• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

টাঙ্গাইলে করোনাকালীন বন্ধে বাল্যবিয়ের শিকার ১২৪২ জন শিক্ষার্থী

আতাউর রহমান আজাদ

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৪:০৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
টাঙ্গাইলে করোনাকালীন বন্ধে বাল্যবিয়ের শিকার ১২৪২ জন শিক্ষার্থী

টাঙ্গাইলে এক হাজার ৬২৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৭৯৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলোর তালিকা অনুযায়ী জেলার ১২টি উপজেলায় করোনাকালীন বন্ধের সময় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন এক হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে এক হাজার ২৪০জন ছাত্রী ও দুই জন ছাত্র রয়েছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার লায়লা খানম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সব শুনেও ঠিক পরিসংখ্যান গোপন করে ভুল তথ্য প্রদান করছে। বাস্তবে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। শুধু মাধ্যমিকে নয় প্রাথমিকেও বাল্য বিয়ে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর। কিন্তু বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে কোনো শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিসার মো.আব্দুল আজিজ মিয়া।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মহামারি করোনা ভাইরাসে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ ও দারিদ্রতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়েছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। জেলা শিক্ষা অফিসের প্রাথমিক হিসাব মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে এক হাজার ২৪২ জন। বাস্তবে এর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। শহরের চাইতে গ্রাম ও চরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিয়ের পরেও পড়ালেখা করতে বিদ্যালয়ে আসছে অনেক শিক্ষার্থী। বাল্যবিয়ের শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরাঞ্চলের হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ জন, কালিহাতীর ফিরোজ নগরের গান্ধিনা এলাকার ফেরদৌস আলম ফিরোজ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪২ জন, ভূঞাপুর উপজেলার চরাঞ্চল গাবসারা ইউনিয়নের রায়ের বাসালিয়ার কুলসুম জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৮ জন, চরগাবসারা দাখিল মাদরাসার ৩০ জন, টেপিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ জন। এ রকম জেলার প্রতিটি বিদ্যালয়েই ২০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিয়ের পরে স্কুলে আসলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই আর স্কুলে আসছে না। শহরাঞ্চলে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ৮০-৯০ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে উপস্থিতির হার ৫০-৬০ শতাংশ। 

হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা এক হাজার ৫৫৬ জন। এর মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে ফরম পূরণ করেছে ৩৫৯ জন। বিদ্যালয়ের সব শ্রেণি মিলিয়ে প্রায় ৫০ শিক্ষার্থী'র করোনাকালীন সময়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। 

কালিহাতী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ফিরোজ নগরের গান্ধিনা এলাকার ফেরদৌস আলম ফিরোজ উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে ৪২ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। 

এছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয়গুলোতে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। 

শিক্ষকরা জানিয়েছেন, করোনাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিয়ে অনেকটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অনেকেই আবার নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন তাই পছন্দমতো ছেলে পেয়ে গোপনেই তাদের সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন। বাল্যবিয়ের শিকার অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে এবং পড়াশুনা করছে। বাল্যবিয়ে রোধে প্রশাসনের জোরালো পদক্ষেপ এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে বাল্যবিয়ের সংখ্যা অনেকাংশে কমে আসবে। 

গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া বাল্য বিয়ের শিকার এক স্কুল ছাত্রী জানায়, বাবা না থাকায় এবং পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মজীবী এক ছেলের সংগে তাকে ছোট বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয় বলে জানায় আকলিমা। 

একই স্কুলের দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী দোলা জানায়, ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করে অনেক বড় হয়ে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। পরিবারের ইচ্ছায় তাকে অল্প বয়সেই বিয়ে করতে হয়েছে। 

ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রার কাজী ইয়াদ আলী বলেন, করোনা'র কারণে একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে চরাঞ্চলে দরিদ্রতার কারণে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। এতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। গ্রাম্য ইমাম এই বাল্য বিয়ে পড়ান। এতে মেয়ের বয়স কম হওয়ায় কাজীদের কাছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যান না। ফলে বাল্যবিয়ের কোনো কাবিননামাও হয় না। এতে পরে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটলে কোনো প্রকার আইনি সহায়তাও পাবে না তারা।

করোনা মহামারিতে দেলদুয়ারে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক ছাত্রী। অপরিপক্ব বয়সেই কিশোরী বধূ সেজে সংসারের বুঝা মাথায় নিয়েছেন তারা। উপজেলার ২৭টির মধ্যে ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আড়াই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ের খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া নয়টি দাখিল মাদ্রাসার একটিতেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১৬ ছাত্রী।

এই নিয়ে শাফিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা তাহমিনা বেগম জানান, তার প্রতিষ্ঠানে শুধু এসএসসি পরিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই ১৪ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য শ্রেণির ঠিক তথ্য এখনও নিরূপন করা যায়নি। সবেমাত্র ক্লাস শুরু হওয়ায় সবাই শ্রেণিকক্ষে আসছে না। সবাই আসা শুরু হলে বাল্যবিয়ের সংখ্যা আরও বেড়েছে কি না জানা যাবে।

নলশোধা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মির্জা আখলিমা বেগম জানান, এই পর্যন্ত তিনি ২৯ ছাত্রীর বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছেন। সব শ্রেণির তথ্য পেলে সংখ্যাটি বেড়ে যেতে পারে। অভিভাবকদের অসচেতনতাই বাল্যবিয়ের কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেলায়েত হোসেন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহসান হাবীব জানান, তার প্রতিষ্ঠানের ৪১ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার।

এমএ করিম বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, নতুন ১০ম শ্রেণির ১২৮ ছাত্রীর মধ্যে আটজনের বিয়ের সংবাদ পেয়েছি। অন্য শ্রেণিগুলোর বাল্যবিয়ের সংবাদ নিরূপনের চেষ্টা চলছে।

ডা. এফআর পাইলট ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক নিলুফার ইয়াসমিন জানান, তিনি ২৩ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছেন।

এছাড়া এলাসিন নাছিমুননেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩০ জন, সুফিয়া কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৫, লাউ হাটী এমএএম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১, ড. আলীম আল রাজী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৭, মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৩, দেওজান সমাজ কল্যাণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়, সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় ও পড়াইখালী বালিকা দাখিল মাদ্রাসার ১৬ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের তথ্য জানা গেছে।

এই বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুজিবুল আহসান বলেন, উপজেলার ২৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টি ও নয়টি মাদ্রাসার মধ্যে একটির তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে দেখা গেছে ১২টি বিদ্যালয়ের ২৫৩ ও একটি মাদ্রাসার ১৬ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানের ঠিক তথ্য পেলে এই সংখ্যা তিনশো ছাড়িয়ে যাবে। করোনাকালে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সামাজিক কুসংস্কার ও অভিভাবকদের অসচেতনতাই বাল্যবিয়ের কারণ বলে জানান তিনি।

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় ঘাটাইল উপজেলার প্রাথমিকের ১৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির তিন জন এবং পঞ্চম শ্রেণির ১৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে জেলা শিক্ষা অফিসার মো.আব্দুল আজিজ মিয়া জানিয়েছেন, প্রাথমিকের কোনো শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়নি। এ ধরনের কোনো তথ্যও তার কাছে নেই।

বাল্য বিয়ের ঠিক পরিসংখ্যান দিতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনিহা দেখা গেছে। শিক্ষা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেও তেমন তোরজোর নেই। ভূঞাপুর শিক্ষা অফিস থেকে গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয় ও ফলদা শরিফুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাত্র ১৪ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে। 

ভূঞাপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহীনুর ইসলাম বলেন, ভূঞাপুরে ১৪ জনের বাল্য বিয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বলা হয়েছে কিন্তু তারা দিচ্ছে না। ঠিক সংখ্যা পেলে আপনাদের জানানো হবে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা খানম জানান, জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে এক হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। মধ্যে এক হাজার ২৪০ জন মেয়ে ও দুইজন ছেলে রয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, বিয়ে বন্ধ হওয়ার ভয়ে অভিভাবকরা গোপনে বাল্যবিয়ের মতো অপরাধ করে তাদের সন্তানকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মনে করেন এ শিক্ষা কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ জানান, বাল্য বিয়ে সম্পূর্ণ আইনের পরিপন্থি এবং বাল্য বিয়ে ঘটার আগেই তা রোধ করতে হবে। এই ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।



 

বিভি/রিসি 

মন্তব্য করুন: