অল্প স্বল্প দীর্ঘজীবন- ৬১
পেট পুরে ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম। যেতাম বললে মনে হবে বেশ বাধ্য একটা ছেলে- যে ছেলে পরীক্ষা দিতে ভালোবাসে, পড়া মনে করতে করতে পরীক্ষা দিতে যায়। তেমন মোটেও নয়।
পরীক্ষাকে ভয় নয়, দিতে হবে বলে কতদিন ধরে কত মানুষের কত কথা শোনা, বই নিয়ে পড়ে থাকা- এসব মোটেও ভালো লাগতোনা। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আম্মা মিনতি করে বলতেন, ভালো না লাগলিও কষ্ট কইরে লাগাতি হবে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা বলে কথা।
কাপড় পরে ফেলেছি। আম্মা চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। অবিরাম ঠোঁট নড়ছে, দোয়া পড়ে কতবার যে ফুঁ দেন। যেদিকে তাকাই নানাজনের উদ্বিগ্ন মুখ- নিশব্দে অনেকেরই ঠোঁট নড়ে চলেছে। যার জন্য সবার চোখেমুখে এত উদ্বেগ, সে হয়তো হঠাৎ শালিক পাখির বাচ্চার ডাক শুনতে পেলো।অমনি তার মনে হয়, ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে দেখে আসি, কোথায় কোন গাছে ডাকছে- কয়টা বাচ্চা সেখানে!
সকালে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি ঢেলে দিতেন আম্মা। আহা! সেই ঘিয়ের কি চমৎকার ঘ্রাণ যে ছিল। শুধু তা দিয়েই এক থালা ভাত খেয়ে ফেলা যেতো অনায়াসে। কিন্তু আম্মা পরীক্ষার সময় ছেলেকে তা করতে দিতেননা।
ছেলে খুশী হয়ে শুধু ঘি ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে- যাওয়ার আগে মা যদি মন ভরে খাইয়ে দিতে না পারে, ছেলে পরীক্ষার খাতা ভরে লিখে আসতে পারবেনা। এমন ভয় ছিল। ভয় ছিল ডিম আর ডালেও- কিন্তু ইয়া বড়ো ডিমওয়ালা পার্শে মাছ প্রায়ই ভেঁজে দিতেন। যেনো পার্শে মাছের ডিম, ডিম নয়।
বেগুন ভাঁজা ছিল খুব প্রিয় এবং বেগুনের তরকারীতে চিংড়ি অথবা বড়ো ট্যাংরা মাছও প্রিয় ছিল। বেগুন নাকি গুনহীন। তা শুধু আমার নয়, জানি বাড়ির সবারই ছিল বিশেষ প্রিয়- হলেও পরীক্ষার সময় বেগুনের চেহারাও দেখতোনা কেউ।
ডিম, বেগুন এসবের তালিকায় ডালও ছিল। বুটের ডাল দিয়ে মুরগীর মাংস, তাও প্রিয় আমার। রান্না হতোনা। ডালের কি দোষ, জানতে চেয়েছি- বড়দের কেউ একজন বলেছিলেন, দোষ কি তা মুখ্য নয়, অনেককাল ধরে মানুষ মেনে আসছে বলে মেনে চলা হয়ে থাকে।
বারান্দা থেকে পশ্চিম দিকের ঘরটা ভেদ করে জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যেতো, এ পাড়ায় থাকা ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছে। অমনি অস্থিরতা শুরু হয়ে যেতো বাড়িতে- সময় হয়ে গেছে, সময় হয়ে গেছে।
আব্বা ছিলেন ঠান্ডা মানুষ । কব্জি উল্টে দেখে নিতেন, কয়টা বাজে। কখন বের হলে মোটরসাইকেলে চেপে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে- হিসাব ছিল তাঁর। আব্বাকে দেখে মনে হতোনা কোনরকম উত্তেজনা, ভয় বা উদ্বেগ আছে মনে। কিন্তু জানা কথা, উপরে উপরে যেমনই দেখা যাক, কালো মেঘ ভেসে বেড়াতো আর শোঁ শোঁ হাওয়া বইতো মনে।
হোসেন মন্জিলের সামনের রাস্তাটায় তখন ছিল সুরকি বিছানো। লাল রাস্তার পাশে দাঁড়ানো থাকতো আব্বার লাল রঙের মোটরসাইকেলটা। যখন রওয়ানা হতাম, পিছনে জড়ো হয়ে যেতো দুশ্চিন্তায় মলিন মুখগুলো। প্রায় সবারই ঠোঁট নড়তো নিশব্দে, শুধু আম্মার দোয়া কান্নামিশ্রিত হয়ে ঝরে ঝরে ভিজিয়ে দিতো পরীক্ষার দিনের সকালগুলো।
সে সময়টাতে মনে হতো, আব্বা আর আমি ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধে যাচ্ছি।
মোটরসাইকেল যেনো একবারেই স্টার্ট নেয়- সে দেখাশোনা আগেই করে রাখতেন আব্বা। স্টার্ট নিতেই আম্মা ডুকরে কেঁদে উঠতেন- ইয়া আল্লাহ্, আমার পাগলরে আমি তোমার কাছে সঁইপে দিলাম, তুমিই ভরসা।
লেখক: অভিনেতা আফজাল হোসেন।
মন্তব্য করুন: