• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়ে অপ্রতিরোধ্য চার সশস্ত্র সংগঠন, শান্তিচুক্তির পরও সহস্রাধিক খুন-গুম

এইচ এম প্রফুল্ল, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:১৬, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

আপডেট: ২২:২৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ফন্ট সাইজ
পাহাড়ে অপ্রতিরোধ্য চার সশস্ত্র সংগঠন, শান্তিচুক্তির পরও সহস্রাধিক খুন-গুম

ফাইল ছবি

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২ যুগ পার হলেও পাহাড়ে এখনও বন্ধ হয়নি অস্ত্রের ঝনঝানি আর হানাহানি। পাহাড়ী তিন জেলায় সশস্ত্র চারটি সংগঠনের আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষ। সেইসঙ্গে চলছে অবাধে চাঁদাবাজি। সর্বশেষ সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারালেন হাবিবুর রহমান নামে এক সেনা কর্মকর্তা। অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ চান সাধারণ মানুষ।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকার ও জনসংহতির সমিতির মধ্যে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে স্বাক্ষরিত হয়েছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। যা পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেন। কিন্তু একই দিন চুক্তির প্রত্যাখান করে সন্তু লারমার ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা। 

পরবর্তীতে তারই নেতৃত্বে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। চুক্তির পরবর্তী গত দুই যুগে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ ভেঙ্গে জেএসএস এমএন লারমা ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে চারটি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ভুক্তভোগীরা জানান, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎস্যজীবী, সড়কে চলাচলকারী সকল প্রকার যানবাহন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশীয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, জমি কেনা-বেচা, বাড়ি-ঘর নির্মাণ এমনকি ডিম-কলা বিক্রি করতে গেলেও চাঁদা দিতে হয় এই সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে। চাঁদা না দিলে চলে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যা। 

অভিযোগ রয়েছে, এই চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বছরে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করে। এসব অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান ভুক্তভোগীরা।

খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক সুদর্শন দত্ত বলেন, আধিপত্য বিস্তার সশস্ত্র গ্রুপগুলো চাঁদাবাজি ও অপহরণের প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও  প্রাণহানিতে লিপ্ত হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়ের উন্নয়ন ও শান্তির ধারা। 

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চার সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর এ পর্যন্ত সহস্রাধিক খুন হয়েছে এবং অন্তত ১৫শ’ জন গুম হয়েছেন। খুন হওয়া মানুষের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর সর্বশেষ শিকার গত ২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রুমায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান। এ সময় সেনাবাহিনীর আরো এক সদস্য ফিরোজ আহত হন। পাল্টা গুলিতে তিন সন্ত্রাসী নিহত ও সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। 
শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নয়, সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না স্থানীয় সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরাও।

জেলার মহালছড়ি সদর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে মেম্বার মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজি থেকে পাহাড়ি-বাঙালি কেউই রেহায় পাচ্ছে না।

নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র বলছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের ৪ সংগঠনের কাছে এসেছে ৫ শতাধিক আধুনিক মারণাস্ত্র। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এলএমজি, এসএমজি, একে৪৭ রাইফেল, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল, দেশীয় বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রকেট লাউঞ্চারসহ আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র।

পাহাড়ের ভৌগলিক অবস্থানকে পুঁজি করে দুর্গম এলাকায় ক্যাম্প গড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের যোগান বাড়াচ্ছে এসব সংগঠন এমন অভিযোগ রয়েছে। 

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে। তবে চাঁদা,অস্ত্রবাজির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন তিনি। 

অপর দিকে চাঁদা ও অস্ত্রবাজির কথা অস্বীকার করলেও কেউ আক্রমণ করতে আসলে প্রতিরোধ করার বা আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে বলে জানান জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের কেন্দ্রীয় কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা। 

খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা বেপোয়ারা হয়ে উঠেছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অস্থির পাহাড়ের মানুষ। সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনীকেও চ্যালেঞ্জ করছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর দাবী জানিয়ে বলেন, অন্যথায় পাহাড়ের পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নেবে।

নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হলেও আইনের মারপ্যাচে জামিনে গিয়ে আবার সক্রিয় হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। 
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ বলেন,আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জড়িতদের আইনের মাধ্যমে সাজাও দেওয়া হচ্ছে। 

এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে পাহাড়ে সম্প্রীতি বিঘ্নিত হবে বলে শংকা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিভি/এইচএমপি/এসডি

মন্তব্য করুন: