• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৭তম প্রয়াণ দিবসে

এক সখ্যের আলেখ্য

ড. সেলিম জাহান

প্রকাশিত: ২২:২৯, ২২ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
এক সখ্যের আলেখ্য

আমার প্রয়াত পিতা অধ্যাপক সিরাজুল হক ও কবি অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশ বরিশাল বি.এম. কলেজে সহকর্মী ছিলেন চল্লিশের দশকে শেষার্ধে। বাবা ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, জীবনানন্দ দাশ ইংরেজীর। আমার তরুন অকৃতদার পিতা সবে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ঢাকা থেকে বরিশাল গেলেন বি.এম. কলেজে অধ্যাপনার জন্যে, সেই একই জাহাজে তাঁর সতীর্থ বন্ধু শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী যাচ্ছিলেন খুলনা বি.এল. কলেজে অধ্যাপনা করতে। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বারের মতো কোলকাতা থেকে এসে বি.এম. কলেজে যোগদান করেছিলেন।

আমার বাবা ভীষণ স্বল্প কথার মানুষ ছিলেন। ঠিক গল্প করার লোক ছিলেন না, গল্প করতেও পারতেন না। অনেকটাই নিভৃতচারী। তাঁর জীবনের গল্পও আমরা বেশিটাই শুনেছি আমার মায়ের কাছে। তাঁর শৈশবের কথা এবং আমার পিতার ছোট বেলার কথা আমি শুনেছি আমার পিতামহী ও আমার পিতার কণিষ্ঠ পিতৃব্যের কাছ থেকে। তাও ছাড়া ছাড়া কুড়িয়ে বাড়িয়ে শোনা। শুনেছি বাবা যখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বি.এ. ক্লাশের ছাত্র, তখন তাঁদের পাঠ্য ছিল Thoms Hardyর The Mayor of Casterbridge. সেটি পড়াতে এলেন সদ্য এম.এ. পরীক্ষা শেষ করা পাবনার জেলা প্রশাসক আবদুল হালিম চৌধুরীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তী ছাত্র কবীর চৌধুরী। কিন্তু আমার পিতা যে কেন ফেলী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে পাবনায় বি.এ. পড়তে গেলেন, তা আমরা জানি না। 

নিজের কথা বলার ব্যাপারে প্রচণ্ড অনীহা ছিলো আমার বাবার। নিজের অধ্যাপনা, পড়া-লেখা, বাড়ি-ঘর নিয়েই থাকতেন ভদ্রলোক। নোয়াখালীর নিজের শেকড়ের প্রতি প্রচণ্ড টান ছিলো তাঁর। বহুদিন আমরা জানতেই পারি নি যে কবি জীবনানন্দ দাশ আর তিনি দু’বছর বি.এম. কলেজে সহকর্মী ছিলেন। এ কথাটি আমি প্রথম শুনি আমার কৈশোরে বি.এম. কলেজের বহু পুরাতন কর্মী কৈলাশ কাকার কাছে। ১৯৪০ সাল থেকে কৈলাশ কাকা কলেজে কাজ করতেন। তাঁর মতে, কবি জীবনানন্দ দাশ ও আমার বাবা খুব কম কথা বলার মানুষ ছিলেন বলে, দু’জনের মধ্যে এক ধরনের সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। কৈলাশ কাকা বলতেন যে, প্রায়ই যেখানে দেখা যেতো যে বি.এম. কলেজের শিক্ষক বিশ্রামাগারের বিশাল সেগুন কাঠের চারদিক ঘিরে অন্যান্য শিক্ষকেরা উচ্চস্বরে উত্তপ্ত আলোচনা করছেন, সেখানে কবি জীবনানন্দ দাশ ও আমার বাবা এক কোণায় দু’টো আরামকেদারায় বসে মৃদুস্বরে গল্প করছেন। 

ঐ কথার সূত্র ধরেই কবি জীবনানন্দ দাশ-এর সংরগ তাঁর জানা-শোনার প্রসঙ্গটি জিজ্ঞেস করলে তিনি টুকরো টুকরো করে কিছু কিছু স্মৃতি কথা বলেছিলেন। বয়সে কবি আমার বাবার চেয়ে বেশ বড় ছিলেন। বাবা তাঁকে ‘দাশ বাবু’ বলে ডাকতেন আর তিনি বাবাকে ‘হক সাহেব’ বলতেন। বাবার মুখে শুনেছি কবি জীবননান্দ দাশের ডাক নাম ছিলো ‘মিলু’। 

বাবা এবং আরও ক’জন তরুন অধ্যাপক তখন থাকতেন ব্রজমোহন কলেজের মূল ভবন ছাড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত একটি মাঠের মাঝে একটি একতলা হলুদ বাড়িতে। ঐ বাড়িটি আমি ষাটের দশকেও দেখেছি। হিন্দু হোস্টেল ছাড়িয়ে অনেকটা পোড়োবাড়ির মতো। সেখান থেকে কোণাকুনিভাবে হেঁটে মুসলিম গোরস্থানের মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলে ‘ধানসিঁড়ি’ ২০ মিনিটের রাস্তা।

মাঝে মাঝে কবি বাবার কাছে ঐ বাড়িতে আসতেন। সকালে কবি প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে আসতেন বাবার কাছে চা খেতে। বাবার একটা পুরোনো পেতলের স্টোভ ছিলো। তিনি তাতে চা বানাতেন। দু’কাপ চা নিয়ে দু’জনে বারান্দায় বসতেন। আমার পিতামহী তাঁর পুত্রকে একটি কাঁসার গেলাস দিয়েছিলেন। কবি সেই গেলাসে চা খেতে ভালোবাসতেন। গরম গেলাসটি ধরতেন ধুতির খুঁট দিয়ে। চা খেয়েই উঠে পড়তেন অন্যান্য শিক্ষকদের উঠে পড়ার আগেই। বেশি লোকজনের সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতেন না, ভিড়-ভাট্টা এড়িয়ে চলতেন। 

সুবেশ হয়েই তিনি বাবার কাছে আসতেন বলে শুনেছি। কিন্তু ঘরে ঢোকার পরে একটা বিপত্তি হতো। বাবাব ঘরে একটি লম্বা মতো গদি আঁটা হাতলবিহীন বেঞ্চি ছিলো। কবি ঘরে ঢুকেই ঐটাতে বসতেন। কিন্তু একবারে কোণায় গিয়ে - বাবা বলতেন যে, ‘মনে হত, তিনি পড়েই যাবেন’। বারবার বলা স্বত্ত্বেও তিনি বেঞ্চির মাঝে বসতেন না, সারা বেঞ্চি খালি থাকলেও। বাড়ির অন্যান্য অধ্যাপকেরা এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতেন, কিন্তু কবি নির্বিকার। 

বাবা বলতেন, একা থাকলে কলেজের শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে একটি কোণায় বসতেন কবি জীবনানন্দ দাশ এক কাপ চা নিয়ে। অন্য অধ্যাপকেরা যখন জমিয়ে গল্প করছেন, তখন কবি কেমন যেন আনমনা হয়ে কি একটা ভাবতেন তন্ময় হয়ে। অন্যদের গালগল্পে যেতেন না, এমন কি আমন্ত্রণ জানালেও না। তবে বাবা বলেছেন যে, ‘দাশবাবু হঠাৎ করে হো হো করে জোরে হেসে উঠতেন’। তখন অন্য অধ্যাপকেরা অবাক হলে, কবি কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়তেন। 

বড় লাজুক ছিলেন তিনি। অন্য মানুষের সামনে পড়ে গেলে কেমন যেন অস্বস্তি হত তাঁর। নিজেকে নিয়ে থাকলেই সবচেয়ে আরাম বোধ করতেন। বাবা ঠাট্টা করতেন যে, রাস্তার এপারে ওপারে দু’জনে থাকলে দৃষ্টি এড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন কবি। ‘কেমন আছেন, দাশবাবু?’ এমন সাধারণ প্রশ্ন করলেও কেমন যেন ঘেমে উঠতেন তিনি। নতুন বাজারে দেখা হতো দু’জনার কোন কোন সকালে। বাবাকে দেখলেই খুশি হয়ে উঠতেন তিনি, কারণ কবি মাছের দর-দাম করতে পারঙ্গম ছিলেন না। তাই চুপিচুপি বাবাকে বলতেন, ‘হক সাহেব, আমাকে একটা মাঝারি মাছ কিনে দিন না?’ এ কথাটা বলার সময়ে বাবার মুখটা, চোখের দৃষ্টিটা, গলার স্বরটা কেমন যেন নরম হয়ে আসতো।

রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে কবির গভীর আগ্রহ ছিলো। ভারতীয় নানান দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তা-চেতনার ওপরে তাঁর ভালো দখল ছিলো। বাবার কাছে তিনি পাশ্চাত্যের নানান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। রাষ্ট্রচিন্তার বিবর্তন তাঁকে অবাক করতো। ভারত-বিভাজনে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। সে সময়ে দেশ-বিভাগের টানাপোড়েনে তিনি বিচলিত ছিলেন। তাই তিনি ক্রমাগত বরিশাল-কোলকাতা করেছেন। তাঁর এই অনিশ্চয়তার কথা তিনি বাবাকে বলেছেন। তাঁর নানান কবিতাতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। 

নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দের প্রতি ঐ সময়ে তাঁর ভীষণ কৌতূহল ছিলো। ‘কেন, কে জানে’? বাবা জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পান নি। হয়তো কবিতায় নতুন নতুন আঞ্চলিক শব্দমালা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিংবা কোন কিছু লেখার পরিকল্পনা ছিল নোয়াখালীর পটভূমিতে। তিনি বাবাকে বলেছিলেন যে, ১৯৪৬ সালের নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁর চিত্তকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বাবার কাছে ঐ দাঙ্গা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। বাবার সঙ্গে এক ধরনের নৈকট্য অনুভব করতেন তিনি। বাবাকে তিনি বলতেন, ‘বরিশাল আর নোয়াখালী সহোদর, মেঘনার এপার-ওপার’।

একটা সময়ে বাবা সেই অকৃতদার অধ্যাপকদের আস্তানা ছেড়ে উঠে এলেন বৈদ্যপাড়ায় এক বাড়িতে। হলুদ লাল দালানের হলদে কল্কে ফুলের লতানো সেই অনিন্দ্যসুন্দর বাড়িটি আমি যৈশবে দেখেছি। ১৯৪৯ সালে আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করে নোয়াখালী থেকে বরিশালে নিয়ে এলে কবি জীবনানন্দ দাশ কোলকাতা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন নব দম্পতিকে অভিনন্দন জানিয়ে। সে চিঠি রক্ষিত হয়নি, কারণ তখনও অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের ভাগ্যে কবি জীবননান্দ দাশের খ্যাতি জোটেনি।

শেষবার যখন আমার পিতার সংগে আমার দেখা হয়, তখনও জীবনানন্দ প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। নানান কথা হয়েছিলো। এক পর্যায়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাবা বলেছিলেন, ‘চিনতে পারিনি তখন যে অতো বড় একজন কবি ছিলেন!’ 

তাঁর কণ্ঠের আক্ষেপ লুকোনো থাকেনি। আমি মনে মনে বলেছিলাম, ‘আমরাও কি তাঁকে পুরোপুরি চিনতে পেরেছি’? ‘বিষন্নতার কবি’, ‘ধূসর কবিতার কবি’, ‘রূপসী বাংলার কবি’, ‘শুদ্ধতম কবি’, কতো কথাই তো বলি তাঁর সম্পর্কে, কিন্তু পুরোপুরি কি এখনও ধরতে পেরেছি কবি জীবনানন্দ দাশকে?

লেখক: ড. সেলিম জাহান
অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক পরিচালক, কথাসাহিত্যিক।

 

 

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: