কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: চাপে থাকা সাক্কু কি করবেন?
দীর্ঘকাল কুমিল্লায় বিএনপি’র নেতৃত্বের লাগাম ছিল আকবর হোসেনের হাতে। টুকটাক গ্রুপিং যে তখনও ছিল না- তা নয়। তবে রাজনীতি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন শক্তহাতে। আওয়ামী লীগের কোন্দলকে কাজে লাগান বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এ নিয়ে পরিহাসও করতেন প্রকাশ্যেই। আকবর হোসেনের মৃত্যুর পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। মোটাদাগে দুই ভাগ হয়ে যায় বিএনপি। এক অংশের নেতৃত্বে আসেন হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন। সংসদ নির্বাচনে লড়লেও বিত্তশালী এই রাজনীতিবিদের হাতে সাফল্য ধরা দেয়নি। আরেকপক্ষে মনিরুল হক সাক্কু
আকবর হোসেনের এই নিকটাত্মীয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও দীর্ঘ। ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য দেখিয়েছেন বারবার। পৌরসভার চেয়ারম্যান থেকে হয়েছেন সিটি মেয়র। আওয়ামী লীগের কোন্দল সাহায্যের হাত-বাড়িয়েছে তার জন্যও। প্রভাবশালী সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে তার সখ্য নিয়ে শহরে নানা আলোচনা। বিএনপি’র প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কখনও কখনও। যদিও তিনি মনে করেন এ দলের সঙ্গে তার দীর্ঘ সম্পর্ক। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দল তাকে বহিষ্কার করেছে। তিনি নিজেও করেছেন পদত্যাগ। তবে সাক্কুকে অতীতেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে তা প্রত্যাহারও করা হয়। স্বেচ্ছাসেবক দলের মহানগর কমিটির সদ্য বহিষ্কৃত সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সারও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লড়ছেন। তবে তাকে সাক্কুর জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে না। তার জন্য এবার চাপটা অন্য জায়গায়। গত দু’টি নির্বাচনেই আ.ক.ম. বাহাউদ্দিন বাহারের বিপরীত গ্রুপের প্রার্থীর সঙ্গে লড়েছেন তিনি। এবার লড়তে হচ্ছে এমপি’র একান্ত অনুগত আরফানুল হক রিফাতের সঙ্গে। সাক্কুর ভাষাতেই যিনি, ‘এমপির ম্যান।’
মঙ্গলবার দিনের মধ্যভাগে শহরে সাক্কুর বাসায় গিয়ে দেখা গেল নেতাকর্মীদের ভিড়। বিভিন্ন এলাকা থেকে একে-একে অনুসারীরা আসছেন। চা পানের পাশাপাশি তারা মশগুল আড্ডায়। সেদিনই সাক্কু মানবজমিনকে জানিয়েছিলেন, দলের পদ ছেড়ে দেবেন। তার কথা, আমি বিএনপিকে বিব্রত করতে চাই না। আমি দল থেকে পদত্যাগ করবো। জনগণের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়তে চাই। অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করতে চাই। তিনি বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী সব কাজতো করতে পারিনি। তবে ৭০ ভাগ কাজ সমাপ্ত করেছি। বাকি ত্রিশ ভাগ কাজ করতে পারিনি। এ কাজ সমাপ্ত করতেই জনগণের সমর্থন চাই। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের অবদান তুলে ধরেন তিনি।
তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন সাক্কু। আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে তার সখ্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উন্নয়নের স্বার্থে আমি বাহার ভাইয়ের কাছে গেছি। সেখানে অন্য কোনো সমঝোতা নেই। এবারতো এমপি’র ম্যানই মনোনয়ন পেয়েছেন। আমি তো নির্বাচনে লড়ছি। ভোট না করার জন্য তার ওপর চাপ আছে বলে একধরনের গুঞ্জন রয়েছে শহরজুড়ে। তিনি শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন কি-না এ নিয়েও নানা কথা। মহানগর আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক সরাসরি প্রশ্নটি তুললেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের অবশ্য সাফ কথা, তারা কারও ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করছেন না। যে কেউ নির্বাচন করতে পারেন। তাদের কোনো সমস্যা নেই। এসব গুঞ্জন নিয়ে সাক্কুর কাছেও জানতে চাইলাম। তিনি বলেন, আমি ৪৩ বছর ধরে রাজনীতি করছি। পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলাম। দুইবার জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। আমাকে কেউ চাইলেই তো সরিয়ে দিতে পারবে না।
কুমিল্লার স্থানীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মনিরুল হক সাক্কুর নিজস্ব একটা ভোট ব্যাংক আছে। বিরোধী শিবিরের ভোটও অতীতে তার পক্ষে গেছে। এরসঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর নীরব সমর্থন তার জন্য ছিল প্লাস পয়েন্ট। এ তিনটি যুক্ত হওয়ায় সহজেই ভোটের বৈতরণী পার হয়েছেন তিনি। আফজল খানের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকেও ধরাশয়ী করেছিলেন। এবার অঙ্কটা এখানেই জটিল। বিশেষত আওয়ামী লীগের একটি অংশের নীরব সমর্থন আগের দু’বার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ব্যালেন্স তৈরি করেছিল। এবার সে সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের সমর্থনপুষ্ট সেটা আগেই বলা হয়েছে। আফজল খানের পুত্র মাসুদ পারভেজ খান ইমরান ভোটের মাঠে রয়েছেন। তিনি লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু বাহাউদ্দিন বাহারের তুলনায় তার প্রভাব একেবারেই সীমিত। বাহারের পক্ষের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তারাও বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। প্রভাব কম হলেও বিরোধী শিবিরের আরও একজন নেতা প্রার্থী রয়েছেন। এছাড়া, সাক্কুর আনুগত্য নিয়ে দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংশয় তার বিরুদ্ধে যেতে পারে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রভাবিত করতে পারে বিষয়টি। তবে এরচেয়েও বড় যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো, ভোটারদের বড় অংশ কী কেন্দ্রে যাবেন? তারা কি সে সুযোগ পাবেন? এটি যদি ঘটে এবারও সাক্কুর সুযোগ থাকবে বলে অনেকে মনে করেন।
বিগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে দুই/একটি নির্বাচন প্রশংসিত হয়েছিল তারমধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল অন্যতম। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনেরও ভোট গ্রহণের যাত্রা শুরু হচ্ছে কুমিল্লা থেকে। এ নির্বাচন নিয়ে কমিশন এরইমধ্যে তার শক্ত অবস্থান স্পষ্ট করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পরীক্ষাটা সহজ নয়। তবে কমিশন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে কি-না, চেষ্টায় কী ফল মেলে সেদিকে দৃষ্টি থাকবে সারা দেশেরই।
মন্তব্য করুন: