• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বেগম ফজিলাতুন্নেসাঃ বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ

আহমেদ জহুর 

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২১ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৮:০৮, ২১ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
বেগম ফজিলাতুন্নেসাঃ বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ

মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসা জোহা ছিলেন নিখিল বঙ্গের প্রথম মুসলিম নারী গ্রাজুয়েট, বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী এবং উচ্চ শিক্ষার্থে বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিদেশ যাওয়া বাঙালি মুসলমান ছাত্রী। আজ ২১ অক্টোবর তাঁর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৭ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 
বেগম ফজিলতুন্নেসা’র জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মা হালিমা খাতুন। পিতা মাইনর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তবে এর আগে তিনি করোটিয়ার জমিদার বাড়িতে চাকরি করতেন। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় মেয়ের ভালো ফলাফল দেখে তিনি পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কন্যাকে শিক্ষার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ছয় বছর বয়সে ওয়াজেদ আলী খাঁ ফজিলতুন্নেসাকে করটিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন।

ফজিলাতুন্নেসা ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯২৩ সালে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে তিনি এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। এরপর ১৯২৮ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে যান উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম গ্রেট বৃটেন থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। তাঁর পড়াশোনায় করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) বিশেষ উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বিদেশে পড়ার সময়ে বেগম ফজিলতুন্নেসা’র সংগে খুলনার আহসান উল্লাহর পুত্র জোহা’র পরিচয় হয়। পরে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

বেগম ফজিলাতুন্নেসা লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে প্রথমে কলকাতায় স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৩০ সালের আগস্টে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র এক বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইলফলক হয়ে রয়েছে। অধিবেশনে তিনি বলেন ‘নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ। তাই সমাজের পূর্ণতা লাভ কোনদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। এজন্য আজ সমাজ এতোটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে।' 

তিনি আরও বলেন, 'The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself'.

ফজিলাতুন্নেসা ১৯৩৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বেথুন কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর আগে কোনো মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনি তাই তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অধ্যক্ষ হিসেবে বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিলের প্রস্তুতি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তাঁর বিনা অনুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভৎসর্না করে নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে হোস্টেল থেকে বের করে দেন। 

বেগম ফজিলাতুন্নেসা নারীদের অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে বেশ উচ্চকিত ছিলেন। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে তিনি অসংখ্য নিবন্ধ-প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন, যা তখন সওগাত ও শিখাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি লেখার শিরোনাম হলো- মুসলিম নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, নারী-জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ, মুসলিম নারীর মুক্তি ইত্যাদি। ফজিলাতুন্নেসা সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, 'ফজিলাতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এমএ এবং একজন উচুঁদরের বাকপটু মেয়ে।'

১৯২৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলাতুন্নেসা’র সংগে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ফজিলাতুন্নেসা তখন পুরনো ঢাকার হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেন-এর কাছ থেকে ফজিলাতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং ফজিলতুন্নেসা’রও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়। এভাবে ফজিলতুন্নেসা ও তাঁর বোন সফীকুননেসার সংগে নজরুল-এর পরিচয় ঘটে তাঁদের বাসায়। কাজী মোতাহার হোসেন-এর লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসা’র ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু তিনি নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। বিরহকাতর নজরুল ফজিলতুন্নেসা’র লন্ডন গমন উপলেক্ষে ‘বর্ষা-বিদায়' নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম ছিলো রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ)।

এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ফজিলাতুন্নেসা’র স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৭ সালে তাঁর নামে হল নির্মাণ করা হয়েছে।

লেখকঃ কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

বিভি/এওয়াইএইচ

মন্তব্য করুন: