• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

এক নারী উদ্যোক্তার লড়াই

শিহাব হোসেন

প্রকাশিত: ১৪:৩৫, ২০ নভেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৪:৩৯, ২০ নভেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
এক নারী উদ্যোক্তার লড়াই

আশরাফুন নাহার তিতলি

৯ নভেম্বর -আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস। একজন পুরুষ হিসেবে নারী উদ্যোক্তা নিয়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। আমার মা’র দীর্ঘ সরকারি চাকরি জীবন ছিল। গতবছরই সেটা শেষ হয়েছে। বাবার অনেক দুঃসময়ে মা’র আয়টাই সংসার চালিয়ে নিয়েছিল। তিনি বাসে করে মিরপুর থেকে গুলিস্তানে গিয়ে দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর চাকরি করেছেন। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার নাইট ডিউটিতে রাত আটটায় বের হতেন। তিনিও কখনো না কখনো নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের বুঝতে দেননি। আমাদের সব আহ্লাদ আব্দার ছিল শুধু মার কাছে।

 

আমি আর আমার স্ত্রী দীর্ঘদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাংবাদিকতা করেছি। আট বছর আগে আমাদের বড় মেয়ে মেঘমালা তার পেটে আসে। পেটে বাচ্চা নিয়েই মৌচাকের ভাঙ্গা রাস্তায় ছয় নম্বর বাসে যাওয়া আসা করতো। এতে পেটের মেমব্রেন লিকেজ হয়। সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে পেশাটা ছেড়ে দেয় সে। মেয়েটার চার বছর বয়স হলে আবার কাজে ফেরে আমার স্ত্রী। এবার ভিন্ন ট্র্যাক। চাইল্ড এডুকেশন। না, টিচার নয়। বিভিন্ন স্কুল ঘুরে ঘুরে প্রজেক্টরে শো দেখানো, স্টাডি ম্যাটেরিয়াল ডিস্ট্রিবিউট ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার স্ট্যাবলিশ করা। পিঠে ইক্যুইপমেন্টের বিশাল ব্যাগ নিয়ে এ স্কুল থেকে সে স্কুল ছুটে বেড়াতো। নিজের কাজে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পরও বছর না ঘুরতেই চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। মেঘমালা প্রিম্যাচোয়র হয়েছিল। তাই একটুতেই তার হেলথ ফল করে। তার কথা ভেবে আবারো ঘরে ফেরা। 

এর বছরখানেক পরে বাচ্চাকে সাথে নিয়েই কিছু করার ইনটেশন থেকে সে একটা ডে কেয়ার সেন্টার দেয়। সাথে ছিলেন একজন পার্টনার। বাচ্চা সামলে ফাঁকে ফাঁকে সেন্টারের জন্য লোকেশন খোঁজা, কেনাকাটা, এম্প্লয়ি ইন্টারভিউ, গ্রুমিং, স্ট্যান্ডার্ড সেটিং, সিকিউরিটি গাইডলাইন তৈরি করা, কারিকুলাম রেডি করা, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, অ্যাডভারটাইজমেন্ট, অনলাইন প্রমোশন- দ্যা হোল নাইন ইয়ার্ড। সব রেডি, এবার বাচ্চা ভর্তির পালা। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ এসে ঘুরে যান। ভেতরের পরিবেশ আর প্ল্যানিং দেখে ইম্প্রেসড হলেও কোন বাচ্চা এখনো ভর্তি হয়নি শুনে আর কথা বাড়ান না। দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। ফ্লোরভাড়া, কর্মচারিদের বেতন, ইউটিলিটি বিল, সার্ভিস চার্জ সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ব্যয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। আমি সেন্টারে সরাসরি যুক্ত হইনি কখনো। কিন্তু আমার টেনশন হতে থাকে। তবে আমার স্ত্রী তখনও আশ্চর্য রকমের শান্ত আর আত্মবিশ্বাসী। এরপর হঠাৎ একদিন একটা বাচ্চা ভর্তি হয়। পরদিন দুইটা। দেখতে দেখতে ভরে যায় ডে কেয়ার। শুরু হয় আসল যুদ্ধ। ইনটেন্স গ্রুমিংয়ের পরও প্র্যাক্টিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স না থাকায় হিউম্যান এরর পুরোপুরি ঠেকানো মুশকিল হয়ে ওঠে। এদিকে পান থেকে চুন খসতেই তেড়ে আসেন অভিভাবকরা। তখনও আমার স্ত্রী পানির মতো শান্ত। মনদিয়ে গ্রুমিং চালিয়ে যায়। এবার শুধু এম্প্লয়ি নয়, অভিভাবকদেরও গ্রুমিং চলতে থাকে। আস্থার জায়গাটা পরিষ্কার করতে নানা রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্যারেন্টস এনগেজমেন্ট বাড়ানো হয়। টিচারদের এক একটি সেক্টর ধরে ধরে ট্রেনিং চলতে থাকে। আস্তে আস্তে অথরিটির ইনটেনশন অভিভাবকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তৈরি হয় আস্থা। 

মিরপুর সেন্টারের সফলতায় উত্তরার চার নম্বর সেক্টরে দ্বিগুন পরিসরে আরেকটি শাখার কাজ শুরু হয়। ইনভেস্টর জোগাড় করা, বাসা ভাড়া নেয়া, রং করা, কাঠের কাজ, এসি ফার্নিচারসহ প্রায় দশ লাখ টাকা ব্যয় করে যাবতীয় কাজ যখন শেষ, ওপেনিংয়ের আর মাত্র ১৫ দিন বাকি, ঠিক তখনই করোনায় লকডাউন হলো সারা দেশ। তালা ঝুললো দুটি সেন্টারেই। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলা যাচ্ছে না। মাস ছয়েক বন্ধ অফিসের ভাড়া দিয়ে যখন উত্তরা সেন্টারের অ্যাডভান্স শেষ, তখন বন্ধ করে দেয়া হয় সেন্টারটি। সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েও ওপেনিংয়ের মুখ দেখতে পারলো না সেন্টারটি। মিরপুরের শাখারও প্রায় যায় যায় অবস্থা। তৈরি করা এম্প্লয়িদের ধরে রাখতে অফিস বন্ধ থাকা সত্ত্বেও প্রতিমাসে সবার বেতন দেয়া হতো। এসময় আমার স্ত্রীকে একটু ঘাবড়াতে দেখেছিলাম। প্যানডেমিকের মতো আনপ্রেডিকটেবল অ্যাটাকের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। প্রায় দশমাস বন্ধ থাকার পর সেন্টার খোলা হয়। কিন্তু তখনও সবার আতংক না কাটায় অনেক অভিভাক আর ফেরেননি। গ্রামে চলে গেছে এম্প্লয়িদের কেউ কেউ। পুরনো যুদ্ধ নতুন করে শুরু। এরপর ধীরে ধীরে আবারো শক্তপায়ে দাঁড়ায় ‘সেন্টার ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি’ (সেন্টারটির নাম)। খোলা হয় কক্সবাজারে একটি শাখা। 

এরই মধ্যে আমার স্ত্রীর পেটে দ্বিতীয় সন্তান, আমাদের ছেলে অয়োময় আসে। পেটে বাচ্চা নিয়ে রিক্সায় অফিস যাওয়া আসা করতে থাকায় একদিন আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার ডেলিভারির আগ পর্যন্ত বেড রেস্টে থাকতে বললেও, অফিসের হাল ধরে রাখতে এক সপ্তাহ পরেই আবার যাওয়া আসা শুরু করতে বাধ্য হয় মেয়েটা। প্রায় দ্বিগুন ভাড়ায় অফিসের কাছে বাসা নেই আমরা। কিন্তু কাজের চাপে সে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে আর্লি কনট্রাকশান শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় একমাস আগেই ডেলিভারি করতে বাধ্য হন ডাক্তার। বাচ্চাটা এতো ছোট হয়েছিল যে, তার জন্য আটচল্লিশ ঘন্টা পিআইসিইউতে সার্ভাইভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এদিকে আমার স্ত্রীর পেটে ইনফেকশন ধরা পড়ে। হাসপাতালের খরচ যখন তিন লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায় তখন বাচ্চাকে পিআইসিইউতে রেখেই স্ত্রীকে বাসায় নিয়ে আসতে বাধ্য হই। প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে চারতলা বাসায় উঠেছিল। এরই মধ্যে প্রতিনিয়ত সে অফিসে ফোন করে খোঁজ নিত। বাসায় এম্প্লয়িরা আসত কাগজপত্র নিয়ে।  একপর্যায়ে বাচ্চা ও মা দুজনই সুস্থ হয়। কিন্তু পরবর্তি ছয়মাসে ছোট ছেলেটা আরো দুইবার পিআইসিউতে ভর্তি হয়, তিনবার নরমাল হাসপাতালে ভর্তি হয়, বড় মেয়ে ভর্তি হয় দুইবার। ডেলিভারির ছয়মাসের মাথায় আমার স্ত্রী’র অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন হয়। এর একমাস পরে করোনায় সিভিয়ার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেসময় আমার হাত ধরে বলেছিল আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। সুস্থ হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় তাকে ও দুই বাচ্চাকে রেখে গত ফেব্রুয়ারি আমি ইউরোপে আসি পড়তে। আজও সে একা দুই বাচ্চা এবং সন্তানতুল্য প্রতিষ্ঠানটাকে সামলাচ্ছে। এখন যে কাউকে মিরপুরে ভালো ডে কেয়ারের কথা জিজ্ঞেস করলে সবার আগে “সিসিডি”র নাম বলবে। এর পেছনের গল্পটার সাক্ষী একমাত্র আমি। এমনকি খুব কাছের স্বজনরাও এটা উপলব্ধি করেন না। তারা এখনো মনে করেন, এতো অফিস অফিস করার কি আছে? ওটা তো এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
এই ধারণাকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।
শেষে একটা কথা বলি। আমার স্ত্রীর অফিসে আমি ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফিসহ টুকটাক নানা কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম। অফিসের সবাই আমাকে জানতো মালিকপক্ষ হিসেবেই। কিন্তু অফিসে আমার স্ত্রীর চেয়ারে আমি কখনো বসতাম না। কারণ সেটা একটা ডেজিগনেটেড চেয়ার।
 লেখক : বাংলাভিশনের সাবেক স্টাফ রিপোর্টার

মন্তব্য করুন: