• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

কেনাকাটার রশিদের কেমিক্যালে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে শিশুর মনোবিকাশ

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৭:২২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
কেনাকাটার রশিদের কেমিক্যালে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে শিশুর মনোবিকাশ

মামা শপিং করে ঘরে ফিরেছেন। বাসায় ঢুকতেই শপিং ব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে ভাগনিরা। ব্যাগ হাতড়ে বের করে নিচ্ছে সবকিছু। ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে কখনও কখনও কেনাকাটার রশিদ পেয়ে সেটি নিয়ে খেলায় মগ্ন হয়ে পড়ছে। খেলার ছলে কখনো মুখে নিচ্ছে রশিদটি। যদিও এই শিশু কিংবা তাঁর অভিভাবক কারোরই জানা নেই ওই রশিদে শিশুটির জন্য অপেক্ষা করছে মারাত্মক বিপদ।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটিএম বুথ ও সুপারশপে অর্থ লেনদেনকালে পাওয়া থার্মাল পেপারের রশিদে অস্বাভাবিক মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পলিকার্বনেট প্লাস্টিক কেমিক্যাল বিপিএ বা বিসফিনল এ।
 
গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) জানায়, দীর্ঘ এক বছরজুড়ে ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত ৩৬টি রশিদ তারা পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা দালাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ল্যাব পরীক্ষায় রশিদ ভেদে ০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত বিপিএ'র উপস্থিতি পেয়েছেন তাঁরা। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, যে কোনো পণ্যে সর্বোচ্চ বিপিএ ব্যবহার করা যাবে ০ দশমিক ২ শতাংশ। এর বেশি ব্যবহার শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ বয়ে আনতে পারে বলে দাবি গবেষকদের।

তাঁরা বলছেন, এই কেমিক্যাল খাদ্যের মাধ্যমে, লোমকূপের মাধ্যমে এবং বাতাসে মিশে নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অপরদিকে চিকিৎসা সাময়িকীগুলোর তথ্য বলছে, বিপিএ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিশুদের। তাদের মনোবিকাশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এটি। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি শিশু থেকে বয়স্কদের কিডনি অকেজো করে দিতে পারে। একইসংগে স্থূলতা বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতাও কমাতে এই কেমিক্যাল ভূমিকা রাখছে।

বিপিএ নিয়ে কাজ করা দেশি গবেষক দলের প্রধান এসডো'র মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেখানে বলছে, কোনো পণ্যে বিপিএ ০.২ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাবে না, সেখানে আমরা টেস্ট করে ৩.৮ শতাংশ পর্যন্ত বিপিএ পেয়েছি। গবেষণাকালে আমরা স্লিপ টেস্ট করানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সংগে কথাও বলেছি। এমন কাউকেই পাইনি যারা বিপিএ'র ক্ষতি সম্পর্কে জানেন।

তিনি বলেন, শুধু থার্মাল পেপারের রশিদেই নয়, প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রীতেও বিসফিনল এ ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের খেলনা, পানির বোতলে ব্যবহার হচ্ছে এই কেমিক্যাল। অথচ এটি ভয়াবহ মরণব্যাধিগুলোর অন্যতম কারণ। এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে শিশু ও বৃদ্ধদের। তাই এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই কেমিক্যাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশে এটি আসছে দেশের বাইরে থেকে। তাই এর আমদানি বন্ধে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিপিএ বা বিসফিনল এ মানুষের শরীরে তিনভাবে প্রবেশ করে। এটি স্পর্শ করে মুখে হাত দিলে কেমিক্যালটি মুখে প্রবেশ করতে পারে। লোমকূপের মাধ্যমেও শরীরে প্রবেশ করতে পারে বিপিএ। আপনারা অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন, সুপার শপের রশিদগুলো কয়েকদিন রেখে দিলে এর কালি উঠে যায়। এই কারণে বিপিএযুক্ত রশিদ স্পর্শ না করে ঘরে রেখে দিলেও বিপদ। এটি বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে গিয়ে নিঃশ্বাসের সংগে পেটে প্রবেশ করে নানান ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে যাদের ঘরে শিশু ও বৃদ্ধ আছে তাদের এই রশিদ ঘরে না নেওয়াই উত্তম। কারণ এটি শিশুর ব্রেনে আঘাত করে।

তিনি জানান, থার্মাল পেপারের রশিদে বিসফিনল এ মূলতঃ ব্যবহার হচ্ছে কালি হিসেবে। এখানে আমাদের দেশীয় কাগজ ব্যবহার করলে এই কেমিক্যালযুক্ত কালি ব্যবহার করতে হতো না। কিন্তু আমাদের দেশীয় কাগজ অনেক মোটা হয় বলে সহজে ব্যবহার করার জন্য থার্মাল পেপার ব্যবহার করা হচ্ছে। ইচ্ছা করলেই এর সমাধান সম্ভব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল টক্সিকোলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন কেমিক্যাল মানবদেহে প্রবেশ করলে কিডনিতে গিয়ে ডিসপোজ হয়ে যায়। কিন্তু বিপিএ শরীরে থেকে যায়। বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেছে, বিপিএ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে শিশুদের মানসিক বিকাশে। এছাড়া সব বয়সীদের দেহে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো রোগ ছড়াতে পারে। কিডনিতেও এর বড় ধরণের প্রভাব পড়তে পারে।

বিপিএ একটি পলিকার্বনেট প্লাস্টিকজাতীয় কেমিক্যাল। এটি মানবদেহের পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটির ব্যবহার বন্ধে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমি পড়াশোনা করে এবং বিশেষজ্ঞদের সংগে আলোচনা করে যা জানতে পেরেছি তার ফলাফল অনেক ভয়াবহ। এই রশিদ চরমভাবে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি জনস্বাস্থ্যের অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। ইতিমধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।

সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে চেয়ে না থেকে দ্রুত মানুষের নিজে থেকে এই রশিদের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে গ্রাহকের নিরাপত্তায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল্প ভাবার পরামর্শ দেন সাবের হোসেন চৌধুরী।

বিভি/এমএস

মন্তব্য করুন: