• NEWS PORTAL

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

ইয়াবার কারবার: এক চালান হাত বদল হয় কয়বার? 

প্রকাশিত: ১৮:২০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৮:০৮, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
ইয়াবার কারবার: এক চালান হাত বদল হয় কয়বার? 

স্বামী মকুল ব্যাপারী ও স্ত্রী রত্না বেগম কক্সবাজার থেকে বিলাস বহুল একটি গাড়িতে চড়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তাদের সেই গাড়ি থামায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম। ডিবির ওই টিমের কাছে তথ্য ছিলো- টেকনাফ থেকে মকুল-রত্না দম্পতি পেটের ভেতর ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় ফিরছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে ওই গাড়িতে ঢুকে তাদের দু'জনকে আটক করে ডিবি। এই সময় তারা গাড়িতে উপস্থিত অন্য যাত্রীদের সামনেই ডিবির কাছে স্বীকার করে যে, তাঁদের দু'জনের পেটে সাড়ে ৫ হাজার ইয়াবা রয়েছে।

সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিলো যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিলো- এক দম্পতি বিলাসবহুল একটি গাড়িতে চড়ে ঢাকায় ফিরছে। তাঁদের পেটে রয়েছে ইয়াবা। আমাদের তথ্যদাতা ওই দম্পতির গাড়ির সিট নাম্বারসহ তথ্য নিশ্চিত করেছিলো। তাই আমরা যখন ওই দম্পতিকে অন্য যাত্রীদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করছি তখন তারা আমাদের উপর এক রকম বিরক্ত ছিলো। তারা তখন বলেছিলো এসব মিথ্যা কথা। পেটের ভেতর ইয়াবা কীভাবে আনা হয়। পেটের ভেতর ইয়াবা ঢুকালে কী মানুষ বাঁচে নাকি। এমনকি ইয়াবা তো দূরের কথা মকুল সিগারেটও খায় না। এমন সব কথাবার্তায় আমরাও কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। এতে ওই বাসের অন্য যাত্রীরাও আমাদের উপর চরম বিরক্ত। কিন্তু আমরা যখন আরও কৌশলী হয়ে আমাদের তথ্যদাতার কাছ থেকে পুনরায় নিশ্চিত হয়ে তাদেরকে বললাম, এখন স্বীকার করলে ছাড় পাবেন। কিন্তু যদি হাসপাতাল নিয়ে এক্সরে করি তখন ধরা পরলে ছাড় পাবেন না, এমন কথা শুনে তারা অকপটে সব স্বীকার করে।

মকুল জানায়, তার পেটে তিন হাজার এবং তার স্ত্রীর পেটে আড়াই হাজারসহ মোট সাড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবা রয়েছে। তাদের এমন স্বীকারোক্তিতে অন্যান্য যাত্রীরাও বিস্মিত।

ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, এর আগেও তারা ইয়াবা এনেছিলো টেকনাফ এলাকা থেকে। তবে তারা যার কাছ থেকে আনতো সেই ব্যক্তির সংগে তাদের কখনও সামনা-সামনি দেখা হয়নি। অন্য আরেকজন ব্যক্তির মধ্যস্ততায় তারা এই ইয়াবা এনেছিলো। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অন্য টিমের সহযোগিতায় টেকনাফের ওই ব্যক্তির সন্ধানে নামলেও তাকে পাওয়া যায়নি। আগেই পালিয়ে গেছে সে। এমন পরিস্থিতিতে এই ইয়াবার মূল হোতা কে তা আর চিহ্নিত করা যায়নি। এমনকি তারা কাদের কাছে এই সব ইয়াবা সরবরাহ করতো সেই তথ্যও সঠিকভাবেও জানায়নি। মূলত সমস্যা হয়, আমরা যেসব মাদক কারবারীকে ধরি তাদের অধিকাংশই তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরের। ধরুন, একটা চালান টেকনাফ থেকে ঢাকায় ঢুকবে। এই চালান অন্তত চার থেকে পাঁচটি দলের হাত বদল হবে। এরপরই গ্রাহক বা মূল ক্রেতার কাছে পৌঁছায়। আবার এসব দল একে অপরকে চেনে না। তারা শুধু ইয়াবার চালান একটা দলের কাছ থেকে আরেকটা দলের কাছে পৌঁছে দেয় চুক্তিভিত্তিক টাকার বিনিময়ে।

ডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মাঠ পর্যায়ে একটা ইয়াবা বিক্রি হয় সর্বনিম্ন ২০০ টাকায়। সেই হিসেবে সাড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবার দাম পড়ে প্রায় ১১ লাখ টাকার মতো। তারা এই ইয়াবার যে চালান পেটে করে নিয়ে যাচ্ছিলো, সেটা অপারেশন করে পেট থেকে বের করতে খরচ হবে ২০-৫০ হাজার টাকা। আর এই চালান কিনতে হয়তো খরচ হয়েছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা। তাহলে তারা চিন্তা করলো, সব কিছু বাদ দিয়ে তাদের লাভ থাকছে প্রায় সাত লাখ টাকার মতো। মাত্র ৫ হাজার ইয়াবাতে যদি সাত লাখ টাকা লাভ থাকে তাহলে এমন ঝুঁকি তারা তো নেবেই!

এতো গেলো মকুল-রত্না দম্পতির ইয়াবা পাচারের গল্প। একইভাবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পেটের ভেতর সাড়ে ৮ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে কাজী কামরুল, শেখ হৃদয়, ওমর ফারুক ও হাবিবুর রহমান নামের চার মাদক কারবারি। তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা ও এক্স-রে করে পেটের ভেতর ইয়াবার সন্ধান পায় র‌্যাব। কিন্তু তারা কার কাছ থেকে এই ইয়াবা এনেছিলো তা নিশ্চিত হতে পারেনি র‌্যাব-১০।

এই বিষয়ে র‌্যাব-১০ এর সহকারি পুলিশ সুপার এনায়েত কবীর সোয়েব বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, তারা পেটের ভেতর ইয়াবা নিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে উত্তরবঙ্গের দিকে যাচ্ছিলো। এই সময় আমাদের একটি টিম তাদেরকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তারা কার কাছ থেকে এই ইয়াবা পেয়েছে বা কাদের কাছে এগুলো আবার সরবরাহ করবে সেই তথ্য সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি। তারা শুধু জানিয়েছে, অপরিচিত একজনের কাছ থেকে তারা এগুলো গ্রহণ করেছে। মূলত তারা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হওয়ায় সঠিক তথ্য দেয় না। এতে করে মূল হোতা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়।

র‌্যাব সদর দফতর সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে লকডাউনের মধ্যেও ৮ লাখ ২১ হাজার ১৯ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট। পরের মাসে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো দিগুণে। অর্থাৎ আগস্ট মাসে ইয়াবার জব্দ করা হয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৫১২ পিস।

এতো ইয়াবা জব্দ হলেও কতজন মূল হোতা ধরা পড়েছিলো এসব অভিযানে? এমন প্রশ্ন ছিলো র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন- এর কাছে। তিনি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, মূল হোতা যে একেবারেই ধরা পড়ে না, তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। কিন্তু আমাদের বড় চ্যালেঞ্জটা হলো যাদের কাছ থেকে এই ইয়াবার চালান ধরা পড়ে তারা হয় তৃতীয় বা চতুর্থ বাহক। তাই যিনি প্রথম বাহক, মিয়ানমার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত এই চালান পৌঁছে দিয়েছে তাকে আর আমরা ধরতে পারি না। আবার অনেক সময় গ্রেফতারকৃতরা যেই তথ্য দেয়, সেই তথ্যের ব্যক্তিকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ধরা যায় না। আসামিরা বলে, আমরা অমুকের কাছ থেকে এনেছি। তো যখন সেই অমুক ব্যক্তিকে ধরা হয় তিনি তখন বলেন, আমিও অমুকের কাছ থেকে এনেছি। অমুক আমাকে শুধু প্যাকেটটা অমুকের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছে এতো টাকার বিনিময়ে। আমিতো শুধু প্যাকেটটা পৌঁছে দিয়েছি টাকার বিনিময়ে। আমি ওই ব্যক্তিকে তো চিনি না। এমন পরিস্থিতিতে মূল হোতাকে ধরা যায় না।

তিনি বলেন, আমরা মূলত সেই জায়গাতেই বেশি কাজ করার চেষ্টা করছি যেন মূল হোতাকে ধরতে পারি। কিন্তু এটি প্রমাণ সাপেক্ষ হওয়ার চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। তবুও আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

একই কথা বললেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার। তিনি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, প্রতি সপ্তাহে দু'য়েকটা চালান ধরা পড়ে আমাদের অভিযানে। কিন্তু যারা ধরা পড়ে তারা হয় মিডল পয়েন্ট অথবা লাস্ট পয়েন্টের। অর্থাৎ আমাদের কাছে যারা ধরা পড়ে তাদের আগে পিছে আরও অনেকেই জড়িত এই মাদক কারবারে। কিন্তু তারা সেসব ব্যক্তিদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে না। যে কারণে আগে-পিছে কারা তাদেরকে খুঁজে বের করাটা অনেক সময় হয়ে উঠে না। তবে আমাদের চেষ্টা তো অবশ্যই মূল হোতাদেরকে ধরা। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা।

তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ নেশাগ্রস্থ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি প্রতিদিন একটা করেও ইয়াবা সেবন করে তাহলে সেই সংখ্যা কতো চিন্তা করেন। তাই মূল হোতাদের চেয়ে যদি এই চাহিদাটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবেই ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তা না হলে আমরা রমনা থেকে দশজন মাদক কারবারিকে ধরলাম, কিন্তু গ্রাহক তো ঠিকই যাত্রাবাড়ী থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করবে। কাজেই আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় ইয়াবা সেবনকারীদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

বিভি/এমএস

মন্তব্য করুন: