাম কয়েকদিন। ১২ তারিখ রাতে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম।

মিশু-অন্তুই সব কিছু ম্যানেজ করেছে। চৌদ্দ জনের [আমার, আমার বোন ও মেজভাইয়ের পরিবারের এবং ছোটভাই বাবু'র বড় ছেলে ও তার স্ত্রী মিলে ওই সংখ্যা] ভ্রমণের ব্যবস্থা অতো সহজ হয়নি। প্লেন, বাস ও নিজেদের গাড়ি মিলিয়ে আমরা কক্সবাজার পর্যন্ত গিয়েছি। এরপর বড় জাহাজে করে সেন্ট মার্টিন্সে পাড়ি জমানো।

কক্সবাজরের চেহারা এতো বিপুলভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি। এক ধরনের আনন্দ যেমন লাগছিলো, তেমনি না বুঝে ওঠার কারণে বেদনাও জাগছিলো মনে। পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল তো আগেও ছিলো, এখন আরও বড় মাপের তারকাবিশিষ্ট হোটেল হচ্ছে। তারকাবিহীন কিন্তু বড় আকারের হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় ভরে গেছে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল। মান কতোটা বেড়েছে বলতে পারবো না, তবে পৃথিবীর সব ট্যুরিস্ট স্পটের মতোই কক্সবাজারের হোটেল রেস্তোরাঁগুলোর খাবারের দাম আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে যে সার্ফিং হয়, জানা ছিলো না আমার। আমরা একটি সার্ফিং ক্লাবে উঠেছিলাম। সেটা ছিলো বীচ-এর সামনে। আমরা দোতলায় বসে বে অব বেঙ্গলের ঢেউগুলোর আছড়ে পড়া ও তার গর্জন শুনেছি কয়েকদিন।

সেন্ট মার্টিন্সে আমরা গিয়েছি আটলান্টিক ক্রুজ নামের বিশাল জাহাজে করে। তবু যাত্রা তেমন সুখকর হয়নি। কারণ, সাগরের ঢেউ। যাওয়া ও আসার সময় মিশু'র মেয়ে সাফওয়ানা বমি করেছে। আমার ভাগ্নি মিত্রা'র কাহিল দশা দেখে সত্যি কষ্ট পেয়েছি। অদ্রি'র স্ত্রী মিয়ানের অবস্থাও ছিলো ক্লান্ত, করুণ। তবু আনন্দ আহরণই যেখানে মূল লক্ষ্য, আমরা সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে টিকে থেকেছি ঢেউয়ের বিরুদ্ধে।

কিন্তু জাহাজ থেকে নেমেই হতাশ হলাম। মনে হলো, এটি কোনো ট্যুরিস্ট স্পষ্ট নয়, একটি ঘিঞ্জি বসতি এলাকা। যে সড়কগুলো তৈরি করা হয়েছে, সে পথে দু'টো রিকশা বা ভ্যান কোনোমতে চলতে পারে। পুরো সেন্ট মার্টিন্স অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে পর্যটনের জন্য। এটাকে কেউ পর্যটন এলাকার মর্যাদা দেবে না। পর্যটকদের থাকার জন্য গড়ে ওঠা হোটেল, মোটেল এবং রিসোর্টগুলোও যেন এলোমেলোভাবে তৈরি করা হয়েছে। যে যেখানে পেরেছে, বিল্ডিং তৈরি করে ব্যবসা খুলেছে। মনে হয়, কোনো একসময় এখানে 'জোর যার মুল্লুক তার'- এমন কৌশলে যে যেখানে পেরেছে জায়গা কিনে হোটেল বা রিসোর্ট গড়ে তুলেছে। 

প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন্স যে এতোটা অবহেলার শিকার তা জানা ছিলো না। আগে, শাদা কোরালের যে সমাহার টিভির পর্দায় দেখেছিলাম, তার চিহ্নও নেই দ্বীপে। কালো কোরালের দেখা মেলে ছেঁড়াদ্বীপ-খ্যাত এলাকায়। সেটা সেন্টমার্টিন্স থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জোয়ারের সময় আসা-যাওয়ার পথ ডুবে যায় বলে স্থানীয়রা নাম দিয়েছে 'ছেঁড়া দ্বীপ'। আগে এর নাম ছিলো জিঞ্জিরা নারকেল দ্বীপ। দ্বীপজুড়ে ছিলো নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। পামও চোখে পড়লো আমার। আরও নানান শ্রেণি ও জাতের গাছপালা আছে, অবশ্য তা ভালো জানে বন ও পরিবেশ অধিদফতর।  ইদানীং একটি বিজ্ঞাপন দেখছি বিভিন্ন টিভিতে। সেন্ট মার্টিন্সের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা ও তা রক্ষণাবেক্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার বর্ণনা রয়েছে সেই অডিও-ভিডিও চিত্রে। ট্যুরিস্টদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তারও বর্ণনা আছে সেখানে। সী-বীচের উন্নয়নের কথাও তাঁরা বলছেন। এ থেকে বুঝা যায়, পরিবেশ ও বন অধিদফতর পর্যটনপ্রিয় এই দ্বীপের ব্যাপারে খুবই সজাগ ও কর্মতৎপর।

বেড়াতে না এলে হয়তো বিশ্বাস করতাম সরকারের ওই দফতরের কর্মতৎপরতা বিজ্ঞাপননির্ভর নয়, বাস্তব ও সরকারের প্রত্যাশার প্রতিফলন সেখানে পড়েছে। কিন্তু আসলে তা বকওয়াজ। তাদের কর্মতৎপরতার ছিটেফোঁটা মিললো সংকীর্ণ সড়কগুলোর মোড়ের সাইনবোর্ডে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সাইনবোর্ড দেখলাম, কিন্তু তাদের দেখলাম না। কেবল সী-বীচে, জোয়ার ভাটার সময় কয়েকজন বীচ-কর্মীর তৎপরতা চোখে পড়লো।

আমরা কি জানি এই কোরাল দ্বীপ কতো বড়? উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, এটি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট প্রবালদ্বীপ। সেন্ট মার্টিন্স কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার  উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। এই প্রবাল দ্বীপের আয়তন মাত্র ৩ কিলোমিটার।

প্রবাল দ্বীপটি যে টেকনাফ থেকে এতো কাছে, তা যাওয়ার সময় বুঝতে পারিনি। কারণ হয়তো এটাই যে, আমরা কক্সবাজার থেকে জাহাজে করে সেখানে যেতে লেগেছে সাত ঘণ্টা। শুনেছি টেকনাফ থেকে যেতে লাগে দুই বা তিন ঘণ্টা। মাইলের হিসাবে দ্বীপটি পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মাইল দূরে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য দেখার মতো, উপভোগ করার মতো। ট্যুরিস্টদের কাছে ছোট প্রবাল দ্বীপটিকে প্রধান আকর্ষক করে তোলা যায়। সেটা করা হলে দ্বীপটি হয়ে উঠতে পারে পর্যটন শিল্পের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। তিন কিলোমিটার লম্বা হলেও সেন্ট মার্টিন্সের চারদিকেই আছে বালুকাবেলা বা বীচ। বীচ ম্যানেজমেন্ট কীভাবে করতে হয় এবং হবে, তা আমাদের এই খাতে জড়িতরা বুঝতে পারবেন।

এই দ্বীপ নিয়ে আমি একটা পরিকল্পনা জানাতে চাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
 
১. গোটা দ্বীপটিকে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে আনতে হবে।
২. এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য একটি জায়গায় কনসেনট্রেট করে তাদের জন্য গৃহ নির্মাণসহ পুনর্বাসন করতে হবে। অথবা কক্সবাজার জেলায় পুনর্বাসিত করতে হবে। পরিকল্পনায় তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৩. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটনে ইনভেস্ট করতে আগ্রহীদের কাছ থেকে চিঠি আহ্বান করতে হবে।
৪. মূল প্ল্যানের মধ্যে খাতওয়ারি বিভাগ করে তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে। যেমন- হোটেল ও মোটেল খাত। সী-বীচ খাত, এই খাতে নানান উপ-খাতও থাকবে।
৫. গোটা প্রবাল দ্বীপের সড়ক ও জনপথের ডিজাইন, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।
৬.একটি ছোট হেলিপ্যাড নির্মাণ করে পর্যটকদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে হবে। দেশের যেকোনো জায়গা থেকে যেন পর্যটকরা আসতে-যেতে পারেন। কক্সবাজার এবং টেকনাফ থেকেও কপ্টার সার্ভিস করতে হবে। বছরব্যাপী যাতে পর্যটকরা এখানে আসতে পারেন, সেই কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। অ্যামিউজমেন্টের জন্য যতোরকম পর্যটনপ্রিয় ব্যবসা-ব্যবস্থা করা যায়, তার আয়োজন করলেই দ্বীপটি পৃথিবীর ভ্রমণ পিপাসুদের এখানে টেনে নিয়ে আসবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা মালদ্বীপকে দেখতে পারি।
৮. বছরজুড়ে যাতে এখানে পর্যটক আসে আনন্দ বিনোদনের জন্য; তার সার্বিক ব্যবস্থা করতে হবে। সানবাথ থেকে শুরু করে, সী-বীচে আনন্দ উপচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সার্ফিংসহ উপকূলে যতোরকম জলকেলির ব্যবস্থা করা যায়, সে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতির পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবস্থা কয়েকশ' গুণ বাড়াতে হবে, যাতে বিদ্যুৎহীন হয়ে না পড়ে সেন্ট মার্টিন্স। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করতে যতো মেগাওয়াটসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার, বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. বনায়ন ও পরিবেশ রক্ষা, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ অনেক ভালো হবে। দ্বীপের চারিদিকেই সমুদ্রতটরেখা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র উপকূল নিরাপদ করে তুলতে হবে। একইসংগে কীভাবে সেন্ট মার্টিন্সের চারদিকের ভূমি উন্নয়ন করে এর সারফেস লেভেল বাড়ানো যায়, সেই চিন্তা পরিকল্পনায় থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সাগরে মাটি ফেলে দ্বীপ সৃষ্টি করে পাম সিটি তৈরি এবং বুর্জ খলিফা বা বুর্জ আল আরব নির্মাণ করার টেকনিক নেয়া যেতে পারে। মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এগুলো করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রী, নিজের তত্ত্বাবধানে। পর্যটনকে কোন মাত্রায় নেওয়া যেতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে আমিরাতি পরিকল্পনা-উদ্যোগ এবং বিনিয়োগ। কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন্সকেও ঠিক সেই পরিকল্পনায় এনে ট্যুরিস্ট স্পষ্ট দু'টিকে স্বর্গীয় স্তরের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

এ ধরণের একটি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে নতুন অর্থনৈতিক জীবনের সন্ধান দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. মাহবুব হাসানঃ কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন: