• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

এম খালেদঃ পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংকার 

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৩০ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৬:৫৭, ৩০ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
এম খালেদঃ পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংকার 

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি রচনা এবং এর প্রসারে একেবারে প্রথম পর্যায়ে যারা ভূমিকা পালন করেন, এম খালেদ তাঁদের অন্যতম।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি রচনা এবং এর প্রসারে একেবারে প্রথম পর্যায়ে যারা ভূমিকা পালন করেন, এম খালেদ তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর আগে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ঢাকায় ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে ব্যাংকারদের প্রথম সংগঠন ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। এই সংগঠন ১৯৮২ সালে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বিবা) নামে পুনর্গঠিত হয়। বিবা বাংলাদেশের ব্যাংকারদের একটি উদ্যোগী অংশকে সংগে নিয়ে কাজ করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রথম পাটাতন গড়ে তোলে। 

পূর্ব বাংলার কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বিশ্ববিদ্যালয়রূপে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর পর এম খালেদ ১৯২৫ সালের ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বেদার বখত ছিলেন পূর্ব বাংলার তখনকার হাতেগোণা কয়েকজন মুসলমান পুলিশ কর্মকর্তার অন্যতম। সেই আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে পিতার ধৈর্য ও উৎকর্ষ অর্জনের উদ্যম তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এম খালেদ ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বাণিজ্যে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।      

ব্যাংকিং পেশায় এম খালেদ-এর যোগদানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তাঁর আত্মজীবনী থেকে। তিনি লিখেছেন: “বৃটিশ শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। হিন্দু ও পার্সি সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান থেকে একসাথে অনেক হিন্দু প্রস্থান করায় দেশে একটি বড় শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তখন অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ব্যাংকিং ব্যবস্থাও একটি শক্তিশালী কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। মুসলমানদের মধ্যে ব্যাংকিং বিষয়ক বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রায় অনুপস্থিত থাকায় কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ। অবশ্য কিছু লোক ব্যতিক্রমী ছিলেন, যারা পাকিস্তানে ব্যাংকিং-এর পরিকাঠামো গঠনের প্রাথমিক বোঝা কাঁধে তুলে নেন। এদের মধ্যে হাবিব ব্যাংকের হাবিব ও পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রথম ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মুহাজিরের নাম তাঁদের নিরন্তর প্রচেষ্টার কারণে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ সঙ্কটময় মুহূর্তে শুন্যতা পূরণ করতে সদ্য পাশ করা গ্র্যাজুয়েটদেরকে ব্যাংকিংয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং একসাথে বহুসংখ্যক তরুণকে নিয়োগ দেয়া হয়।”

বাংলাদেশের সার্বিক ব্যাংক-ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৮১ সালের ১৬ নভেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘরোয়া ম্যাগাজিন ব্যাংক পরিক্রমায় বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এম খালেদ-এর যোগদানের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে মাত্র একজন ডেপুটি গভর্ণর কর্মরত ছিলেন। তিনি মো. খালিদ খান।  

এম খালেদ কলেজে অধ্যাপনা করার সময় ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকে কলকাতা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সফর করেন। তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাঙালি মুসলমানদের ব্যাংকিং পেশায় এগিয়ে আসার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মূলতঃ তাঁর উৎসাহে এম খালেদ ব্যাংকিংয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ হন। সেই বছরই এম খালেদ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের কলকাতা অফিসে অফিসার পদে যোগ দেন। 

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে কিছুদিন কাজ করার পর এম খালেদ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন। সেখানে তিনি প্রায় দশ বছর কর্মরত ছিলেন। এই সময় উচ্চতর অ্যাকাউন্টেন্সিতে সম্মানসহ লন্ডন, ভারত ও পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স-এর পরীক্ষাগুলোতে কৃতকার্য হন এবং লন্ডনের স্ট্যাটিস্টিক্যাল সোসাইটি, পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স ও ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ফেলোশীপ লাভ করেন। 

এম খালেদ কলম্বো প্ল্যানের অধীনে ব্যাংকিংয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য ১৯৫৩-’৫৪ সালে লন্ডনের মিডল্যান্ড ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি পশ্চিম জার্মানির ডয়শে ব্যাংক এ. জি., লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যাংক এবং নিউইয়র্কের আরভিং ট্রাস্ট কোম্পানিতেও বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।  

১৯৫৯ সালে তিনি পূর্ব বাংলার বাঙালি মালিকানায় প্রথম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা সম্প্রসারণের কাজ করেন।

ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সংগে সংগে তিনি উপলব্ধি করেন, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের বিনিয়োগে সমাজের উপরতলার কিছু লোকের কাছে সম্পদ জমা হচ্ছে। পাকিস্তান আমলের বাইশ পরিবারের পরিবর্তে বাংলাদেশে কিছু ধনী পরিবার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পূবালী ব্যাংক-এ রূপান্তরিত হয়। পূর্ব বাংলার সদ্য জাগ্রত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এম খালেদ-এর সিকি শতাব্দীর অবদান মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে পূবালী ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করে। এম খালেদ সদ্য স্বাধীন দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থা উন্নয়নে অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর মেধা ও মননের স্বাক্ষর রাখেন। 

বাংলাদেশের সার্বিক ব্যাংক-ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৮১ সালের ১৬ নভেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘরোয়া ম্যাগাজিন ব্যাংক পরিক্রমায় বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এম খালেদ-এর যোগদানের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে মাত্র একজন ডেপুটি গভর্ণর কর্মরত ছিলেন। তিনি মো. খালিদ খান।  

এম খালেদ দীর্ঘ ৩২ বছর প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থায় কর্মরত ছিলেন। তবে তিনি তাঁর ব্যাংকিং জীবনের শুরু থেকেই সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক-ব্যবস্থার ব্যাপারে আগ্রহী এবং আস্থাশীল ছিলেন বলে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ও রচনা থেকে ধারণা পাওয়া যায়। ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মধ্যে চিন্তার উন্মেষ ঘটে সেই প্রথম থেকেই। 

ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সংগে সংগে তিনি উপলব্ধি করেন, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের বিনিয়োগে সমাজের উপরতলার কিছু লোকের কাছে সম্পদ জমা হচ্ছে। পাকিস্তান আমলের বাইশ পরিবারের পরিবর্তে বাংলাদেশে কিছু ধনী পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের দুঃখ, বঞ্চনা ও শোষণ কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। সেই অনুশোচনা ও উপলব্ধি থেকেই তিনি অংশ নেন সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক চালু করার কাজে।

“৩২ বছর আগে ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের শুরুতে আমার স্বপ্ন ছিল আমার দেশ ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা করছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখছি এজন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে”।

চৌদ্দশ’ হিজরীর পহেলা মুহররম (২২ নভেম্বর ১৯৭৯) তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ’। সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল এম আযীযুল হক ছিলেন এই সংগঠনের আহ্বায়ক। সংগঠনে তখন অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং বিভাগের ডিরেক্টর এ এস এম ফখরুল আহসান ও সিনিয়র ডেপুটি চিফ অফিসার মো. শাহাদাতউল্লাহ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর ফ্যাকাল্টি মেম্বার এইচ এ সুফি, সোনালী ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার এ এইচ এম লুৎফর রহমান, পূবালী ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার জিল্লুর রহমান চৌধুরী, পূবালী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপ্যাল ফজলুল করিম খান, উত্তরা ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের ম্যানেজার হুমায়ুন কবির, জনতা ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের অফিসার আব্দুর রাজ্জাক, রূপালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাহ মোহাম্মদ আফানুর, রূপালী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপ্যাল মুস্তাফিদুল হুদা এবং অগ্রণী ব্যাংকের রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং ডিরেক্টর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও রিসার্চ অফিসার আব্দুল মালেক চৌধুরী। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় ব্যাংকারদের মাঝে তাঁরা ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব এবং ব্যাংকিং সেক্টরে এই পুরোধা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে চলতে থাকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রস্তুতি।  

ব্যাংকার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ধারণা প্রচারের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় এই পুরোধা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এসব সেমিনারে এম খালেদ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ব্যক্ত করেন। ১৯৮০ সালের ১৫ ও ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ মিলনায়তনে ইসলামিক ইকনোমিক্স রিসার্চ ব্যুরো আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং সেমিনারের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নূরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে এই সেমিনার উদ্বোধন করেন। গভর্নর তাঁর ভাষণে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক অগ্রগতির কথা ঘোষণা করেন। সেমিনারে সভাপতির ভাষণে এম খালেদ বলেন: “৩২ বছর আগে ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের শুরুতে আমার স্বপ্ন ছিল আমার দেশ ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা করছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখছি এজন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে”। 

১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে অনুষ্ঠিত সম্পূর্ণ আবাসিক এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ছিলো বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের ১৯৮১ সালের ৪ এপ্রিল তারিখের এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরীক্ষামূলকভাবে সকল জেলায় সব বাণিজ্যিক  ব্যাংকের সব শাখায় একটি করে ইসলামী ব্যাংকিং কাউন্টার খুলতে এবং আলাদা হিসাব রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই পটভূমিতে ১৯৮১ সালের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এম নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে তখনকার ছয়টি সরকারি ও দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ের শাখাগুলোতে পরীক্ষামূলকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে সব শাখা  ইসলামীকরণ করা হবে। এম খালেদ তখনো পূবালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সভার সিদ্ধান্তের পটভূমিতে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে ব্যাংকারদের ওরিয়েন্টেশনের জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উপর প্রথম প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। 

১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে অনুষ্ঠিত সম্পূর্ণ আবাসিক এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ছিলো বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। পূবালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ওয়ার্কিং গ্রæপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ-এর সভাপতি এম খালেদ এই ঐতিহাসিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। 

এই প্রশিক্ষণ কোর্স চলাকালেই এম খালেদ ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি কোর্সটির সমাপনী দিবসে বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণে তিনি বলেন: “ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতার জন্য সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে”।

১৯৮২ সালের পহেলা মার্চ ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ নতুন নামে পুনর্গঠিত হয়। এম খালেদকে সভাপতি এবং এম আযীযুল হককে সেক্রেটারি করে গঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবা)। বিবা’র নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এস এম ফখরুল আহসান, কোষাধ্যক্ষ মো. শহীদুল্লাহ, সদস্য এস এ হান্নান, এ এইচ এম লুৎফর রহমান, সিরাজুল ইসলাম আকন্দ, এম আব্দুর রহমান, মো. মোজাফ্ফর, আব্দুল হাই, মোহাম্মদ হোসেন হাওলাদার, তাজুল ইসলাম, আতাহার উদ্দিন আহমেদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও শেখ বোরহান আলী। এই সংগঠনের শ্লোগান ঠিক করা হয় ‘বিবা টু ফাইট রিবা’। অর্থাৎ রিবা’র বিরুদ্ধে বিবা’র লড়াই। দেশের প্রথিতযশা ও উদ্যমী ব্যাংকারগণ এর সংগে যুক্ত হন। বিবা’র উদ্দেশ্য ছিলো, ব্যাংকিং খাত থেকে সুদের বিলোপ সাধন এবং বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার নীতি ও পদ্ধতি প্রণয়ন এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যাংকার, গবেষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সংবাদকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও উদ্যোক্তা তৈরি করা।   

“ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতার জন্য সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে”।

ব্যাংকারদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ দান ও প্রচারের জন্য বিবা’র কর্মীগণ নিজেদের চারটি গ্রুপে ভাগ করেন। চার গ্রুপের নামকরণ করা হয়- আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), ওসমান (রা.) ও আলী (রা.)-এর নামে। আবু বকর ইউনিটের ২৯ জনের সদস্য তালিকার শীর্ষে ছিলো এম খালেদ-এর নাম। এই গ্রুপগুলোতে মোট ১১৪ জন সদস্য ছিলেন। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রথম পাটাতন নির্মাণের কর্মী হিসেবে তাঁদের অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।  

এম খালেদ ১৯৮২ সালের ৭ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অবসর নিয়ে তাঁর পুরো সময় ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত করেন। ইসলামী ব্যাংকের ভিত্তি তৈরি করতে তিনি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে সংযোগ রক্ষা করেন এবং সবাইকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেন। 

এই সময়ে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিরূপে পেশ করতে তাঁর নেতৃত্বে বিবা’র কর্মীগণ স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে অত্যন্ত সক্রিয় ও সংগঠিত ভূমিকা পালন করেন। এম খালেদ বিবা’র কর্মীদের এবং সর্বস্তরের লোকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রায়শঃ বলতেন: ‘আমি চৌত্রিশ বছর সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে সম্পৃক্ত থেকে মানুষের জন্য কোন বড় কল্যাণ সৃষ্টি করতে পারিনি। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণকে ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত সুফল দেয়া সম্ভব।’ তিনি সবাইকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আবেদন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান।

বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন ১৯৮২ সালে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রশিক্ষণ মডিউল প্রকাশ করে। ‘রিডিংস ইন ইসলামিক ব্যাংকিং’ নামে গ্রন্থিত বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ট্রেনিং মডিউল হিসেবে এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। তখনকার দিনের সাইকোস্টাইল মেশিনে ছাপানো এই ঐতিহাসিক দলিলের ভূমিকা লেখেন বিবা’র প্রেসিডেন্ট আলহাজ এম খালেদ। 

তিনি লিখেছেন: "It gives me great pleasure to introduce the first volume of 'Readings in Islamic Banking', compiled by a set of dedicated members of the Bangladesh Islamic Bankers Association, as its maiden venture in publication. Within the past decade there has been a considerable stir throughout the Muslim world and efforts have been directed towards ordaining our lives on lines with the divine laws of the Quran and Sunnah. Eminent scholars of the Shariah have been reviewing modern economy, of which banking is the most important medium, from every angle and have brought out a stream of literature aimed at a complete re-orientation of our livers, freed from the curse of 'Riba', which gnaws into the very vitals of a just social order throughout the modern world. This collection, undertaken by an editorial team of senior experienced bankers and economists who are also trainers is based on the felt needs of practicing bankers, students of economics and the general readers, for a systematic approach to the subject of Islamic Banking. It not only considers the theories involved but also successes achieved so far in this field, with the views on it from outside of Islam.
In its present form, it is primarily aimed at providing basic training materials for voluntary participants to a series of evening courses on Islamic Banking, which are also designed by the Association as part of its regular programme. Future improvements can be visualized with the generation of funds. The topics have been wisely chosen with flexibility for adding new materials however required: the get up and presentation are also very attractive indeed. The volume should find a place in the library shelves of all Banks, Universities, Training and Research organizations - in fact, everywhere the thirst for Islamic Economy and Banking is found to exist.
I congratulate both the sponsors and editors of this issue and wish them continued success in their pious endeavour". 

“বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের একদল নিবেদিতপ্রাণ সদস্যের সংকলিত বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রকাশনার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ‘রিডিংস ইন ইসলামিক ব্যাংকিং’ উপস্থাপন করতে পেরে আমি আনন্দিত। 

বিগত দশকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে জীবনকে ঢেলে সাজানোর চিন্তা ও গবেষণা মুসলিম বিশ্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রখ্যাত শরী‘আহ্ বিশেষজ্ঞরা আধুনিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিশ্লেষণ করছেন। এসব গবেষণার মাধ্যমে সুদের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য এই বিষয়ক সাহিত্য প্রকাশের একটা ধারা সৃষ্টি হয়েছে। 

‘আমি চৌত্রিশ বছর সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে সম্পৃক্ত থেকে মানুষের জন্য কোন বড় কল্যাণ সৃষ্টি করতে পারিনি। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণকে ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত সুফল দেয়া সম্ভব।’

ব্যাংকার, অর্থনীতির শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকের চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে একদল অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ প্রশিক্ষকের সম্পাদনা পরিষদ এই সংকলন গ্রন্থনা করেছেন। শুধু তত্ত্বের উপর নির্ভর না করে ইসলামী দুনিয়ার বাইরের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গিসহ এই বিষয়ে অর্জিত সফলতাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংকলনটি প্রাথমিকভাবে অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মিত কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উপর সান্ধ্যকালীন ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ কোর্সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদানকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ উপকরণ হিসেবে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হচ্ছে। তহবিল গঠনের মাধ্যমে এর পরবর্তী উৎকর্ষের বিষয় বিবেচনা করা হবে। প্রয়োজনীয় নতুন বিষয় সংযোজনের সুযোগ রেখে বিচক্ষণভাবে বিষয়গুলো নির্বাচন করা হয়েছে। এর অবয়ব এবং উপস্থাপনাও আকর্ষণীয়। সকল ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি তথা ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে এমন সব জায়গায় এই বই সংরক্ষিত হওয়া উচিত। এই বইয়ের উদ্যোক্তাবৃন্দ ও সম্পাদনা পরিষদকে স্বাগত জানাই এবং তাঁদের মহৎ উদ্যোগের ধারাবাহিক সাফল্য কামনা করি”। 

এই সময় বিবা ব্যাংকারদের জন্য নিয়মিত ট্রেনিং কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিবা’র নিজস্ব কোনো ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ছিলো না। তাঁরা ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য তৎকালীন বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং অ্যাকাডেমি, সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজ, জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও কৃষি ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আগ্রহের সংগে বিবা’র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আয়োজনে সহযোগিতা করে। 

এম খালেদ প্রতিটি কর্মশালায় শরিক থেকে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকারদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানে কখনও সভাপতিত্ব করে, কখনও প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে ব্যাংকারদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। 

তিনি বলেন: ‘অমুসলিমরাও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রশংসা করেন এবং এ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন আশা করেন।’ 

১৯৮২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে বিবা আয়োজিত ৫ সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণে এম খালেদ বলেন: ‘জনগণ দেখতে চায় দেশে দ্রুত ইসলামী ব্যাংক চালু হয়েছে। এর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল। ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে সবাইকে সতর্কভাবে কাজ করতে হবে।’ 

তিনি বলেন: ‘অমুসলিমরাও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রশংসা করেন এবং এ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন আশা করেন।’ 

তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের মিশনারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করা এবং বাংলাদেশে বিশ্বের জন্য একটি মডেল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য অন্যদেরও এই ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী করবে।’  

১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে বিবা আয়োজিত ‘ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পঞ্চম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন: ‘ইসলামী ব্যংকিংয়ের সাফল্যের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নতুন এই ব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য একই সাথে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংক চালু করতে হবে।’ 

এম খালেদ ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির প্রতি ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করার আহ্বান জানান এবং আশা প্রকাশ করেন যে, তিন-চার মাসের মধ্যেই বেসরকারি পর্যায়ে প্রস্তাবিত ইসলামী ব্যাংক চালু হবে। প্রস্তাবিত ব্যাংক সফলভাবে পরিচালনা করতে তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের যথাযথ যোগ্যতা অর্জনের আহ্বান জানান। 

১৯৮৩ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে বিবা আয়োজিত ইসলামী ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এম খালেদ বলেন: ‘ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে ব্যাংকার, গ্রাহক এবং উদ্যোক্তাসহ প্রত্যেকেই উপকৃত হবে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আর্থিক ও সামাজিক লাভ অনেক বেশি হবে এবং ক্রমান্বয়ে সুদভিত্তিক ব্যবস্থা ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’ 

বিবা এবং পেশাদার ব্যাংকারদের সংগে নিয়ে তাঁদের সক্রিয় র্কমপ্রচেষ্টার পথ ধরে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কাজে নেমে তিনি বলেন, ‘আমি এখন যৌবনের শক্তি ফিরে পেয়েছি’! 

সরকারি পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা চালু না হওয়ায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ইসলামী ব্যাংকিং চালুর প্রচেষ্টা গ্রহণে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা চালু করতেও তিনি আহ্বান জানান।  

বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই এম খালেদ-এর নেতৃত্বে বিবা’র উদ্যোগে তিন শতাধিক ব্যাংকারকে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার মনোভঙ্গি, ক্ষেত্র ও ভিত্তি তৈরি হয়। এই সময়ে এম খালেদ তাঁর জীবনের সব অভিজ্ঞতা জড়ো করেন ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের কাজে। বিবা এবং পেশাদার ব্যাংকারদের সংগে নিয়ে তাঁদের সক্রিয় র্কমপ্রচেষ্টার পথ ধরে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কাজে নেমে তিনি বলেন, ‘আমি এখন যৌবনের শক্তি ফিরে পেয়েছি’! 

১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড লাইসেন্স পায় এবং সেই বছর ৩০ মার্চ ৭৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ছোট পরিসরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম এই শরী‘আহভিত্তিক ব্যাংকের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরপর ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট মতিঝিলের প্রধান সড়কে বিশাল সামিয়ানার নিচে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রথম শাখার কার্যক্রম। 

প্রতিষ্ঠাকালে এম খালেদকে এই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে উপদেষ্টা হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের শৈশবকালীন প্রাথমিক পরিচর্যার দায়িত্ব আনন্দের সংগে পালন করেন। তাঁর হাত ধরেই ইসলামী ব্যাংকের প্রথম এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন শিল্প ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ করিম। 

এম খালেদ ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অর্ধযুগের বেশি সময় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এগিয়ে নিতে কাজ করেন। ইসলামী ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে প্রাথমিক নাজুক দিনগুলোতে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নতুন ধারার ব্যাংকটি কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে অগ্রসর হলে টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করবে- বিষয়টি তিনি ভাবতেন। তিনি সব বোর্ড মিটিং এবং কমিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। এভাবে জীবনের শেষ দিনগুলো তাঁর কাছে অতীতের চেয়েও বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে।  

তিনি ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে বক্তৃতা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর লেখা ‘ব্যাংকিং অ্যাজ আই হ্যাভ সীন’ বইয়ে। এই বইয়ের ‘ব্যাংকিং টুডে: ব্যাংকিং ইন অ্যাডভান্সড কান্ট্রিজ’ অধ্যায়ে তিনি বলেন:
"Side by side with this technical revolution there is another major revolution in the form of interest less banking upheld by Islamic Ideology as a complete code of life. This new concept in banking arena is getting a very pragmatic expression through its practical translation with the increasing emergence of Islamic banking  institutions not only in Islamic world but  also in the advanced countries of the west."

‘ব্যাংকিং সেক্টরে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পাশাপাশি আরেকটি বড় বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তা হলো সুদমুক্ত ব্যাংকিং; যা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামের অবদান। ব্যাংকিংয়ের এই নতুন ধারণা খুব বেশি সাড়া পাচ্ছে; যার বাস্তব প্রমাণ হলো- ইসলামী দুনিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বিস্তার। সুদভিত্তিক ব্যাংক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানব দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য ধ্বংসের জন্য দায়ী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিশ্বের পন্ডিতদের এই বোধোদয়ের কারণেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দিকে ফিরে আসার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।’ 

ইসলামী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলনগুলোতে উপস্থিত থেকে তিনি ব্যবস্থাপকদের উৎসাহিত করেন এবং তাঁদের উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা করতেন। এসব সম্মেলনে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়ন হলো ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকের সাফল্য অন্যদেরও ইসলামী ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করবে। তিনি ইসলামী ব্যাংকের মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করার আহŸান জানান। তিনি ব্যবস্থাপক ও কর্মীদের যোগ্যতা ও দক্ষতার সংগে দায়িত্ব পালন এবং উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান। 

‘ব্যাংকিং সেক্টরে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পাশাপাশি আরেকটি বড় বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তা হলো সুদমুক্ত ব্যাংকিং; যা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামের অবদান। ব্যাংকিংয়ের এই নতুন ধারণা খুব বেশি সাড়া পাচ্ছে; যার বাস্তব প্রমাণ হলো- ইসলামী দুনিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বিস্তার।’

এম খালেদ-এর সামাজিক যোগাযোগ ছিলো ব্যাপক। তিনি আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাবের সদস্য ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে এই সেবামূলক সংস্থার বিভিন্ন পদ অলংকৃত করেছেন। ১৯৭৪-’৭৫ সালে তিনি লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট-৩১৫ বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন। তিনি সরকারের পাঁচসালা পরিকল্পনার প্যানেলসহ বিভিন্ন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাঁর এসব সামাজিক সম্পর্ককে তিনি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রচার-প্রসারে কাজে লাগান।  

১৯৮৮ সালে লুৎফর রহমান সরকার ইসলামী ব্যাংকের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগদানের পর এম খালেদ তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বলেন: ‘ইসলামী ব্যাংকে প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত ব্যাংকারদের উপস্থিতি ও তাঁদের অভিজ্ঞতা ব্যাংকটিকে দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে’। 

এম খালেদ-এর দিক-নির্দেশনায় ইসলামী ব্যাংক ক্রমান্বয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। ১৪৪ মিলিয়ন টাকা ডিপোজিট নিয়ে ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরুর মাত্র ছয় বছর পর ১৯৮৯ সালের ২৭ জুন এম খালেদ ইসলামী ব্যাংকের উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণকালে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪,০০০ মিলিয়ন টাকা। দেশের সর্বত্র এই ব্যাংকের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এম খালেদ ২০০৪ সালের ২৭ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের উন্নয়নে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। 

এম খালেদ-এর আত্মজীবনীর মুখবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীন অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের দাদাপীর নামে পরিচিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. এম এন হুদা লিখেছেন: "I have gone through the booklet: 'Banking as I have seen' by Mr. M Khaled with great pleasure. Although brief, it records the varied and multifarious experiences of the author in the work of banks of various types under different conditions. This has given Mr. Khaled a unique insight into banking operations in this part of the world which has been amply recognized in his career". 

“আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জনাব এম খালেদের লেখা “ব্যাংকিং অ্যাজ আই হ্যাভ সিন” বইটি পড়েছি। বিভিন্ন ব্যাংকে লেখকের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে কাজের অভিজ্ঞতা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও সংকুলান করা হয়েছে।  এসব অভিজ্ঞতা এম খালেদকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় গভীর অন্তর্দৃষ্টি দান করেছে, যা তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে স্বীকৃতি পেয়েছে”। 

“সম্প্রতি আমার মধ্যে একটা চেতনা উদয় হয়েছে, যা আমাকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটি আমার জন্য অতীতে স্বপ্ন ছিল, বর্তমানে বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের আশা।”

বইটির প্রকাশক আবদুর রশিদ চৌধুরী বলেন: "During this long way of his colourful walk he has ingrafted the spirit of trade, commerce and industry among the entrepreneurs of this part of the sub-continent specially the Muslim businessmen community, who were sauntering behind for a long time. Due to his active connection with many national and international social-welfare organizations, he was always a welfare banker and also due to his highest academic and professional qualification in this line he could maintain a balance between wealth and welfare concept of banking".
 
“আলহাজ এম খালেদ তাঁর কর্মজীবনে দীর্ঘ পরিসরে পশ্চাৎপদ মুসলিম ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও  শিল্পক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁদের চেতনা জাগ্রত করেছেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয় যোগাযোগের কারণে তিনি সর্বত্রই কল্যাণব্রতী ব্যাংকার হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তাঁকে সম্পদ ও কল্যাণের ধারণার সমন্বয় সাধন করতে সাহায্য করেছে”। 

এম খালেদ তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে বলেন: “সম্প্রতি আমার মধ্যে একটা চেতনা উদয় হয়েছে, যা আমাকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটি আমার জন্য অতীতে স্বপ্ন ছিল, বর্তমানে বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের আশা। এ কারণেই এই ব্যবস্থার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো লিখছি, যা বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এর আদর্শের শিকড় পৃথিবীতে মানব জাতির উৎপত্তির সময় পর্যন্ত গ্রত্থিত”। 

ব্যাংকিং পেশা সম্পর্কে এম খালেদ-এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং আকাক্সক্ষা ও আকুতি ফুটে উঠেছে তাঁর বইয়ের অল্প ক’টি বাক্যে।  তিনি লিখেছেন: ‘অনেকের ধারণা, ব্যাংকিং পেশায় অভিজ্ঞ ও বয়স্ক লোক দরকার। তবুও কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ মাত্র কয়েক সপ্তাহে শেষ করে তরুণদের ব্যাংকের শাখাগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। ঐ সময়ের এই সাহসী নিয়োগের কারণে ব্যাংকিংয়ে বড় ধরনের সফলতা আসে এবং ব্যাংকিং খাত প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে। আজকের তরুণরাও কি সেভাবে দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে প্রস্তুত? আমি আশা করি, আজকের তরুণ সমাজ তাঁদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলোকবর্তিকা তুলে নেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সফলভাবে এগিয়ে যাবেন।’

এই বইয়ে তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছেন: ‘পিছন ফিরে তাকালে এই ভেবে সান্ত্বনা পাই যে, আমি ঐসব তরুণদের একজন ছিলাম, দুঃসময়ে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনে যাদের উপর আস্থা রাখা হয়েছিল এবং আমাদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিল না। ঐ দিনগুলো ছিল অনেক পরীক্ষা, দুঃখ-কষ্ট ও উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ; যা আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। আমার জীবন ছিল কর্মোদ্যোগ ও কাজ-কর্মে কানায় কানায় পূর্ণ এবং কখনও কোনো উপলক্ষে থেমে থাকা বা ব্যর্থ হতে হয়নি।’  

দেশের ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করানো এবং ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলনে অনবদ্য অবদানের জন্য জাতি এম খালেদকে চিরকাল শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করবে।


লেখকঃ সাবেক এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: