কৃষি ও একটি জাপানি গল্প

জাপানিরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে যে ভাত সেটার নাম 'স্টিকি'। মানে ভাতের দানা একটার সাথে আরেকটা লেগে থাকে। আমার ধারণা ছিল, স্টিকি ভাত কাঠি দিয়ে সহজে খাওয়া যায় বলেই জাপানিরা এটা এত পছন্দ করে। আমি এই ভাত খেতে একদমই পছন্দ করতাম না। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো জাপানের বাজারে জাপানি কৃষকদের উৎপাদিত এই বিশেষ ভাতের চালের দামই সবচেয়ে বেশি।
বাজার থেকে কয়েকবার বিভিন্ন ধরণের চাল কেনার পর বুঝলাম এই চাল যদি জাপানিরা নিজেরা উৎপাদন না করে আশেপাশের কোনও দেশ থেকে আমদানি করতো তাহলে এর দাম বেশ কম পড়তো। আমি কৌতুহলী হয়ে আমার সুপারভাইজার প্রফেসর কামিজিমাকে একবার জিজ্ঞেসই করে ফেললাম..
"আচ্ছা প্রফেসর, তোমরা এই চাল বিদেশ থেকে আমদানি করো না কেন? আমদানি করলে তো দাম অনেক কম পড়তো!"
কামিজিমা: "তা হয়তো পড়তো.."
আমি: "তাহলে?"
কামিজিমা: "সরকার ইচ্ছে করেই কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদন খরচের অনেক বেশি দামে এই চাল কেনে।"
"কেন?"
"কৃষকদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।"
"মানে?"
"কৃষক যদি ভালো দাম না পায় তাহলে কি ওরা আর কৃষিকাজ করবে? পেশা বদলে ফেলবে না!"
"তাই বলে সরকার এত বেশি দামে চাল কিনবে কৃষকদের কাছ থেকে?"
"শোনো, আমরা আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভুলিনি। জাপান একটা দ্বীপরাষ্ট্র। ঐরকম একটা যুদ্ধ যদি আবার কখনো লাগে আর শত্রুরা যদি আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে! তখন কী হবে ভেবেছ?"
"বুঝলাম না!"
"বাইরে থেকে কোনও খাবার জাপানে আসতে পারবে? আমরা কি তখন এই টয়োটা গাড়ি খাব? কৃষক যদি না বেঁচে থাকে তাহলে ঐসময় আমরা বাঁচব?!"
আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম কামিজিমার কথা শুনে। ভাবলাম, আমরা কি অবলীলায়ই না আমাদের দেশের কৃষকদেরকে বছরের পর বছর উৎপাদিত শষ্যের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে মেরে ফেলার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করছি!
উল্লেখ্য জাপানিজ সরকার বছর শেষে তাদের মজুদ চাউল নষ্ট করে ফেলে দেয়। পুনরায় চাল কেনার জন্য। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য...
("The Mind Game" বই থেকে উদ্ধৃত সংগৃহিত তথ্য)
কৃষকের কল্যাণে নিবেদিত হোক কৃষির সাফল্য
১. স্থানীয়ভাবে কৃষিমেলা ও কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করা যেতে পারে জেলা উপজেলা পর্যায়ে।
২. কৃষকদের পুরস্কৃত করা দরকার। প্রত্যেক জেলায় প্রতি বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য পুরস্কার বা সন্মাননা জানানো যেতে পারে।
৩. বিশেষত তরুণ শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তাদের সন্মাননা জানানো প্রয়োজন।
৪. কৃষি ও কৃষকের পারিবারিক কল্যাণে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
৫. কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসায় বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। প্রত্যেক উপজেলা কৃষি অফিসে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে কৃষকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
৬. কৃষক কল্যাণ তহবিল গঠনের কাঠামো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।
৭. কৃষক সমবায়কে জোড়ালোভাবে কার্যকর করা যেতে পারে।
৮. মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক দায়িত্বে নিয়োজিত করতে হবে।
৯. কৃষক কার্ডের মাধ্যমে ট্রেনের টিকিটে ছাড়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় অগ্রাধিকার, বীজ ও সার প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার ও ছাড় প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১০. কৃষি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কৃষকের উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১১. কৃষি অফিসের তদারকিতে প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে কৃষি বাজার স্থাপন করা দরকার।
১২. কৃষিপণ্য পরিবহনে ট্রেনে বিশেষ কামড়া এবং যেখানে ট্রেন লাইন নাই সেখানে বিশেষ পিকাপ পরিবহণ ব্যবস্থা করা দরকার।
১৩. কৃষকদের জন্য সরকারের উদ্যোগে কৃষি/কৃষক কার্ড করা হয়েছে- অভিযোগ আছে অনেক অকৃষকও সেই কার্ড পেয়েছেন। এগুলো যাচাই সাপেক্ষে কৃষি/কৃষক কার্ডের সুবিধার আওতা বাড়াতে হবে।
১৪. কৃষকদের বিনোদন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য বিশেষ বিশেষ কৃষি এলাকায় বা খামারে কৃষকদের ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১৫. রেডিও, টেলিভিশনে কৃষি অনুষ্ঠান আরো বৃদ্ধি করা এবং প্রিন্ট মাধ্যমে কৃষি নিয়ে বিশেষ আয়োজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া দরকার। একই সাথে কৃষি নিয়ে সারা দেশে যারা নিবেদিত ভুমিকায় কাজ করছেন তাদেরকে কৃষি সাংবাদিকতা এবং গবেষনার জন্য প্রণোদনা দেয়া দরকার। কৃষিভিত্তিক প্রকাশনা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্রয় করে সারাদেশের সরকারি পাঠাগার, কৃষি অফিস সমূহে প্রেরণ করা যেতে পারে। গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কৃষকের জন্য কৃষি পাঠাগার স্থাপন করে সান্ধ্যকালীণ পাঠচক্র করা যেতে পারে।
এস এম মুকুল : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং লেখক
মন্তব্য করুন: