• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

পদ্মা সেতু: কিছু জনমুখী প্রশ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্লেষণ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ২৯ জুন ২০২২

আপডেট: ২২:৫৬, ২৯ জুন ২০২২

ফন্ট সাইজ
পদ্মা সেতু: কিছু জনমুখী প্রশ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্লেষণ

পদ্মা সেতু ও লেখক ইঞ্জিনিয়ার জুবায়ের আহমেদ

পদ্মা সেতু: কিছু জনমুখী প্রশ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্লেষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভুল থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবন...

১. সেতুটি বক্রাকার কেন? 

- প্রথমত পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ ডিজাইন হয় বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এর মনোনীত আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইন ফার্ম AECOM এর মাধমেl

- পুরো সেতুটি খালি চোখে দেখলে অনেকটা ইংরেজি S আকৃতির (S-shape ) বাক চোখে পড়বে মূল নদীর উপরেl

- স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়াররা (Structural engineer) দুই ধরনের লোডের উপর খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ডিজাইনের সময়। প্রথমটি ‘ডেড লোড’ যা সেতুর নিজস্ব ওজন থেকে নির্ণয় করা হয় আরেকটি হলো ‘লাইভ লোড’ যা আসে এর ওপর দিয়ে চলমান যানবাহন, বিভিন্ন সার্ভিস লাইন ও বিদ্যুতের পিলার থেকে।

- এর বাইরে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোডকে এমন মেগাস্ট্রাকচারাল ডিজাইনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হয়েছেl তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘উইন্ড লোড’ বা বাতাসের শক্তি, ‘টাইডাল ওয়েভ’ বা জোয়ার-ভাটার তীব্র স্রোতের কারণে পানির চাপ এবং অর্থকোয়াক বা ভূমিকম্পনজনিত লোড। এই সবগুলো ‘লোড’ই মূলত ল্যাটেরাল প্রেসার বা আড়াআড়ি চাপ তৈরি করে সেতুর মূল স্তম্ভের ওপরl

- পদ্মা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদীর ওপর নির্মিত। যে স্রোতের টানে নদীর তলদেশে কখনও কখনও ৩০ মিটার বা প্রায় ৯৮ ফুট গভীরতা তৈরি হয়l এমন খরস্রোতা নদীর স্রোতের চাপ কি রকম মাত্রার হতে পারে তা সাধারণ মানুষের চিন্তারও বাইরে! মূল নদীর ওপর সেতুর স্থাপনাটি বক্রাকার হওয়ার কারণে নদীর স্রোতের টান ও ঢেউ একই সময় সবগুলো পিলারে আঘাত করতে পারে না, তার উপর বক্রাকার হওয়ার কারণে রিভার্স প্রেসার বা বিপরীতমুখী চাপ তৈরি হয়, যা ‘নেগেটিভ প্রেসার জোন’ তৈরি করে, এতে ওভার অল প্রেসার অনেকটাই কমানো যায়l এই বিশেষ পদ্ধতি ফাউন্ডেশনের লোড বা ভিতের ওপর চাপ কমানোর ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

- পুরো পদ্মা সেতুটি অতি ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকার অন্তুর্ভুক্ত l ভূমিকম্পের জন্য যে লোড বা প্রেসার বা চাপ স্থাপনার ওপর তৈরি হয় সেটা ও ল্যাটেরাল লোড বা আড়াআড়ি চাপl এই চাপ যাতে সেতুর ওপর কমানো যায় সে ক্ষেত্রে ও S curve একটা বড় ভূমিকা পালন করে l

- বাংলাদেশ একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকাl প্রতি বছর বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় হয় l এই ঝড়গুলোতে বাতাসের গতিবেগ ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি থাকে। এমন গতিবেগের ঝড় এত বড় একটা ব্রিজের উপর কী রকম আড়াআড়ি বায়ুর চাপ তৈরি করতে পারে তা অকল্পনীয়। এই চাপকে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রশমিত করার একটা বিশেষ উপায় হলো বক্রাকার স্থাপনা। যার একদিকে ঋণাত্মক চাপ, আরেকদিকে একই সঙ্গে ধনাত্মক চাপ তৈরি হয় l ফলে এমন ঝড়ে ও স্থাপনার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না l 

-ট্রাফিক সেফটি ও রিস্ক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অলোকে বলতে গেলে যখন একটি বক্রাকার পথে গাড়ি চলে, দুই দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো চালকের চোখে সবচেয়ে কম পরিমানে পড়ে এবং তার ভিজ্যুয়াল ডিসট্যান্স বেড়ে যায়। একটা গাড়ি যখন বক্র পথে চলে, তখন গাড়ির স্টিয়ারিং স্মুথ থাকে এবং চালককে রাস্তার পাশের সতর্ক সূচক ইয়েলো সাইন দেখে অতিরিক্ত সচেতনতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হয়। যা দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বড় ভূমিকা পালন করে l ড্রাইভিং টেস্ট ও ট্রেনিংয়ের সময় সকল চালককে এই দিক নির্দেশনা শেখানো হয় l 

- বক্র স্থাপনার স্থাপত্যশৈলী সরল রৈখিক স্থাপনার চাইতে অনেক বেশি। সেতুটি বাঁকা হওয়ার কারণে রাতের বেলা ট্রাফিক লাইট, জলের উপর আড়াআড়ি ছায়া ফেলে। ঢেউ খেলানো পানির ওপর সেতুর সোডিয়াম বাতির প্রতিফলন এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, যেটা মানুষের দেহ ও মনকে উদ্বেলিত করে l

২. পদ্মা সেতু তৈরি করতে এত দীর্ঘ সময় কেন লাগলো, ব্যায়ভারও কেন এত বৃদ্ধি পেলো?

- প্রথমত পদ্মা সেতুর ডিজাইন ও পরিকল্পনা যখন করা হয় তখন খুব তাড়াহুড়া করে, অন্য সাধারণ লম্বা ব্রিজের কথা মাথায় রেখে করা হয় l প্রমত্তা পদ্মার নদীগর্ভের মাটির বিস্তারিত গুনাগুন সম্পূর্ণরূপে বিশ্লেষণের আওতায় আনার কথা চিন্তা করা হয়নি l স্যাম্পল বোরিং করে পুরা সেতুর ডিটেল ডিজাইন ড্রয়িং প্রস্তুত করা হয়। স্রোতস্বিনী নদীর বুকে এমন মেগা স্ট্রাকচার নির্মাণের ক্ষেত্রে যা ছিল সবচাইতে বড় ভুল।

- এই একটি মাত্র ভুল পুরো সেতুর কাজকে দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে। কয়েকটি পিলারের নিচের মাটি এতটাই নরম পাওয়া যায় যে, ১২০ মিটার পাইল ও লোড বহন করতে তা অক্ষম। এইসব লোকেশনে ডিজাইনের আগে কোনো টেস্ট করা হয়নি l তাই নতুন করে পাইল ডিজাইন ও টেস্ট করার দরকার হয় l

- এর মাঝে ২০১৫ সালের প্রবল বন্যায় সেতুর দুই পাশের কনস্ট্রাশন ইয়ার্ড পুরো বিলীন হয়ে যায় l এ কারণে কনস্ট্রাকশন কাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল।

- ডিজাইন টিম,  প্রত্যেক পিলার লোকেশনে সয়েল টেস্ট না করে যে ইঞ্জিনিয়ারিং ভুল করেছিলেন সেটার সমাধানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইতিহাসে জন্ম হয় নতুন প্রযুক্তি মাইক্রোগ্রাউটিং পাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। পিলারের চারপাশের মাটিতে মাইক্রোগ্রাউটিংয়ের মাধ্যমে বন্ড তৈরির নতুন কৌশল এটি। যা একমাত্র পদ্মা সেতুর পাইলের ক্ষেত্রেই সর্ব প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে। মাইক্রোফাইবার গ্রাউট আশেপাশের মাটিতে পিলারের চারপাশে অনেকটা গাছের গুচ্ছমূলের মতো কাজ করে l এই পদ্ধতিটা পরীক্ষা করে প্রমাণ ও কর্যকরী করার জন্য দীর্ঘ  দুই বছর সময় লেগে গেছে।

- সেতুর প্রাথমিক টেন্ডারে কার্ভ পাইলিং ও ফাইবার গ্রাউটিং অন্তুর্ভুক্তি ছিল না। এই নতুন কাজ ও প্রযুক্তি সেতুর খরচ বাড়ানোতে একটা বড়  ভূমিকা পালন করেছে।

- প্রত্যেকটা পাইলের উপরের মাথা ও নিচের প্রান্ত আড়াআড়ি হওয়ার কারণে চারপাশের মাটিও একটা ভারবাহী উপকরণ হিসেবে কাজ করে। সঙ্গে পাইলের সারফেস ফ্রিকশন ক্ষমতাও বেড়ে যায়। পাইলের দুই প্রান্তের মধ্যে সরল রৈখিক দূরত্ব ২০ ফুটের মতো। যা সাধারণ পাইলের ক্ষেত্রে শূন্য (০)  ধরা হয় l প্রত্যেক পিলারের নিচে ৬টা পাইল আড়াআড়িভাবে বসিয়ে অনেকটা স্পাইডার বা মাকড়সার জালের মতো তৈরি করা হয়েছে। তার ওপর ফুটিং (Footing) বানিয়ে পিলার উঠিয়ে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এমন প্রযুক্তি পদ্মা সেতুতেই প্রথম ব্যবহার হয়েছে। তাই খরচ বাড়াতে হয়েছে l

- বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল এক্সপার্ট টিম, কনসালটেন্ট সবাই একযোগে চলে যাওয়ায়, দেশীয় এক্সপার্ট প্যানেলকে অনেক সময় ও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়েছে অন্য কোম্পানিকে দিয়ে ডিজাইন সংশোধন করানোর জন্য।

- বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে একযোগে অনেকগুলো দেশে যুদ্ধ লাগার কারণে কনস্ট্রাশন ম্যাটেরিয়ালসের দাম কয়েক গুন বেড়ে যায়।

- সর্বশেষ করোনা মহামারি অর্থনীতির চাকা এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে, প্রকল্পের সময় ও অর্থ দুটোই বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল নাl

পরিশেষে এতগুলো প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এমন একটি মেগা প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য এর পিছনের কারিগরদের এই জাতি সারা জীবন মনে রাখবে।

নিজের গত ১৫ বছরের  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেগাপ্রকল্পে, প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে পুরো বিষয়টি মূল্যায়নের ক্ষুদ্র চেষ্টা করেছি।

লেখক 

ইঞ্জিনিয়ার যোবায়ের আহমেদ

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল, বুয়েট

এম. ইঞ্জিনিয়ার সেফটি অ্যান্ড রিস্ক, এমইউএন, কানাডা

(PMP, LEEDS & ISO 9001-2015 Certified Quality Auditor,)

সাবেক প্রকল্প ব্যবস্থাপক, রিটকো রয়াল করপোরেশন, কোরিয়া

সাবেক ডিজিএম-হেড অব প্ল্যানিং, আব্দুল মোনেম গ্রুপ।

বিভি/এইচএস

মন্তব্য করুন: