• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

রাষ্ট্রপতির কাছে বাম জোটের খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ১৩ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৮:২৪, ১৩ জানুয়ারি ২০২২

ফন্ট সাইজ
রাষ্ট্রপতির কাছে বাম জোটের খোলা চিঠি

অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার গঠনের দাবিতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ-এর কাছে খোলা চিঠি দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। একইসংগে ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপকে জনগণের সংগে প্রতারণার শামিল বলেও উল্লেখ করেছেন জোট নেতারা।

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে পুরানা পল্টন মোড়ে জোটের সমাবেশ থেকে জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এই খোলা চিঠি প্রকাশ করেন ও পাঠ করে শোনান। 

খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন দলীয় সরকারের অধীনে সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের নীলনক্সার বাইরে কিছুই করার অবকাশ নেই। এই অবস্থায় এবারও সরকার ও সরকারি দলের পছন্দ ও তালিকার বাইরে নির্বাচন কমিশন গঠনেরও সুযোগ নেই। শেষ পর্যন্ত আপনাকে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিতে হবে। এই পরিস্থিতি দেশে নির্বাচন ও শাসনতান্ত্রিক মারাত্মক সংকট কেবল গভীর থেকে আরও গভীরতর করবে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনসহ নির্বাচনকেন্দ্রীক সংকটটি রাজনৈতিক। গত দুইটি জাতীয় নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও যদি ব্যর্থ হয় তাহলে গোটা দেশ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আরও বিপর্যস্ত হবে, অনিশ্চিত অন্ধকারে নিপতিত হবে। সরকার ও সরকারি দল আপনার উপর ভর দিয়ে বৈতরণী পার হতে চায়। কিন্তু তাতে সংকটের কোনো সমাধান হবে না। উল্লেখ্য বিদ্যমান ব্যবস্থায় আপাত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের কোনো বিকল্প নেই।

দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক হিসাবে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও আপনি আপনার মর্যাদাপূর্ণ পদের নৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারকে নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে কার্যকরি রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন, যাতে সরকার ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসমূহের সংগে মতৈক্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সমঝোতায় আসতে পারে। 

রাষ্ট্রপতিকে যথাসম্ভব দ্রুততার সংগে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান বাম জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

এই সমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল্লাহ কাফি রতন, বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের নজরুল ইসলাম, বাসদ (মার্কসবাদী) নেতা মাসুদ খান, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা আবদুল আলী, ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) বিধান দাস। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন জোটের কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ, বহ্নিশিখা জামালী, ফখরুদ্দীন কবীর আতিক, শহীদুল ইসলাম সবুজ, আকবর খান, জলি তালুকদার প্রমুখ।

সমাবেশের পর বাম জোট নেতা আকবর খান, শহীদুল ইসলাম সবুজ, জুলফিকার আলী ও সাদেকুর রহমান শামীম বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে দেওয়া খোলা চিঠির কপি পৌঁছে দেন।

বাম জোটের খোলা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলোঃ

বরাবর
মাননীয় রাষ্ট্রপতি 
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ 
বঙ্গভবন, বাংলাদেশ।

বিষয়: মাননীয় রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি।

মহোদয়,
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে আমাদের সালাম নেবেন।

আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে আপনি সংলাপের যে আয়োজন করেছেন সে সম্পর্কে বাম জোট এবং আমাদের জোটের নিবন্ধিত তিনটি শরীক দল- বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে আমাদের সুনির্দিষ্ট মতামত জানিয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছি যে, এই সংলাপের আয়োজন অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও প্রচারসর্বস্ব; আপনার মূল্যবান সময়ের অপচয়ও বটে।

এটা সত্য যে, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব আপনার। কিন্তু এটাও সত্য যে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে আপনার যে বিবেচনাবোধই থাকুক না কেন বাস্তবে সরকার প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর মতামত ও ইচ্ছার বাইরে এ সম্পর্কে আপনার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অবকাশ নেই। গত দুইটি নির্বাচন কমিশনের শোচনীয় অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এবং আপনার আহুত দুইটি সংলাপ, সার্চ কমিটি ও এই প্রক্রিয়ায় যে দুইটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল তারা ভোটাধিকার রক্ষা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নজিরবিহীন দায়িত্বহীনতা ও কলঙ্কের স্বাক্ষর রেখেছে যা দেশে বিদেশে সর্বমহলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। সরকারি দলের পক্ষে নির্লজ্জ আনুগত্য দেখিয়ে যে নগ্ন ভূমিকা পালন করেছে তাতে তারা দেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনী গোটা ব্যবস্থাই তুলে দিয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করতে গিয়ে নির্বাচনের নামে তারা এক মহাতামাশা মঞ্চস্ত করেছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালে তারা ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, আর ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে কেটে নিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীদেরকে যেভাবে বিজয়ী ঘোষণা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটিত করেছে বিশ্বে তার দ্বিতীয় নজির নেই। 

এইভাবে সমগ্র নির্বাচনকে চরম হাস্যকর, প্রতারণাপূর্ণ আর তামাশায় পর্যবসিত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও চলছে এরই ধারাবাহিকতা। স্থানীয় নির্বাচনে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারালেও কেউই এর দায়িত্ব গ্রহণ করছে না। গোটা নির্বাচন টাকার খেলা, পেশীশক্তি, ব্যবসা আর চরদখলের মত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তদুপরি রাজনীতিতে আস্থা, বিশ্বাস ও সহনশীলতার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তে সরকারি দলের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধাত্মক রাজনীতিকেই নানাভাবে উস্কিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভোটের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় পছন্দের দল ও প্রার্থী বাছাই এবং সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অতীতের ধারাবাহিকতায়, বিশেষ করে গত দুইটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশে এখন দলীয় সরকারের অধীনে সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোন সুযোগ নেই। সরকারের নীলনক্সার বাইরে কিছুই করার অবকাশ নেই। এই অবস্থায় এবারও সরকার ও সরকারি দলের পছন্দ ও তালিকার বাইরে নির্বাচন কমিশন গঠনেরও সুযোগ নেই। শেষ পর্যন্ত আপনাকে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিতে হবে। এই পরিস্থিতি দেশে নির্বাচন ও শাসনতান্ত্রিক মারাত্মক সংকট কেবল গভীর থেকে আরও গভীরতর করবে।

দেশবাসী আশা করছিলো এসব গভীর সংকট ও রাজনৈতিক দুর্যোগে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক হিসাবে জনগণের পক্ষে আপনি কথা বলবেন, সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দেশবাসী এ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। নির্বাচনকেন্দ্রীক এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশের ৫৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক চেষ্টা করেও আপনার সাক্ষাৎ পায়নি। এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলে আমরা আপনাকে বিব্রত করতে চাই না।

মাননীয় রাষ্ট্রপতি,
আপনি নিশ্চয় একমত হবেন যে, নির্বাচন কমিশন গঠনসহ নির্বাচনকেন্দ্রীক সংকটটি রাজনৈতিক। গত দুইটি জাতীয় নির্বাচনের মত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও যদি ব্যর্থ হয় তাহলে গোটা দেশ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আরও বিপর্যস্ত হবে, অনিশ্চিত অন্ধকারে নিপতিত হবে। সরকার ও সরকারি দল আপনার উপর ভর দিয়ে বৈতরণী পার হতে চায়। কিন্তু তাতে সংকটের কোন সমাধান হবে না। উল্লেখ্য বিদ্যমান ব্যবস্থায় আপাত:নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের কোন বিকল্প নেই।

দেশ ও জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক হিসাবে আপনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আপনার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও আপনি আপনার মর্যাদাপূর্ণ পদের নৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারকে নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে কার্যকরি রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন; যাতে সরকার ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে মতৈক্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সমঝোতায় আসতে পারে।

আশা করি এই ব্যাপারে আপনি যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

আপনার সুস্বাস্থ্য কামনায়

(সাইফুল হক)
সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদ
বাম গণতান্ত্রিক জোট

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: