• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ৭২, শেখ হাসিনা’র অনন্য ৪০

ইয়াসির ইয়ামীন

প্রকাশিত: ২০:১২, ১৬ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ২২:১২, ১৬ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ৭২, শেখ হাসিনা’র অনন্য ৪০

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী গেলো গত ২৩ জুন।

এক নজরে ৭২ বছর: পেছন ফিরে দেখা

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা'র পতনের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এর ১৯২ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন টিকাটুলির কে এম দাস লেনের 'রোজ গার্ডেন প্যালেস'-এ গড়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক দল 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। পলাশীর প্রান্তরে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন মনে নিয়েই হয়তো প্রতিষ্ঠাতারা দলটির আত্মপ্রকাশের জন্য ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন।

দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই, ময়মনসিংহে। আবারও সভাপতি হন মওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিব-এর উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন নাম করা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'। এই বছরের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হল-এ দলের তৃতীয় কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে রূপ নেয়। এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে ভাসানী'র নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৪ সালেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে এই জুটি অপরিবর্তিত থাকে।

এভাবে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই রেকর্ড এখনো অটুট তাঁর অনুকূলে। আমরা দেখি, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সভাপতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যতোদিন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনিই ছিলেন দলের প্রাণভোমরা।

১৯৬৬'র কাউন্সিলে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দিন আহমেদ। ১৯৬৮ ও ১৯৭০-এর কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। স্বাধীনতার পর 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ' নাম নেয় দলটি। ১৯৭২-এর কাউন্সিলে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান (পরে রাষ্ট্রপতি, প্রয়াত)। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব দেওয়া হয় এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন জিল্লুর রহমান।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নানান জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যায়। এ সময় নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অবশ্য দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক (মরহুম)। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।

১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং (মরহুম) রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে তাঁরাই বহাল থাকেন।

২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা এবং প্রয়াত আবদুল জলিল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই, ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দু'টি কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (মরহুম)।

২০১৬'র ২৭-২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা বহাল থাকলেও নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। সর্বশেষ কাউন্সিলেও এই জুটি অপরিবর্তিত রয়েছে।

ইতিহাস বলছে, ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮'র মার্শাল ল' বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪'র দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯'র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনসহ নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সব লড়াই-সংগ্রামে আওয়ামী লীগই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তবে শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করে দেয়ার জন্য ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় জড়ানো হয়। ১৯৬৯ সালে জনগণ তাঁকে মুক্ত করে এনে ভালোবেসে উপাধি দেয় 'বঙ্গবন্ধু'।

মূলতঃ পঞ্চাশের দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। নানান ঘটনাকেন্দ্রিক আন্দোলনে শেখ মুজিব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় পূর্ব বাংলার জনগণের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ।

স্বাধীন বাংলাদেশের হাল ধরেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট একদল স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী সেনাসদস্য তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।

প্রাচীন এই সংগঠনকে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করতে নানান কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র করেছে ১৯৭৫-এর পরের শাসকগোষ্ঠী। হাজার প্রতিকূল স্রোতের মাঝে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে ফিরে আসার দিন থেকেই আওয়ামী লীগ প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা'র সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এবং সামরিক ও স্বৈরশাসকদের মাইনাস ফর্মুলার অপচেষ্টার বিপরীতে ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে ওঠে।

১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারলেও দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোট পায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৮, ২০১৪ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত চারবার ক্ষমতায় এসেছে।

আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ৭২, শেখ হাসিনা'র অনন্য ৪০

অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ ৭২ বছরের পথচলা আওয়ামী লীগের। চড়াই-উতরাইয়ের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মিশে আছে সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আকাশছোঁয়া সাফল্যের গৌরবগাঁথা।

অবশ্য পঞ্চাশ বছর বয়েসি বাংলাদেশের মূল কাঠামো তৈরি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু, মাত্র সাড়ে তিন বছরে। এই সময়ের মধ্যে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু'র নেতৃত্বাধীন সরকার। সহজ কথায় বলা যেতে পারে, স্বাধীনতার পর জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন উন্নত, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশের।

১৯৮১ সালে সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর থেকে দলের ৭২ বছরের ইতিহাসে অর্ধেকের বেশি সময় (৪০ বছর) দলের সভাপতির দায়িত্বভার বয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধু'র সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ভিশন-২০২১ এবং ২০৪১-এর প্ল্যান জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে উন্নত রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হওয়ার।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘতম সময়ের সভাপতি। ১৯৮১ সাল থেকে আজ-অব্দি দলটির নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ১৯৯৬ সালে একবার এবং ২০০৮ থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর লক্ষ্য আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তির (২০৪৯ সালে) আগেই- ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা।

শেষ কথা এবং এক হালি প্রশ্ন

যে দলটি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে যুগে যুগে বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়েছে, ঘোর অমানিশায় আলোর পথ দেখিয়েছে, উড়িয়েছে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা, তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। লড়াই, সংগ্রাম, রক্তস্নাত রাজপথে অনঢ় অবস্থান, ত্যাগ ও গৌরবের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের অন্য নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই কারণেই চূড়ান্ত মূল্যায়নে বলা যেতে পারে, 'আওয়ামী লীগ', 'বঙ্গবন্ধু' ও 'বাংলাদেশ' গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং সমার্থক।

০১) আওয়ামী লীগ কি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে?

০২) অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ তার মূল চেতনা ও আদর্শ থেকে সরে গেছে। আপনি কী মনে করেন?

০৩) শেখ হাসিনা'র নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। রূপকল্পগুলো নিয়ে জাতির প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। আওয়ামী লীগ কি পারবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পূরণ করতে?

০৪) ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম- আওয়ামী লীগ। এই কারণেই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সামান্য বিচ্যুতি কিংবা ব্যর্থতায় তাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাঁরা।

মন্তব্য করুন: