ইরানে হামলায় ট্রাম্প শিবিরে ফাটল, তেল আবিবকে ঠেকাতে কী করবে তেহরান?

ইরানে ইসরাইলের হামলায় অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া নিয়ে টানটান এক দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার দশায় পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই সমর্থন দেয়া নিয়ে স্পষ্টত দুই ভাগ হয়ে পড়েছে রিপাবলিকান শিবির।
দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পরপরই মার্কিন ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধে কাজ করবেন তিনি। শান্তি ও ঐক্য স্থাপনকারী এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের আদর্শ রেখে যাবেন। কিন্তু তার ক্ষমতায় বসার ৬ মাসের মধ্যেই ইসরাইল ইরানে ভয়াবহ হামলা চালালো এবং তাতে জোরালো সমর্থন দিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও ভয়াবহ এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ইসরাইলকে ইরানে হামলায় সমর্থন দেয়া ট্রাম্পের এই অবস্থান তার পূর্ব-প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করছেন অনেক রিপাবলিকান। ডানপন্থী এই রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বলছেন, ইসরাইলকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়া ‘অ্যামেরিকা সবার আগে’ ট্রাম্পের এই নীতির পরিপন্থী। এই প্রচারণা চালিয়েই ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেছেন।
কূটনীতিবিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের এক্সেকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলছেন, অ্যামেরিকা ফার্স্ট নীতির পক্ষের রিপাবলিকানরা এখন রীতিমতো প্রতারিত বোধ করছেন, কারণ তারা ইসরাইল হোক বা যে কোনো দেশ, অন্যদের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বা জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে। এর আগে এ ধরনের অনন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণেই বুশের মতো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরা ব্যর্থ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বিশ্বাস করে এই অংশ।
ট্রাম্পের অতি ঘনিষ্ঠ টাকার কার্লসন। মেইক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেইন প্রচারণার পক্ষে কাজ করা প্রভাবশালী এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বও ইসরাইলের ইরানে হামলায় ট্রাম্পের সমর্থন জানানোর জোর বিরোধিতা জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন, যুদ্ধের জন্য ক্ষুধার্ত নেতানিয়াহুর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বা সহায়তা দেয়া উচিত নয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ নেই।
কার্লসন বলেন, ইরানের সাথে যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মে সন্ত্রাসবাদ উস্কে দিতে পারে, অন্য দেশের এজেন্ডায় অংশগ্রহণের মূল্য হিসেবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারে হাজার হাজার মার্কিনী। ইসরাইলকে পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন কার্লসন।
ট্রাম্পের আরেক কট্টর সমর্থক, রিপাবলিকান রেপ্রেজেন্টেটিভ মার্জরি টেইলর গ্রিনও ইরানে হামলার প্রশ্নে ইসরাইলের প্রতি বিরূপ। এর আগে ইসরাইলের কথায় ইরানে হামলা না চালানোর ব্যাপারে ট্রাম্পকে সতর্ক করেন তিনি।
এছাড়া রিপাবলিকান সেনেটর র্যান্ড পলসহ এই শিবিরের আরো অনেক আইনপ্রণেতা, রাজনীতিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার বিপক্ষে। ইসরাইলকে ব্ল্যাংক চেক দিতে নারাজ তারা।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, গাজা যুদ্ধের নৃশংসতার প্রেক্ষাপটে দিন দিন তরুণ রিপাবলিকান সমর্থদকের মধ্যে ইসরাইলের গ্রহণযোগ্যতা কমছে। তবে রিপাবলিকানদের অন্য অংশ যে কোনো অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে থাকুক, এমনটিই চাইছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পকেও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখা যাচ্ছে। একবার তিনি ইরানের সাথে সমঝোতা চুক্তির ওপর জোর দিচ্ছেন তো পর মুহূর্তে ইসরাইলের হামলার ভূয়সী প্রশংসা করছেন। এরপর আবার বলছেন, এই সংঘাত বন্ধ হওয়া উচিত। এ অবস্থায় শেষমেশ চূড়ান্তভাবে তিনি কোন নৌকায় পা দেবেন, সেটাই চলমান সংঘাতের ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
এদিকে ইসরাইলের চলমান এই ভয়াবহ হামলা মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে ইরানের সামনে কী কী পথ খোলা আছে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা। সম্ভাব্য বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
পরমাণু বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কর্মকর্তা অ্যালেন এয়ার বলছেন, ইসরাইল যদি এভাবে জোরালো বিমান হামলা চালিয়ে যেতে থাকে, তা হবে ইরানের জন্য দুর্দশার। এর বিপরীতে দেশটির হাতে খুব সীমিত বিকল্প আছে।
অ্যালেন বলেন, দেশবাসীর কাছে মুখ রক্ষার জন্য হলেও ইসরাইলের হামলার বিপরীতে ইরান সরকারকে পাল্টা হামলা চালাতে হবে। তবে সম্ভবত তাতেও তারা ইসরাইলের তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি করে উঠতে পারবে না, যাতে করে নেতানিয়াহু বাধ্য হন হামলা বন্ধ করতে।
এ বিশ্লেষকের মতে, এ অবস্থায় সংঘাত বন্ধে ইরান কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মহলে তাদের খুব বেশি মিত্র নেই। এ বাদেও এ ক্ষেত্রে তারা যদি সফলও হয়, ইসরাইল যখন বলছে, তাদের এই হামলা বৈধ, সে ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় ইরানের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো পরিস্থিতির সাথে ভেসে চলা এবং নিজেদের মুখ রক্ষায় যতোটা সম্ভব ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত করা।
এরপর ইসরাইল যখনই চলমান হামলা বন্ধ করবে, দ্রুততার সাথে নিজেদের সামরিক রসদ বাড়ানো এবং নতুন প্রতিরক্ষার কৌশল নিয়ে এগোনো। সম্ভবত পরমাণু অস্ত্র তৈরিও সেই প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হবে বলে মনে করেন অ্যালেন এয়ার।
বিভি/এইচজে
মন্তব্য করুন: