• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

‘কষ্ট হয়েছে, তবুও হাল ছাড়িনি’

শাদমান শাবাব, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৫:৪৫, ২১ মার্চ ২০২২

ফন্ট সাইজ
‘কষ্ট হয়েছে, তবুও হাল ছাড়িনি’

মেয়ে কলেজে পড়লে তার বিয়ে দেওয়া যাবে না —সমাজে প্রচলিত এমনই এক ধারণায় একসময় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো শিল্পী খাতুনের পড়াশোনা। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শিল্পীর বাবাও চেয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষার পরে তার বিয়ে দিয়ে দিতে। প্রায় ৭ বছর আগে সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যখন বিয়ে হয়, তখন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শিল্পী খাতুন। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি-না এমন অনিশ্চয়তা থেকে স্বামীর সমর্থন আর নিজের হার না–মানা মানসিকতায় সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন তিনি। বর্তমানে একই বিভাগে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন শিল্পী।

শিল্পী খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার দাঁতপুর গ্রামে। তিনি জানান, কৃষক পরিবারে জন্ম তার। এলাকায় এক ধরনের রীতি ছিলো–মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর পর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার। সমাজে প্রচলিত এই রীতিমতো তার বাবাও চিন্তা করেছিলেন এসএসসি পাশ করার পরে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবেন। এতে তার উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এসএসসিতে ভালো ফলাফল করায় অনেক আকুতি করে বাবার কাছ থেকে মেলে কলেজে পড়ার অনুমতি। 

শিল্পী বলেন, এসএসসিতে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পাওয়ায় আমার বাবা বেশ খুশি হয়। তারপর বাবাকে অনেক জোরাজোরি করে কলেজে পড়ার অনুমতি পাই। ভর্তি হই বগুড়ার সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে। তখন এলাকার অনেকে বলতে শুরু করে কলেজে পড়লে মেয়ের বিয়ে হবে না কেউ বিয়ে করতে চাইবে না–এমন সব কথা। এদিকে, কলেজে ভালোই চলছিল আমার পড়াশোনা। কিন্তু ২০১৫ সালে ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার পর বাবা হঠাৎই আমার বিয়ের কথা বলেন।  

শুরুতে বিয়ের জন্য রাজি ছিলাম না। পরে পাত্র সিরাজুল ইসলামকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা জানাই। তিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত। উনি আমার কথায় রাজি হন। এরপরে বিয়েতে আর কোন আপত্তি ছিল না। বিয়ের পর স্বামীর চাকরির বদলিজনিত কারণে তার সাথে সিলেটে চলে আসি। এখান থেকেই এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমি আবার সিরাজগঞ্জে চলে যাই। এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে একদিন পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার সময় দূর্ঘটনার শিকার হই। ফলে সেদিনের একাউন্টিং কোর্সের পরীক্ষাটি ভালোভাবে দিতে পারিনি। যার কারণে এইচএসসি পরীক্ষায় এ–প্লাস পাইনি। 

শিল্পী খাতুন বলেন, এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর স্বামীকে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেন। স্বামী সিরাজুল ইসলাম জানান কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেই তিনি তাকে পড়াবেন। স্বামীর অনুমতি পাওয়ার ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করেন শিল্পী। কিন্তু সংসারের কাজ আর শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। ফলে প্রথমবার কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি। কিছুদিন পর আবার পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। 

তিনি বলেন, আমি যখন শাবিপ্রবিতে ভাইভা দিতে আসি তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার বিষয়টি কেউ যেন বুঝতে না পারে, সেজন্য আমি অনেকগুলো কাপড় গায়ে দিয়ে আসি। এভাবে চলছিলো আমার ক্যাম্পাস জীবন।২০১৭ সালের রমজান মাসে যখন আমাদের প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয়, তখন আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আমি তখন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে। আমার বিভাগের শিক্ষককে বিষয়টি জানানোর পরে আমার অনুরোধে তারা পরীক্ষার সময় একমাস পিছিয়ে দেন। ২০১৭ সালের মে মাসে আমার বাচ্চা হয় সিজারে। 

ওই সময়ে বিভাগের শিক্ষকদের আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করে শিল্পী বলেন, আমি যখন প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা দিতে বসি, তখন আমার সন্তান তালহা ইবনে সিরাজের বয়স ৩৬ দিন। পরীক্ষার সময়ে আমার শাশুড়ি তালহাকে নিয়ে কমন রুমে বসে থাকতেন। সে অনেক কান্না করত যার কারণে আমার একটু পরপর গিয়ে ওকে দেখে আসতে হতো। একদিন একটি পরীক্ষায় তালহা অনেক কান্না করছিল দেখে স্যার বলেন, তোমাকে আমি অতিরিক্ত সময় দিবো তুমি ওকে দেখে এসো। পরে স্যার আমাকে অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। শিক্ষক এবং বন্ধুরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। অনেক কষ্ট হয়েছে সেসময়গুলোতে, তবুও হাল ছাড়ি নি। স্বামীর সমর্থন, শিক্ষক আর বন্ধুদের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এতদূর আসা সম্ভব হতো না। 

পড়াশোনা শেষে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি–এমন প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী খাতুন বলেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসাথে দেশে থাকতে চাই। এখন আমার স্বপ্ন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের মানুষের সেবা করা। 

বিভি/রিসি

মন্তব্য করুন: