• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

বিপিএ: গ্রাহকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন অধিকাংশ সুপারশপ

প্রকাশিত: ১৭:১৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
বিপিএ: গ্রাহকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন অধিকাংশ সুপারশপ

সুপার শপ বা এটিএম বুথে দেওয়া থার্মাল পেপারের রশিদে রয়েছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল 'বিসফিনল এ' বা বিপিএ। যার মাধ্যমে মানবদেহে দ্রুত বাসা বাঁধতে পারে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো মরণব্যাধি। শিশুর মনোবিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পাশাপাশি কমতে পারে বয়স্কদের প্রজনন ক্ষমতাও।

গবেষকদের এমন তথ্য সামনে আসতেই চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ভোক্তাদের মনে। আতংকে সুপারশপে কেনাকাটায় অতি সতর্ক হয়ে উঠেছেন অনেকে।

সম্প্রতি (২৭ আগস্ট) রাজধানীর শ্যামলীতে প্রিন্স বাজার-এ গিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেক গ্রাহককেই দেওয়া হচ্ছে থার্মাল পেপারের রশিদ। রশিদটি নিরাপদ কি না জানতে চাইলে দায়িত্বরতরা গ্রাহকদের বলছেন, তাঁদের দেওয়া রশিদ সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রশ্ন করলে একই জবাব দেওয়া হয় এই প্রতিবেদককেও।

এই বিষয়ে প্রিন্স বাজার লিমিটেডের শ্যামলী শাখার ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল রাজিব বলেন, আমরা উন্নতমানের প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রিন্ট করি। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, আমাদের এটা উন্নতমানের এবং নিরাপদ। 

দাবির স্বপক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ আছে কি না জানতে চাইলে দেখাতে পারেননি আব্দুল্লাহ আল রাজিব। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আমরা সাইন্সল্যাবে টেস্ট করতে দিয়েছি। তাঁর এই তথ্য প্রতিবেদকের মনে আরও সংশয় তৈরি করে। কারণ, জানা মতে, এখনও বিপিএ পরীক্ষার কার্যক্রমই চালু হয়নি সাইন্সল্যাব নামে পরিচিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবে। এই বিষয়ে সাইন্স ল্যাবের বক্তব্য সম্বলিত প্রতিবেদনও প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

গত ১৬ আগস্ট বাংলাভিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিভিনিউজ২৪.কম-এ থার্মাল পেপারের রশিদে বিপিএ-এর অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরপরই স্বপ্ন সুপারশপ কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, তাঁরা বিপিএমুক্ত রশিদ ব্যবহার করছেন। একই দাবি জানায় রাজধানীর ইউনিমার্ট সুপারশপও। 

কিসের ভিত্তিতে এই দাবি করছেন, জানতে চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসজিএস-এর ল্যাবে পরীক্ষার একটি প্রতিবেদন সবরবারহ করে সুপারশপ দু'টি। উল্লেখ্য, ল্যাব টেস্ট রিপোর্টটি সরবরাহ করেছে কোরিয়ান থার্মাল পেপার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হ্যানসল পেপার লিমিটেড; যাদের কাছ থেকে এই দুই সুপারশপ থার্মাল পেপার আমদানি করে।

এই বিষয়ে স্বপ্ন সুপারশপ-এর ম্যানেজার (কমার্শিয়াল পার্চেজ) মাহবুব ইবনে হক বলেন, আমরা বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংগে যোগাযোগ করেছি। তাঁরা আমাদের নিশ্চিত করেছেন, এই পেপারে বিসফিনল এ বা বিপিএ নেই। তাঁরা যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, এতে অনেক ক্ষতিকর উপাদানের বিষয়ে পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে বিপিএ একটি। ল্যাবটেস্ট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- এটি বিপিএমুক্ত।
 
আপাতত হ্যানসল-এর দেওয়া রিপোর্টের উপর ভরসা রাখলেও প্রয়োজনে তাঁরাও পরীক্ষা করবেন বা করাবেন বলে জানান মাহবুব ইবনে হক।
 
ইউনিমার্ট লিমিটেড-এর এজিএম আতা উল্লাহ রিপন বলেন, ইউনিমার্ট ভোক্তা এবং নিজেদের কর্মীর স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় অনেক বেশি সচেতন। তিনি বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে আমরা দ্রুত পেপার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংগে যোগাযোগ করি। তাঁরা এসজিএস ল্যাবে পরীক্ষার একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন আমাদের, যেখানে উল্লেখ রয়েছে এটি বিপিএমুক্ত। আতা উল্লাহ রিপন বলেন, আমরা নিজেরাও থার্মাল পেপার পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি বিকল্প প্রিন্টার এবং অনলাইন ব্যবস্থা প্রস্তুত রেখেছি। যদি আমাদের টেস্টে বিপিএ'র উপস্থিতি ধরা পড়ে, তাহলে আমরাই এর ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প পদ্ধতি চালু করবো। কারণ, আমাদের কাছে ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে এই প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপরীত এবং অসহযোগিতামূলক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এই প্রতিবেদক। সশরীরে আগোরা'র অফিসে গিয়েও এই বিষয়ে কোনো তথ্য সুপারশপের ক্রেতাদের জন্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারি কোনো নির্দেশনা না পাওয়ার অজুহাতে গ্রাহকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি আগোরা কর্তৃপক্ষ। বারবার যোগযোগ করা হলেও নানান অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে আগোরা। একইভাবে বিপিএ সম্পর্কে অজ্ঞতার অজুহাতে কথা বলতে রাজি হয়নি ডেইলি শপিং, মীনা বাজার, আলমাস সুপারশপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।

এই বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, যেহেতু সুপারশপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা বিপিএযুক্ত পেপার ব্যবহার করছে, এখন তাদেরই উচিত হবে নিজেদের রশিদ নিরাপদ কি না সেটা প্রমাণ করা। একইসংগে যেহেতু ইস্যুটি জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক, সরকারের উচিত হবে বাজারে প্রচলিত সব রশিদ দ্রæত পরীক্ষা করে ক্ষতিকর পেপারগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, এটা গ্রাহকের নিরাপত্তার ইস্যু। সরকার বলেনি, এই অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার না বললেও ভোক্তা অধিকার আইনে এই বিষয়ে উল্লেখ আছে। এখন প্রয়োজন এর বাস্তবায়ন। আমরা চাই, সরকার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দেবে এবং সুপারশপগুলোও নৈতিকতা, সততা ও মানবিকতার দায়বদ্ধতা থেকে নিজেরা গুরুত্বসহ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে। কারণ, স্বাস্থ্যকর জিনিস পেতেই ভোক্তারা সুপারশপে যান। তাই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সুপারশপ মালিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় ভোক্তাদের উচিত হবে সুপারশপে কেনাকাটা বর্জন করা।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, এই বিষয়ে পড়াশোনা করে যা জানলাম, তাতে দেখছি কেমিক্যালটি অনেক ভয়াবহ। এটা কিডনি নষ্ট করে দিতে পারে। তিনি বলেন, যেহেতু ইস্যুটি জনস্বাস্থ্যের, তাই এটা নিয়ে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। আমি ইতিমধ্যে বিষয়টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করেছি। পরিবেশ অধিদফতরের ডিজিও এই বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। শিগগিরই আমরা এটা নিয়ে কাজ শুরু করবো।

এর আগে গবেষণা সংস্থা এসডো জানায়, দীর্ঘ এক বছরজুড়ে ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত ৩৬টি রশিদ তাঁরা পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা দালাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ল্যাব পরীক্ষায় রশিদ ভেদে ০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত বিপিএ-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, যে কোনও পণ্যে সর্বোচ্চ বিপিএ ব্যবহার করা যাবে ০ দশমিক ২ শতাংশ। এর বেশি হলে তা মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ বয়ে আনতে পারে।

বিভি/কেএস/এসডি

মন্তব্য করুন: