• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

মুঘল ও রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন

প্রকাশিত: ১৭:১০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
মুঘল ও রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন

ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন ধারণ করে স্ব-মহিমায় টিকে আছে অনেক মসজিদ। একইভাবে আধুনিককালেও চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ কৌশলের সমন্বয়ে নির্মিত হচ্ছে অসংখ্য মসজিদ। বিশ্বে এমন অনেক মসজিদ আছে, যেগুলো দেখতে রাজ প্রাসাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এমনই এক অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। ধর্মীয় উপাসনালয়ের পরিচয় ছাড়িয়ে মসজিদটি স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে।

ব্রুনাইয়ের সুলতানদের হাত ধরে ১৫ শতকে দেশটিতে ইসলামের আগমন ঘটে। ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদের আগে ব্রুনাইয়ের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর ‘বন্দর সেরি বেগাওয়েন’-এ আক্ষরিক অর্থেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো মসজিদ ছিলো না। বিশাল শহরে ‘মারবুত পাক টুঙ্গাল’ ছিলো কাঠের তৈরি একমাত্র ছোট্ট মসজিদ। তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিনের দাদা সুলতান মুহাম্মদ জামালুল আলমের আমলে নির্মিত ৫০০ মানুষের ধারণক্ষমতার একমাত্র মসজিদটির ছাদ তৈরি হয়েছিলো পাম গাছের বড় বড় পাতা দিয়ে। তবে তেল উৎপাদন শুরু হলে ব্রুনাইয়ের অর্থনীতির চাকা সচল হয় এবং সুলতান সাইফুদ্দিনও উচ্চাকাক্সক্ষী প্রকল্প হাতে নিতে শুরু করেন। তাঁর আমলেই নির্মত হয় ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। ব্রুনাইয়ের ২৮তম সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিনের নামেই মসজিদটির নাম রাখা হয়।

১৯৫৪ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৫৮ সালে। এই মসজিদের ডিজাইন করেছেন ইতালিয়ান স্থপতি ক্যাভালিয়ের রুডলফ নোলি, যিনি দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ কিছু স্থাপত্য কাজের জন্য নন্দিত ও খ্যাতিমান। মুঘল এবং ইতালিয়ান স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে এই অসাধারণ স্থাপনার নির্মাণ কাজ করেছে ‘এ. ও কোল্টম্যান অব বুটি অ্যান্ড এডওয়ার্ড চার্টার্ড’ কোম্পানি। 

মসজিদে ব্যবহৃত উপকরণগুলো আনা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। ইতালি থেকে আনা হয়েছে মার্বেল পাথর। গ্র্যানাইট এসেছে চীন থেকে। মসজিদের ভেতরের সাজসজ্জার জন্য ঝাড়বাতি আনা হয়েছে ইংল্যান্ড থেকে। মসজিদের মেঝেতে ব্যবহারের জন্য সুদৃশ্য শতরঞ্জি এসেছে সৌদি আরব থেকে। নির্মাণ শেষে ২২৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮৬ ফুট প্রস্থের মসজিদটি শহরের সুন্দর ও আভিজাত্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

ভেনিস অব দ্য ইস্ট খ্যাত ব্রুনাইয়ের রাজধানীর ‘ক্যাম্পং আইয়ার’ গ্রামের কৃত্রিম হ্রদের ধারে নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। এর সর্বোচ্চ মিনারের উচ্চতা ১৭১ ফুট; যার পুরোটাই মার্বেলের তৈরি। এই মিনারে রেনেসাঁ ও ইতালীয় স্থাপত্যের মিশ্রণ রয়েছে। একসংগে তিন হাজার মুসল্লি ধারণক্ষমতার মসজিদের মূল নামাজঘরের প্রতিটি স্তম্ভও তৈরি হয়েছে শ্বেত মার্বেল দিয়ে। 

মসজিদের দালানে রয়েছে মর্মর পাথরে তৈরি দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি মিনার ও সোনালী গম্বুজ। প্রধান গম্বুজ এবং ছোট মিনারগুলোর উপরের গম্বুজসদৃশ অংশগুলো সোনা দিয়ে মোড়ানো। ভেতরের দেয়াল এবং স্তম্ভগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে মুঘল ধাঁচের কারুকাজ। গম্বুজের ভেতরের অংশে বসানো হয়েছে নকশাখচিত দামী কাচ। এছাড়া আছে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা। মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে রয়েছে মনোরম বাগান ও ফোয়ারা। 

মসজিদের ভেতরে গেলে যে কারো চোখ আটকে যাবে। মূল নামাজ ঘরে ঢুকতেই দু’টি সিড়ি ও একটি এস্কেলেটর রয়েছে। মাথার ঠিক ওপরেই ঝুলছে ঝলমলে ঝাড়বাতি। মূল নামাজ ঘরের ঝাড়বাতিটির ওজন প্রায় চার টন। অন্যগুলোর ওজন দুই টন করে।

এখানকার হ্রদে থাকা সর্পিলাকার একটি সেতু সত্যিই দেখার মতো। মসজিদের স্থাপনাকে সংযুক্ত করে এখানে রয়েছে আরেকটি মর্মর পাথরের সেতু, যা দেখতে অনেকটা সুদৃশ্য জাহাজের মতো। একসময় এটি ব্যবহার করা হতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য।
হ্রদ থেকে মসজিদের প্রবেশপথ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে মনোরম একটি বজ্রা। এটি ষোড়শ শতকে নির্মিত একটি বজরার অনুরূপ। প্রাচীন বজরাটি তৎকালীন ব্রুনাই সালতানাতের সুলতান বলকিয়াহ জলযাত্রাকালে ব্যবহার করতেন। পবিত্র কুরআন নাজিল হবার ১৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বজরাটি তৈরি করা হয়। বজরা থেকে মসজিদ পর্যন্ত সর্পিল সেতুটি সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। 

মসজিদের বিশালাকায় দরজাগুলো তৈরি হয়েছে ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা কাঠ দিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর মসজিদটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হলেও মূল নকশা কখনো পরিবর্তন করা হয়নি। অনুপম নির্মাণশৈলীর এই মসজিদের নির্মাণ খরচ ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ব্রুনাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণেই ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। মসজিদের আশেপাশে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাসাদ তথা সুলতানের বাসভবন ইস্তানা নূরুল ইমান, রয়্যাল রিগ্যালিয়া মিউজিয়াম, ব্রুনাই মিউজিয়াম ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ‘ওয়াটার ভিলেজ’ বা ভাসমান গ্রাম ক্যাম্পং আইয়ার।

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে জাঁকালো মসজিদ-দালানগুলোর একটি হিসেবে সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদের সুনাম রয়েছে। এটি শুধু ইবাদতখানাই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও।

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: