• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

নামসর্বস্ব হাসপাতালের দুর্নীতির চিত্র: ৩য় এবং শেষ পর্ব

এখনো হাসপাতাল চালাচ্ছেন ড্রিল মেশিন দিয়ে অপারেশন করা সেই পিকে বাবু

সাদ্দাম হোসাইন ও আহসান হাবীব

প্রকাশিত: ১৮:০০, ৩০ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৪:১৪, ৩১ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ

ঢাকা হেলথকেয়ার হসপিটাল। রাজধানীর শ্যামলীর মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে অবস্থিত এই হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স না থাকলেও হাসপাতালটিতে রয়েছে দালালের উপদ্রব। আইসিইউ বেডের নামে রোগী জিম্মি করে অর্থ আদায়ই যেন হাসপাতালটির মূল উদ্দেশ্য।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত একাধিকবার হাসপাতালটিতে সরেজমিন পরিদর্শন করে বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানী টিম। এসময় একাধিক অনিয়ম ধরা পড়ে ক্যামেরায়। এসব অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে আর্থিক প্রস্তাবের পাশাপাশি মিডিয়ার লোকজন দিয়েও তদবির করেছেন হাসপাতালের মালিক বাবুল চন্দ্র পাইক ওরফে পিকে বাবু।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স না থাকায়, আইসিইউতে রোগী ভর্তি করে অযৌক্তিক অর্থ আদায় এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বাড়তি ফি আদায়সহ নানান অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে গত ১০ আগস্ট হাসপাতালটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু মাসখানেকের ব্যবধানে কোনো এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে ১৬ সেপ্টেম্বর আবারও হাসপাতাল কার্যক্রম চালু করার অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আর কোনো অনিয়ম করবে না বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েই পুনরায় চালুর অনুমতি পেয়েছে ঢাকা হেলথকেয়ার। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার পর আবারও আগের রূপে ফিরেছে হাসপাতালটি। এই দফায় বাংলাভিশন ডিজিটালের অনুসন্ধানী টিম পায় অনিয়মের নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রশ্ন হলো- এই অনিয়মের স্বর্গরাজ্য খ্যাত হাসপাতালটি কোন অদৃশ্য ক্ষমতার বলে এখনও চলছে?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা হেলথকেয়ার হসপিটাল নামের এই প্রতিষ্ঠানের মালিক পাইক বাবু এক সময় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের অর্থোপেডিক বিভাগে তাঁর নিকটাত্মীয় এক চিকিৎসকের ছত্রছায়ায় ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করতেন। সেখান থেকেই ওই হাসপাতালে আসা রোগীদের কমিশনের বিনিময়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ ওয়ার্ড বয় থাকাকালেই দালালির মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার সকল কলা-কৌশল রপ্ত করেন পাইক বাবু। এভাবেই কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। একই সময়ে পাইক বাবু থেকে নিজের নাম বদলে পিকে বাবু নামেই এখন সমধিক পরিচিত তিনি।

হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় থাকাকালেই দালালি শুরু করলেও কয়েক বছর পর নিজেই খুলে বসেন দালাল সর্বস্ব হাসপাতাল। ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভবনে গড়ে তোলেন ঢাকা হেলথকেয়ার হসপিটাল। রোগীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় কিনেছেন নিশান ব্র্যান্ডের দামি গাড়ি। সস্ত্রীক বিদেশে স্থায়ী বসবাসের সব প্রস্তুতিও নাকি শেষ পর্যায়ে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, স্ত্রীর চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনাও করছেন পাইক বাবু।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, এক সময় সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে পিকে বাবু নিজেই চিকিৎসা করতেন। অথচ তিনি চিকিৎসক নন, চিকিৎসা বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাঁর নেই। চিকিৎসক না হয়েও ২০১৪ সালে ড্রিল মেশিন দিয়ে রোগীর পায়ের অপারেশন করার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন পিকে বাবু ও তাঁর ভায়রা ভাই রতন কৃষ্ণ মজুমদার।

আরও দেখুন:

অনুসন্ধান বলছে, পিকে বাবু কিংবা পাইক বাবুর ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতাল চলে দালালদের দ্বারা ভাগিয়ে আনা রোগী দিয়ে। দেশের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালগুলোকে টার্গেট করে অ্যাম্বুলেন্স চালকরাই ওই হাসপাতালে রোগী এনে দেয়। বিনিময়ে রোগীপ্রতি দালালরা পায় পাঁচশো টাকা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর কাছ থেকে প্রাপ্ত বিলের ৩০ শতাংশ পায় দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

সম্প্রতি ঢাকা হেলথকেয়ার হসপিটালে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেরাই মারামারিতে জড়ায় দালালরা। ওই ঘটনার একটি ভিডিও পেয়েছে বাংলাভিশন ডিজিটাল। এতোসব অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি বাবুল চন্দ্র পাইক ওরফে পিকে বাবু।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, আবারও অনিয়মের প্রমাণ পেলে তদন্ত করে নেওয়া হবে ব্যবস্থা। সংস্থাটির হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন মিঞা বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমাদের কাছে তারা একটা আবেদন করেছে যে, তারা সমস্যাগুলো সমাধান করেছে। আমরাও প্রাথমিকভাবে সেগুলোর সত্যতা পেয়ে হাসপাতাল কার্যক্রম চালু করার অনুমতি দিয়েছি। তবে যদি আবারও অনিয়মের প্রমান পাই তাহলে আবারও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে নামে-বেনামে হাসপাতাল খুলে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ছলে যারা প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ইতিমধ্যে এমন একটি চক্রের সন্ধানও পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখছি যে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, যারা এখানে সেখানে হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে তুলেছে। এসব হাসপাতালে যারা বিভিন্ন সময় চিকিৎসা সেবা নিতে যায়, তাদের সংগে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নামে প্রতারণা করছে। এধরণের একটি চক্রের সন্ধান আমরা পেয়েছি। যারা এভাবেই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের ব্যাপারে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৫০ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া বেসরকারি হাসপাতাল খাতের বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী জবাবদিহিতার অভাব এবং কঠোর নজরদারির সংকট। এই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্র। তাই এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সুদৃষ্টির বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও দেখুন:

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, বাংলাদেশে প্রাইভেট খাতে যে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক গড়ে উঠেছে, সেখানে নানা ধরনের অনিয়ম পাওয়া যায়, প্রতারণা পাওয়া যায় এবং লোকজনকে সর্বস্বান্ত করার মত অবস্থা হয়। যেটাকে আমরা বলে থাকি “ক্যাটাসট্রপিক হেলথ এক্সপেনডিসার”। এটা দূর করতে হলে আমাদেরকে এ জায়গাটাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। রীতিমত একটি অধিদফতর করা দরকার।

একই কথা বললেন অপর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল খাতকে পরিচালনা, পর্যবেক্ষণ এবং নজরদারির জন্য যে কাঠামো, যে জনবল এবং যে বিন্যাস তার কোনোটাই তো নাই। যেসব জায়গায় পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহন এই সবগুলোই তো করতে হবে। কিন্তু এই কাজটি একজন হচ্ছে না। তাই এই অনিয়মগুলো দূর করার জন্য কাঠামোগতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এবং কর্তৃপক্ষের সামর্থটা বাড়াতে হবে। যেন তারা স্বাস্থ্যখাতের প্রতিটি হাসপাতালকে আইন অনুযায়ী সঠিক নজরদারি করতে পারে এবং যারা অনিয়ম করবে তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় এনে আইনি ব্যবস্থা মতে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন: ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে দালালসর্বস্ব ৭ হাসপাতালঃ জিম্মি রোগীরা

আরও পড়ুন: আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি করে টাকা হাতাচ্ছে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতাল

বিভি/এসএইচ/এএইচ/এসডি

মন্তব্য করুন: