• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ছাই চাপা আগুন নিয়ে বেঁচে আছেন শহীদ জননী রোকেয়া 

মনোজ সাহা, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ফন্ট সাইজ
ছাই চাপা আগুন নিয়ে বেঁচে আছেন শহীদ জননী রোকেয়া 

৫০ বছর ধরে বুকে ছাই চাপা আগুন চেপে বেঁচে রয়েছেন শহীদ জননী রোকেয়া বেগম (৮৫)। মুক্তিযুদ্ধে বড় ছেলে মণি মিয়া শেখ শহীদ হয়েছেন। এছাড়া রোকেয়া বেগমের ৩ দেবর গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আব্দুল লতিফ শেখ, ব্যবসায়ী আব্দুল হাই শেখ ওরফে কুটি মিয়া ও আব্দুল আসাদ শেখ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। ছেলে ও দেবরদের কথা ভেবে তিনি এখনো শোকাতুর হয়ে ওঠেন। চোখের কোণে জমে বেদনার অম্রু। কান্না জড়িত কন্ঠে বর্ণনা করেন সেই ভয়াল দিনের কথা। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসলেই তিনি আরো বেদনা বিধুর হয়ে পড়েন। নাড়ি ছেড়া ধনকে হারিয়ে তিনি এখনো গুমরে কাঁদেন। পরিবারের এ প্রবীণ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে ৪ জনকে হারানোর বেদনা বুকে চেপে ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুপ্রেরণা দিয়ে বেঁচে আছেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মণি মিয়া শেখ, আব্দুল লতিফ শেখ, আব্দুল হাই শেখ ওরফে কুটি মিয়া ও আব্দুল আসাদ শেখের নাম গোপালগঞ্জ পদ্মপুকুর পাড় বধ্যভূমির স্মৃতি ফলকে স্থান পেয়েছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভেও তাদের নাম লেখা রয়েছে।

রোকেয়া বেগম বলেন, আমার দেবর আব্দুল লতিফ শেখ ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধু আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘোষেরচর দক্ষিণপাড়া গ্রামে অসংখ্য বার এসেছে। আমার শ্বশুর সলিম উদ্দিন শেখ ও শাশুড়ি জিন্নাতুন্নেছাকে পা ছুয়ে সালাম করেছেন। লতিফের সঙ্গে বসে আমাদের বাড়িতে  এক সঙ্গে খাবার খেয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ট আমাদের পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা শুরু করে। আমার স্বামী রুস্তুম আলী শেখ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেবর আব্দুল জলিলও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। আমাদের পরিবার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। আমার বড় ছেলে  মণি মিয়া শেখ সে সময় গোপালগঞ্জ এস.এম মডেল হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণিতে পড়তো। সুঠাম দেহের অধিকারি মণি মিয়াকে পরিবারের সবাই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মণি মিয়া রাজাকার ও পাকবাহিনীর খবরা খবর মুক্তিযোদ্ধাদের দিতো।  খাবার এগিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতো।

মণি মিয়ার চাচা আব্দুল হাই শেখ ওরফে কুটি মিয়া গোপালগঞ্জ শহরের চৌরঙ্গীতে ঔষধের ব্যবসা করতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা মূল্যে ঔষধ দিতেন। অপর চাচা আব্দুল আসাদ শেখ শহরে মুদি ব্যবসা করতেন। তিনিও দোকান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় মুদি ও মনোহারী সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করতেন। ১৯৭১ সালে জুন মাসের মাঝামাঝিতে সকালের দিকে বাড়ির পাশ থেকে মণি মিয়াকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে পাক বাহিনীর কাছে তুলে দেয়। এ দিন বিকালে মণি মিয়ার চাচা ঔষধ ব্যবসায়ী আব্দুল হাই শেখকে রাজাকাররা গিয়ে বলে তুমি ক্যাম্পে গিয়ে ধরা দিলে পাক বাহিনী ভাতিজাকে ছেড়ে দেবে। সরল বিশ্বাসে তিনি স্নেহ ভাজন ভাতিজাকে ছাড়াতে যান। কিন্তু তার পর থেকে আর মণি মিয়া তার চাচা আব্দুল হাই শেখের কোনো সন্ধান মেলেনি।

আগষ্ট মাসের দিকে মনি মিয়ার চাচা মুদি ব্যবসায়ী আব্দুল আসাদকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তিনিও নিখোঁজ হন। মণি মিয়ার চাচা বঙ্গবন্ধুর সহচর আব্দুল লতিফ শেখ ভরতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় টিম নিয়ে টিম লিডার হিসেবে আব্দুল লতিফ শেখ বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পাক বাহিনীর সঙ্গে তাদের টিমের একাধিক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কোনো একযুদ্ধে আব্দুল লতিফ শহীদ হন।

আমাদের পরিবারের ৪ শহীদের লাশ আমরা পাইনি। তাদের দাফন করতে পারিনি। এই বেদনা আমাকে ৫০ বছর ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কিছুই নেই।

তিনি আরো বলেন,৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচার নির্যাতনে আমাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বাড়ির ঘরের কৃষি ফসল, ধান, চাল, পাট, পেঁয়াজ, রসুন, শহরের ঔষধ ও মুদি দোকানের মালামাল লুটপাট করা হয়। লতিফ শেখের শহরের বাড়ি পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। ছেলে ও দেবরদের শোকে আমি টানা ২০ দিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায়  ছিলাম। আমাকে বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।  ৬ মাস পর আমি ঘোষেরচর গ্রামে ফিরে আসি তখন শুধুই বিরাণ ভূমি। বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি করে কান্না করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার ৩ টি ছেলে হয়েছে। তাদের মানুষ করতে শোক কিছুটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। আমার ১ মেয়ে ও ৭ ছেলে। মেয়ে সবার বড়। ছেলেদের মধ্যে মণি বড় ছিলো। আমার অন্য দেবরদের ছেলে ছিলো না। তাই তারা আমার ছেলেদের খুব আদর করতো। লতিফ মিয়া মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় মণিকে দেখে রাখতে বলেছে। দেবররা বলতো মণি বেঁচে থাকলে আমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল হবে। সেই আমাদের ভবিষ্যতের কান্ডারি হবে। মণিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সবাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। মণি মিয়াকে ছাড়িয়ে আনার জন্য রাজাকারদের প্রলোভনে পড়ে দু’ দেবর আব্দুল হাই শেখ ও আবদুল আসাদ শেখ শহীদ হয়।

ছেলেকে দেখে রাখতে পারিনি। মণি মিয়ার শোক আমি এখনো ভুলতে পারি না। চোখের সামনে সব কিছুই ভাসে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে আমরা ভাতা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। এ দেশের জন্য আমার পরিবারের সদস্যরা শুধু রক্তই দেয়নি, মরণপণ লড়াইও করেছে। আমরা সরকারের কাছে এই অবদানের স্বীকৃতি চাই। যথাযোগ্য মূল্যায়ন চাই। আমি এখন বার্ধক্য জনিত রোগে আক্রান্ত। ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারি না। এখন জীবন সায়হ্নে এসে পৌঁছেছি। জীবিত থাকতেই সরকার আমাদের পরিবারকে সঠিক মূল্যায়ন করলেই আমি খুশি হবো।  

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মণি মিয়ার ভাই এস.এম মাহফুজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভাই ও ৩ চাচাকে হারিয়েছি। আমাদের পরিবার চরম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছে। অস্থাবর সম্পদ হারিয়েছি। আমাদের সবাই বাংলাদেশের জন্য চরম আত্মত্যাগ করেছে। গণ মাধ্যমে আমাদের পরিবারের ইতিহাস কখনোই ফোকাসে আসেনি। আমরা প্রচার বিমুখ বিধায় এটি হয়েছে। আমার মা ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুপ্রেরণা দিয়েই বেঁচে আছেন। কিন্তু আমাদের দুঃখ হলো সঠিক মূল্যায়ন পাইনি। যথাযোগ্য মূল্যায়ন করা হলেই আমাদের স্বজন, সম্পদ হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের এই সরকারের কাছে শুধুমাত্র মূল্যায়ন দাবি করি। আর কিছুই চাই না।

গোপালগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কামান্ডার বদরুদ্দোজা বদর বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ওই পরিবার অসীম সাহসের সঙ্গে আত্মত্যাগ করেছে। একই পরিবার থেকে ৪ জন শহীদ হয়েছেন। হারিয়েছে সহায় সম্পদ। তাদেরকে সঠিক মূল্যায়নের দাবি অমূলক নয়।

বিভি/রিসি

মন্তব্য করুন: