নারীর কণ্ঠে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
জাতীয় নারীশক্তির উদ্যোগে শনিবার (৮ নভেম্বর) বেলা ৩টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘নারীর কণ্ঠে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার শুরুতে নারী শক্তির পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। এতে বলা হয়-
জাতীয় নারীশক্তির পক্ষ থেকে সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা৷ আপনারা সবাই অবগত আছেন রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ এক বছরের আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। ইতিমধ্যেই অধিকাংশ রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা না থাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তথা সনদের সাংবিধানিক ভিত্তির নিশ্চয়তা পেলে আমরা অবশ্যই স্বাক্ষর করবো। এনসিপির এই অনমনীয় অবস্থানের ধারাবাহিকতায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের দুটি সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে।
সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে পুরো জাতিকে সাক্ষী রেখে সমস্ত রাজনৈতিক দল তিনটি ধাপে একমত হয় যার মূল কথা ছিল গণভোট তথা গণরায়ের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হবে। বিদ্যমান সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকায়, “জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ” নামে একটি আদেশ জারি করা হবে এবং সেই আদেশের ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়। গণভোটের রায় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নী ক্ষমতার পাশাপাশি আগামী সংসদকে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করার গাঠনিক ক্ষমতা প্রদানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হয়।
তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার জন্য ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। এতে করে সনদ বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ইতিমধ্যেই সারা দেশে নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণভোটের ব্যাপারে সম্মতি দিয়ে এসে এখন অস্বীকারের দুরভিসন্ধি করছে।
আমাদের দলের পক্ষ থেকে দুটি সহজ ও স্পষ্ট দাবি তোলা হয়েছে। এক, গণঅভ্যুত্থানের গণঅভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিসেবে জুলাই সনদ আদেশ জারি করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস; দুই, গণভোটের রায় হবে বাধ্যতামূলক; পরবর্তী সংসদ এই রায় কেবল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে মাত্র, গণরায়ের ওপর দলীয় মতামত প্রাধান্য পাবে না।
প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক আদেশ জারিকরণ: আইনি ও নৈতিক বিবেচনা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ছিল একটি অতি-সাংবিধানিক (extra-constitutional) ঘটনা। গণঅভ্যুত্থানের গণশক্তি ওই সরকারকে উৎখাত করেছে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় প্রকাশিত ও গঠিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে শপথ গ্রহণ করলেও, এই সরকারকে ‘সাংবিধানিক’ সরকার বলার সুযোগ নাই কারণ সংবিধানের অন্তত অর্ধশতাধিক ধারা লঙ্ঘন করেই বর্তমান সরকার পরিচালিত হচ্ছে। তদুপরি বাহাত্তরের সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা’ সরকারের কোনো বিধান নাই। কাজেই গণঅভিপ্রায় (people’s will) বর্তমান সরকারের মূল ভরকেন্দ্র।
এতে করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে একটা বিশেষ এবং ব্যতিক্রম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নতুন এক সার্বভৌম ক্ষমতা কাঠামোর প্রয়োজন হয়৷ সে প্রয়োজন পূরণে এই বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে অভ্যুত্থানের বিজয়ী শক্তির আকাঙ্খা অনুযায়ী গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামে অতিসাংবিধানিক এই সরকার দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সরকারও জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের আশা আকাঙ্খাকে পুনঃব্যক্ত করেছে। এক কথায় গণঅভ্যুত্থানে জনগণের যে সার্বভৌম ক্ষমতা ও আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সেই আকাঙ্খাকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।
এই সরকার জনগণের আকাঙ্খা পূরণে ঐক্যমত কমিশনের মাধ্যমে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাক্ষর করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারে সম্মত হয়েছে।
অধ্যাদেশ নয়, আদেশ
এনসিপির অন্যতম প্রধান হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আইনগত দলিল প্রণয়ন করা হবে, তা অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) নয়; বরং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা একটি আদেশ (অর্ডার) হিসেবে বিবেচিত হয়। আদেশ-অধ্যাদেশের এই পার্থক্যটি কেবল একটি কারিগরি বিষয় নয়। এর সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক তাৎপর্য রয়েছে। যদি জুলাই সনদের সংস্কারগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করা হয়, তাহলে তা স্বাক্ষর ও ঘোষণার দায়িত্ব বর্তাবে রাষ্ট্রপতির ওপর, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের চেতনার অংশ তো ননই; বরং শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বহন করেন। ফলে তিনি সেই জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন না, যাদের গণ-সাংবিধানিক ক্ষমতার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান সংবিধানের অধীনে অধ্যাদেশ জারি হয় অনুচ্ছেদ ৯৩-এর ভিত্তিতে, যা এ দলিলকে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনস্থ করে তুলবে। কিন্তু জুলাই সনদে যে সংস্কারগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে চায়। অর্থাৎ- এমন মৌলিক পরিবর্তন বাস্তবায়নের আইনি দলিল যদি বিদ্যমান সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে তা একধরনের আইনি অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করবে। আমাদের যুক্তি মোতাবেক জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রণীত দলিলটি প্রচলিত সাংবিধানিক শৃঙ্খলা থেকে নয়; বরং জনগণের গণ-সাংবিধানিক ক্ষমতা (গাঠনিক ক্ষমতা) থেকে তার বৈধতা আহরণ করতে হবে। এটি সেই জনগণের ক্ষমতা, যা পূর্ববর্তী সরকার ও শাসন শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রণীত আইনগত দলিলটি বর্তমান সংবিধানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
এ কারণে আমরা দৃঢ়ভাবে দাবি করছি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আইনি দলিল জারি করা হবে, তা যেন একটি ‘আদেশ’ আকারে হয়, যা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। এটি নিছক একটি প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রশ্ন নয়; এটি গভীরভাবে বৈধতার সাথে সম্পর্কিত। অন্তর্বর্তী সরকার এবং এর নেতৃত্বদানকারী প্রধান উপদেষ্টা তাদের কর্তৃত্ব পুরনো সংবিধান থেকে নয়; বরং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে অর্জন করেছেন। অতএব, প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরিত যেকোনো আদেশও সেই একই জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে তার বৈধতা পাবে। এটি হবে জনগণের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি সাংবিধানিক পদক্ষেপ, পুরনো সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীন কোনো দলিল নয়। সুতরাং, এটি বিদ্যমান সংবিধানের ‘অধীনস্থ’ কোনো দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এ পদ্ধতিই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে, জুলাই সনদ সত্যিকার অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে এবং পুরনো শাসনব্যবস্থার আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
অর্থাৎ, গণভোটের সময় নিয়ে চলমান বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কে জারি করবেন এবং গণভোটের রায় বাধ্যতামূলক করার প্রশ্ন। এই দুই প্রশ্নকে এড়িয়ে গৌণ তর্ককে প্রধান তর্ক করে তুললে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।
কাজেই জাতীয় নারীশক্তি মনে করে, অবিলম্বে সরকারকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং গণভোট আয়োজনের পথ সুগম করতে হবে। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, কৃষক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা, লেখক মারদিয়া মমতাজ, জামায়াতে ইসলামির কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাবেকুন্নাহার মুন্নী, নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির প্রধান তাসলিমা আখতার, জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাজনূভা জাবীন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব কাজী জেসিন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নারী বিষয়ক সম্পাদক জাকিয়া শিশির, দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার জাইমা রহমান, আপ বাংলাদেশের মুখপাত্র শাহরিন ইরা, চ্যানেল ২৪ এর সিনিয়র রিপোর্টার জুম্মাতুল বিদা, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সাবেক মুখপাত্র আশরেফা খাতুন প্রমুখ।
বিভি/এআই




মন্তব্য করুন: