চীনে মধ্য শরতের পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় পারিবারিক উৎসব
বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয় চীনে। এরমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হল মধ্য শরৎ উৎসব। উৎসবটি পালিত হয় প্রতি বছর চন্দ্র বর্ষের অষ্টম মাসের ১৫তম দিনে। চাঁদকে ঘিরেই মূলত চীনে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। চীনা সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে চাঁদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদের মুভমেন্টের সাথে এই উৎসবটি জড়িত। চীনারা বিশ্বাস করে মধ্য শরতের পরিপূর্ণ চাঁদের উজ্জ্বল আলো পারিবারিক মিলনের প্রতীক। শরতের উজ্জ্বল আলো সফলতা বয়ে আনে। এ বছর মধ্য শরৎ উৎসবের দিন ছিল ১০ সেপ্টেম্বর।
উৎসব পালনের জন্য সিআইপিসিসি কোর্সের সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় বেইজিংয়ের প্রিন্স জুন’স ম্যানশন হোটেলে। শরতের শান্ত ও মনোরম আবহাওয়া গ্রীস্মের গরমকে গ্রাস করেছে। অত্যন্ত আরামদায়ক পরিবেশ। এমনি সোনালি বিকেলে আমরা হাজির হলাম প্রিন্স জুন’স ম্যানশন হোটেলে। এটা আসলে তথাকথিত কোন হোটেল নয়।
ছিং সাম্রাজ্যের একজন শাহজাদার প্রাসাদকে হোটেলে রূপান্তর করা হয়েছে। এর অবস্থান চাওইয়াং ডিস্ট্রিক্ট পার্কে। পার্কে মানে তো বোঝাই যায় চারদিকে সবুজ গাছগাছালি, ফুল, ফলে শোভিত একটি এলাকা। মূল রাস্তা থেকে ম্যানশনে যেতে প্রাচীন আমলের একটি বিশাল গেট পারি দিতে হয়। এরপর খানিকটা খোলা চত্বর।
তারপরই একতলা বিশিষ্ট জুন’স ম্যানশন। প্রথমেই একটি হল ঘর। তারপর ভেতরের দিকে একটি বড়সর করিডোর মত। এর তিনপাশ দিয়ে কামড়া। হল ঘরেই আমাদের মূল প্রোগ্রাম। বাইরের খোলা চত্বরে চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট অনেকগুলো খোলোমেলা স্টল বসেছে।
আমাদের দেশের মেলার মত করে। এসব স্টলের কোনটায় শিল্পী একমনে পেইন্টিং করে চলেছে, কোনটায় তৈরি হচ্ছে মুন কেক, কোনটায় আবার প্রদর্শনী চলছে নানা জাতের চা পাতার। এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা। শেষে সন্ধ্যায় শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুয়া চুন ইং। উদ্বোধন ও বক্তৃতা পর্বের পর পরিবেশিত হয় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মধ্য শরৎ উৎসবের মূল আকর্ষণ হল মুন কেক। এ উপলক্ষ্যে তৈরি হয় নানা জাতের বিভিন্ন পদের কেক। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ক্যান্টোনিজ, বেইজিং ও শুচৌ বৈশিষ্ট্যের কেক। ক্যান্টোনিজ কেকের উৎপত্তি দক্ষিণ চীনে। এর বিশেষত্ব হল এটি মিষ্টি, ঘন লোটাস বীজ, মিষ্টি শিম ও বাদামের পেস্টি দিয়ে তৈরি, এর ওপর থাকে একটি পাতলা, কোমল পেস্ট্রির ত্বক। শুচৌ স্তর বৈশিষ্টসিম্পন্ন কেক। এটা মিষ্টি, টক দুরকমই হয়। পাথুরে চিনি, মিষ্টি গন্ধের ওসমানথুস (একধরনের ফুল), আখরোট ও কুমড়ার বিচি দিয়ে তৈরি হয় বেইজিং বৈশিষ্ট্যের কেক। জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এই কেকগুলোর আকার-আকৃতিতে যেমন ভিন্নতা রয়েছে তেমনি স্বাদেও রয়েছে বৈচিত্রতা।
মধ্য শরৎ উৎসবে এগুলোকে ডাকা হয় মুন কেক নামে। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি অতিথিদের এই কেক দিয়ে আপ্যায়ণ করে চীনারা। কেকের যে এতো ধরণ হতে পারে তা এই প্রথম দেখলাম। শুধু দেখলাম বললে ভুল হবে। মোটামুটি সবগুলো পদের মধ্যে যতগুলোর সম্ভব স্বাদ পরখ করার ব্যাপারটি হাতছাড়া করতে মন সায় দিল না। সাথে ছিল নানা ধরনের পানীয়। আমি অবশ্য বরাবরের মত সফট তথা কোমল পানীয়তেই আস্থা রাখলাম।
সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলার কথা থাকলেও সবার মধ্যে এতোটাই উৎসাহ-উদ্দীপনা যে সারারাত ধরে চললেও তাতে তাদের আপত্তি নেই বা থাকবে না। চীনের ট্র্যাডিশনাল সংগীত ও নানা ধরনের ইন্সট্রুমেন্টের পারফরমেন্স পরিবেশন করলেন মূল শিল্পীরিা। তাদের পরিবেশনা শেষে আমাদের কোর্সের বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিনিধিরা গান গাওয়া শুরু করে। সাথে তালে তালে নাচ। মোটামুটি আরও ঘণ্টা খানেক চলে অনুষ্ঠান।
সবকিছু মিলে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে মধ্য শরতের এই উৎসব। শেষে রাত ন’টার দিকে প্রিন্স জুন’স ম্যানশনকে বিদায় জানালাম আমরা। জুন’স ম্যানশন ১৬৪৮ সালে ছিং সম্রাটদের আমলে নির্মিত। বিখ্যাত ছিং অধিপতি আইসিন কিওরো নুরহাচির দৌহিত্র প্রথম ছিং শাহজাদা প্রিন্স শুনচেং এর নামানুসারে এই ম্যানশন বা প্রাসাদের নামকরণ করা হয়।
ছিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় শাহজাদা শুনচেং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই ম্যানশন বা প্রাসাদেই বসবাস করতেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ম্যানশনটি বেইজিংয়ের শিচেং ডিস্ট্রিক্ট থেকে সরিয়ে চাওইয়াংয়ের বর্তমান জায়গায় অবিকল প্রতিস্থাপিত হয়। ছিং সাম্রাজ্যের যে আটটি প্রাসাদ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বর্তমানে এটি হোটেল হিসেবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। বিভিন্ন ধরনের উৎসব, বিবাহ-পার্বনসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান এখানে আয়োজন করা হয়।
প্রতিটি উৎসবের জন্ম ঘিরেই থাকে নানা ধরনের উপকথা, রুপকথা, মিথ, কুসংস্কার বা বিশ্বাস। চীনের মধ্য শরৎ উৎসব নিয়েও রয়েছে একটি রুপকথা। মধ্য শরৎ উৎসবের উৎপত্তি তাং সম্রাটদের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ৬১৮-৯০৭)। সুং আমলেও (৯৬০-১২৭৯ খ্রি.) এই উৎসব পালন অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে হান, ছিং আমলের মধ্যদিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলে এসেছে মধ্য শরৎ উৎসব পালনের রীতি।
এটা এখন চীনাদের পারিবারিক সদস্যদের একত্র হওয়ার একটি উপলক্ষ বা প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। চীন একটি বিশাল দেশ। কাজের জন্য পরিবারের সদস্যরা বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মধ্য শরৎ উৎসবের ছুটিতে বাড়ি ফিরে পরিবারের বাকী সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন সবাই। প্রচলিত চীনা রুপকথা অনুসারে একদা আকাশে ১০টি সুর্য ছিল। ১০টি সুর্যের তাপে ব্যাপকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পৃথিবী।
এতে মর্ত্যবাসীর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সমস্যা থেকে মর্ত্যবাসীকে বাঁচাতে সেসময় হু ই নামে একজন চীনা নায়ক আবির্ভূত হন। আলো এবং তাপ বিকিরণের জন্য আকাশে একটি সুর্যকে রেখে বাকী ন’টিকে ভূপাতিত করেন তিনি। এতে খুশি হয়ে রানীমাতা পুরস্কার হিসেবে তাকে অমৃত দান করেন।
কিন্তু ঘটনাক্রমে হু এর স্ত্রী চ্যাংই সেই অমৃত পান করে ফেলেন এবং অমরত্ব লাভ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চ্যাংই কে নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে চাঁদে আশ্রয় গ্রহণ করেন চ্যাংই। আর তিনিই হলেন চাঁদের বুড়ি। চীনাদের প্রাচীণ বিশ্বাস মতে স্রষ্টার পক্ষ থেকে চ্যাংই তথা চাঁদের বুড়ি পৃথিবীর মানুষের কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করে।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: