• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

একটি গান হয়ে উঠছে পাকিস্তান-ভারতের মেলবন্ধনের সেতু

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৩ মে ২০২২

ফন্ট সাইজ
একটি গান হয়ে উঠছে পাকিস্তান-ভারতের মেলবন্ধনের সেতু

কয়েক বছর আগের কথা। পাঞ্জাব প্রদেশের একটি ট্রাকের পেছনে পেছনে ফয়সালাবাদ থেকে লাহোরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গীতশিল্পী আলি শেঠি।  উজ্জ্বল রঙে আঁকা রয়েছে নয়নকাড়া চিত্র। ট্রাকে বাঁধা আছে নানা ঘণ্টা। চলার পথে তুলছে বিচিত্র শব্দ। বেজে উঠছে এসব ঘণ্টা। ট্রাকটিতে ক্যালিগ্রাফি করে পাঞ্জাবী ভাষায় লেখা রয়েছে "আগ লাভা তেরিয়া মজবুরিয় নু"—অর্থাৎ—আগুন ধরিয়ে দাও তোমার দুশ্চিন্তারাজিতে—শব্দগুচ্ছ। পাকিস্তানের রাস্তায় এসব ট্রাক নতুন কোনও দৃশ্য নয়। বরং সেই ব্রিটিশ উপনিবেশের কাল থেকেই চলছে এমন ট্রাক।  এ ধরনের বাহন জিঙ্গেল ট্রাক নামেই পরিচিত। 

এসব ট্রাকে কখনও লেখা থাকে কবিতার দুয়েক ছত্র, বা সোজা সাপ্টা হুঁশিয়ারি বাক্য। কাজেই ট্রাকের লেখা মনে গেঁথে যাওয়ার কারণ সচরাচর ঘটেই না। ট্রাকের চাকচিক্য বা সুরেলা ঘণ্টাধ্বনির  মতোই দৃষ্টি ও কানের আড়াল হলে তা হয়ে যায় মনের আড়ালও । কিন্তু এবারে তেমনটি  ঘটল না। "আগ লাভা তেরিয়া মজবুরিয় নু" বারবার ঘুরেফিরে এলো আলি শেঠির মনে। চিন্তায়। ভাবনায়।

এভাবেই 'পাসুরি'র পয়লা স্তবক সৃষ্টির উদ্দীপনা পেলেন আলি শেঠি। ৩৭ বছর বয়সী সঙ্গীতশিল্পীর সর্বশেষ একক এই গানে উচ্ছ্বসিত আনন্দধারা বইছে, রয়েছে নৃত্যর ছন্দ, তাল ও লয়। তিন মাস আগে ইউটিউবে গানটি আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত ১০ কোটির বেশি হিট অর্জন করেছে এবং প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কানাডা পর্যন্ত সব বেতারেই বাজছে 'পাসুরি।' খ্যাতিকে সঙ্গীতের কর্মগুণে অনেক আগেই পোষ মানিয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী  আলি শেঠি। 'পাসুরি'তে' তার সাথে কণ্ঠ মেলান শিল্পী শে গিল। এ গানের মধ্য দিয়ে শে গেলের কণ্ঠের শ্রোতা আকর্ষণের শক্তির পরিচয় মিলল।  এভাবেই দ্বৈত কণ্ঠে ভর করে গানটি গড়ে তুলল শক্তিমান মেজাজ আর আবহ। গানের তাল শ্রোতার মধ্যে তার অজান্তেই নৃত্যের অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে। তালে তালে দুলে উঠে তনুমন। এমনকি না চাইলেও। 'পাসুরি'র সুরলহরী সৃষ্টির বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় ভারতীয়, তুর্কি, আরব এবং পারস্য, এবং তুর্কিস্তানের স্বাদ ওস্তাদির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো। এ গানে পোর্তুরিকোর নৃত্যর তাল 'রেগেটন' ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত রাগের কাঠামোতে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হয়েছে। আলি শেঠি একে বলেন, 'রাগাটন।' এতে গানের কথাগুলো বুঝতে না পারলেও অসুবিধা নেই। গানের বিরহ আত্মার কথামালা সুরাশ্রতি হয়ে শ্রোতার হৃদয়কে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শেঠি গেয়ে ওঠেন, "তোমার প্রেম যদি হয় হলাহল, আমি তা ব্যকুল ভাবে করব ধারণ।" প্রিয়াঙ্কা মাট্টুর এক বোদ্ধা বান্ধব বলেন, "এটি আমার প্রিয় ঘরানার সঙ্গীত। এমন এক প্রেমগীত যা কিনা শুনিয়ে যায় হুমকিরও বার্তা।" 

শেঠি জীবন-যাপন করেন নিউ ইয়র্কে। আমেরিকায় বসবাস এবং উপমহাদেশে যাতায়াতকে উল্লেখ করে তিনি নিজেকে আধুনিক কালের জিপসি হিসেবে উল্লেখ করেন। এক কাজে মুম্বাই গেলেন। মুম্বাই তার কাছে নতুন কোনও নগরী নয়। সাহিত্য উৎসব আর সঙ্গীত জলসায় যোগ দিতে এ নগরীতে আসা-যাওয়া অনেকবারই। এবারের সফরের   সময়ে এ গানের ভাবনা মনে গুনগুনিয়ে উঠতে থাকল। তবে এখানেও বাদ সাধল রাজনীতির করাল ছায়া। ভারতীয় প্রযোজক শেঠির কাছে অকপটে স্বীকার করলেন, পাকিস্তানি শিল্পীর তকমা লেগে আছে শেঠির কপালে, তাই তার পক্ষে ওই স্টুডিওতে কোনও সঙ্গীত-কর্ম করা সম্ভব নয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাহলে স্টুডিওই আগুন দিয়ে ছাই করে দেবে। বিধ্বংসী অগ্নিশিখার হুমকি শেঠিকে মনে করিয়ে দিল এক জিঙ্গেল ট্রাকে লিখে রাখা পাকিস্তানি চারণ কবির একটি চরণ। তিনি বলেছেন, "না আমি হয়ত হিন্দুস্তান ভ্রমণ করতে পারব না কিন্তু আমার গান নিত্য-অনায়াসে সে সফর-সাঙ্গ করবে।" শেঠি মনে করেন আধুনিক কালে অতি মেরুকরণের এক দুনিয়ায় বাস করছে মানুষ। সব ধরণের সীমারেখা ও সীমান্ত আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। তিনি আরও মনে করেন, অবাধ ও মুক্ত চলাফেরার অধিকার থাকা উচিত।

তিনি আরও মনে করেন, এমন সংগীত তৈরি করতে হবে যা একাধারে স্থানীয় ও বৈশ্বিক হয়ে উঠবে। এক দিকে তার শিকড় থাকবে গভীরে প্রোথিত অন্যদিকে এটি হবে পুরোপুরি মুক্ত ও অবাধ। 'পাসুরি'তে নিজ পোশাক, কুর্তা-পায়জামা এবং একই কাপড়ের টুপি, সম্পর্কে এ সঙ্গীতশিল্পীকে মন্তব্য করতে বলা হলে তিনি বলেন, এ পোশাক অতীতের, এ পোশাক ভবিষ্যতের। 

পাঞ্জাবী ভাষার শব্দ 'পাসুরি' মানে মোটামুটি "তালগোল পাকান কঠিন অবস্থা।" দুই ব্যক্তির মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের কোনও উপায়ান্তরহীন পরিস্থিতি বোঝাতেই 'পাসুরি'র প্রয়োগ ঘটে। মোটামুটি 'তাওয়েফ' বা 'বাইজি' সুর-শৈলীতে সাজান হয়েছে এ গানকে। মধ্যযুগীয় দক্ষিণ এশীয় কবিতায় পরকীয়া চর্চার একটি ধারাবাহিকতাকে মেনে নেওয়া হয়েছে। পারিবারিক(ভাবে নির্ধারিত) বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধ-চল হিসেবেই এ কবিতা চর্চা। পারিবারিক বিবাহ প্রথার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত হয়েছিল। ( বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের আশ্লেষ-আকাঙ্ক্ষায় সমৃদ্ধ বিবাহিত প্রেমিক পুঙ্গবকে নিশিযাপনে প্রলুব্ধ করার বারাঙ্গনার প্ররোচনা রয়েছে গানের ভাষ্যে।) কামজ ভাষ্য শ্লীলতার গণ্ডি টপকে যায়। গোপন সঙ্গ লাভের এ কামনা বাস্তবায়িত হয় না । বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভদ্র সমাজ,  নিপীড়নের মতোই মনে হয়। 'পাসুরি' বাহ্যত ভাগ্য বঞ্চিত প্রেমিকদের গান হলেও এর আরেক স্বরূপ রয়েছে অন্তর্লীন। চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িত দুই দেশ, পাকিস্তান ও ভারতের রূপক উপস্থাপন ঘটেছে এখানে। অথচ দেশদুটির ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বিনির্মাণের অনেক সূত্র ও সম্পদ উৎসারিত হয়েছে একই উৎস থেকে। একে অন্যকে ভর করে চলছেও।

২০২১'এর গোড়ার দিকে মনের ভেতরে যে সুর ছিল তাই দিয়ে গানটির কয়েক কলি গেয়ে স্বরটি পাঠিয়ে দিলেন প্রযোজক জুলফিকার খানের কাছে। তিনি জুলফি নামে পরিচিত এবং ইংরেজি বানানে বৈচিত্র্য এনেছেন Xulfi লিখে। কোমল পানীয় কোকাকোলার প্রতিষ্ঠিত কোক স্টুডিও থেকে পাকিস্তানে জনপ্রিয় সঙ্গীত টিভি সিরিজ প্রযোজনা করছেন। শেঠির পাঠানো গানটি পাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া বলতে যেয়ে জুলফি জানান, "উত্তেজনার ঝড় বয়ে গেল। মনে হলো নৃত্য শুরু করি। জানতাম মানুষ এ গানকে লুফে নেবে। বুঝতেও পারবে না তাদের হৃদয়তন্ত্রীতে কে আঘাত করেছে।" তিনি খুঁজে বের করলেন আনুশা গিল ওরফে শে গিলকে। অর্থনীতির ছাত্রী গিলের  সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার গানের ভিডিও ২০১৯ থেকে ইনস্টাগ্রামে দিচ্ছে। 'পাসুরি'র গানে তাকে নিয়ে এলেন জুলফি।  গিলের আবেদনময়ী কণ্ঠ এবং শেঠির দরাজ কণ্ঠের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাবে- ভেবেছিলেন তিনি। সে ভাবনাও সফল।

দেশি সংগীতের ঐতিহ্যে অনুসরণ করে 'পাসুরি'  হাত তালির মধ্য দিয়ে শুরু হলো। স্পেনের ফ্লামেনগো গানেও এর সরাসরি চল রয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের সংকর ঘটানোর কাজটি ভেবেচিন্তেই করা হয় বলে জানান শেঠি। গানটিতে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয়নি।  তারের বাদ্য যন্ত্রের প্রয়োজনে তুর্কি বাগ্লামার কথা বলেন জুলফি। ২৪ বছর বয়সী সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীত শিল্পী আবদুল্লাহ সিদ্দিকি এ গান নিয়ে জুলফির সাথে কাজ করেন। তিনি তার শব্দ ভান্ডার থেকে তিমির ডাকও নিয়ে আসেন। ব্যবহার করেন গভীর পানির স্তন্যপায়ী তিমির স্বরও। স্বরটি গভীর, খসখসে এবং নমনীয় বলে অভিহিত করেন সিদ্দিকি।
'পাসুরি' গানের ভিডিও তোলা হয় পুরানো দিনের বলিউডের টেকনিকালারের আদলে। ভিডিওর পরিচালক কামাল খান। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বোহেমিয়ান সংস্করণে সাজানো হয় শেঠি এবং গিলকে। শেঠির মাথার টুপির সাথে তার পোশাকের রঙের চমৎকার মিল ছিলো। একইভাবে সাদা পোশাক আর কারুকাজ করা কটিতে গিল হয়ে ওঠেন অনবদ্য। একটি পুরানো বাড়ির উঠোনে গান পরিবেশন করেন এ দুই শিল্পী। দ্বৈতগীতির অবকাশে মনোহর স্থিরচিত্র পরিবেশন করা হয়েছে। রত্নখচিত মেকআপে একজন যুবক, বিস্তৃত বিনুনির এক নারী। পরিবেশন হয়েছে পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী এবং ভারত-নাট্যম শিল্পী শীমা কেরমানির নৃত্য। গিলের কণ্ঠের সাথে মিল রেখে ধীরলয়ের অঙ্গ সঞ্চালনার এ ভারতনাট্যমের পরিবেশনা মুগ্ধতাকে আরো রস-মঞ্জুরিতে ভরিয়ে তুলেছে। গিল পাকিস্তানের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নারী এবং দেশটিতে মোট জনসংখ্যা ১.৫৯ শতাংশই খ্রিস্টান।  এ ছাড়া দু'টো তরুণও পরিবেশন করেছেন ঝুমুর নাচ।

এ গান শোনার অভিজ্ঞান ব্যক্ত করতে যেয়ে প্রিয়াঙ্কা মাট্টু বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের জটিল অঞ্চল কাশ্মির নিয়ে এক স্মৃতিকথা শেষ করছি।  মার্চ মাসে প্রথমবার 'পাসুরি' শোনার পর থেকেই লস অ্যাঞ্জেলসের চারপাশে গাড়ি চালানোর সময় এ গানকে বারবার শোনার জন্য  লুফে নেই। এই এলাকায়ই আমি বসবাস করি। গানটি আমার কাছে একাধারে পরিচিত এবং রোমাঞ্চকরভাবে নতুন হিসেবে অনুভূত হলো। 'পাসুরি' নির্মাতা সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হলাম। সম্প্রতি আমাদের পরস্পরের পরিচিত পুস্তক সম্পাদকের মাধ্যমে শেঠির বোন মীরার সাথে যোগাযোগ করি। মীরা, নিজেও একজন অভিনেত্রী। আমার পছন্দের  মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তার ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন মীরা। শেঠি সম্পর্কে যেন আরও জানতে পারি এবং 'পাসুরি' কীভাবে সৃষ্টি হলো তাও যেন জানতে পারি তাই ছিল এ পরিচয়ের উদ্দেশ্য।  

শেঠির জন্ম ১৯৮৪ সালে লাহোরে। তার মাবাবা নামজাদা সাংবাদিক এবং প্রকাশক নাজমা শেঠি এবং জুগনু মহসিন। ছেলেবেলায় তার বাড়িটি ছিল "কারাভোগী লেখক ও কর্মীতে ভরপুর।" নিউ ইয়র্কের তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে জুমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রিয়াঙ্কাকে তিনি বলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হতে তার মাবাবার জন্য ফোন আসলে তা শেঠিই ধরতেন। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সর্বশেষ পরিস্থিতি তার ঠোঁটস্থ রাখতে হতো এবং অ্যামনেস্টিকে সে সব তথ্য বুঝে না বুঝে অহরহ দিয়ে যেতেন।  এ সব তথ্য কেমন হতো তার উদাহরণ দেন শেঠি। এই যেমন "কোন বন্দির জন্য হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন  সবেমাত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।"  সম অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ-শোভাযাত্রায় যোগ না দিলে সুফি ভক্তিমূলক সঙ্গীত  কাওয়ালিতে অংশ নিতেন তার মা ।  মাবাবার বন্ধুদের নজর কাড়ার জন্য  স্বচ্ছ এবং তরুণ কণ্ঠে কাওয়ালি এবং গজল - গীতিমূলক কবিতা - গাইতে শুরু করেন শেঠি। "গান এবং প্রতিবাদ আমার হাড়-মাস-রক্ত-মজ্জায় মিশে আছে" বলে জানান তিনি। জাতি, শ্রেণি এবং মতাদর্শগত  নানা ত্রুটি-বিচ্যুতিতে কণ্টকাকীর্ণ সমাজে কেবল মাত্র লোকসংগীতের ধারাই প্রত্যেকের মধ্যে সমাদৃত ও আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভব সৃষ্টি করে বলে বোধের উদয় ঘটে শেঠির। ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতকে নিজেকে প্রকাশ করার এবং নিজস্ব ভিন্নতা সম্পর্কে উদ্ভাসিত সচেতনতা অন্বেষণ করার  নিরাপদ ভূমি বলেই প্রতিভাত হলো তার কাছে।

লাহোরের স্বনামখ্যাত বালক বিদ্যালয় আইচিসন কলেজের একজন ব্যতিক্রমী ছাত্র তিনি । তার ধ্যানজ্ঞান ছিল হয় আইভি লিগের আওতাধীন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে ভর্তি হওয়া নচেৎ আর কিছুই নয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের জীবনে তার কণ্ঠ বিকাশের বা সুর সাধনার প্রকাশের কোনও পথ খুঁজে পাননি তিনি। তবে শিল্পকক্ষ বা আর্টরুমে গান পরিবেশনার স্মৃতি এখন সজীব। এখানেই খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সালমান তুরসহ  অনেকের সাথে শৈশবকালীন বন্ধুত্বের সূচনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার পাঠের ওপর হার্ভার্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯'এ লাহোরে ফিরে আসার আগে তার উপন্যাস দ্যা ওয়াইজ মেকার প্রকাশিত হয়। বিদেশ শিক্ষা শেষে প্রত্যাগত এক অধিবাসীর চোখে লাহোরের সমসাময়িক ঘটনাবলীকে উপজীব্য করেই গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। উপন্যাস লেখার নিয়ে কথা বলতে যেয়ে তিনি জানান, "আসলে আমি সময় নিচ্ছিলাম।" শেঠির চাকরি-বাকরি নিয়ে মাবাবার মনে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ জমছিল তবে দেশে ফিরে আসায় খুশিই হন দুজনেই। শেঠি  সে সময়ে দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রয়োজনীয় গবেষণা করছিলেন। ৯/১১'এর  পরের দশকে একজন পাকিস্তানি লেখক হিসাবে বিশ্ব তার কাছে  আর্থ-রাজনৈতিক আখ্যানের মতো কী চায় সে ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, দেশভাগ নিয়ে হাজারো কথাই হয়ত এমন কিছুই ছিল সম্পাদকদের চিন্তাভাবনায়; কিংবা "সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আরও কিছু!" 

এর বদলে সঙ্গীতের প্রতি শৈশবের প্রেম তাকে ডেকে নিল সৃজনশীল অমিত সম্ভাবনার সড়কে। কীভাবে কাওয়ালদের কলি মন্ত্রমুগ্ধকর চালে সুর এবং ছন্দের আপাত অপরিকল্পিত নিদর্শন বুনে ঘুরেফিরে আসে? এবং কীভাবে মার্জিত শব্দগুচ্ছের আড়ালে অধরা বা অপ্রকাশ্য প্রিয়জনের আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালীভাবে ব্যক্ত করে?—এমন এক ভাবাশ্রিত বিষয় যা তার নিজ ভিন্নতা এবং মার্কিন মুল্লুকে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীর অভিজ্ঞানকে দৃঢ় রূপ  কী ফুটিয়ে তোল? আর কীভাবেই বা  তারা একাধারে বুনো এবং মুক্ত হতে পারে? তার নিজ গোপন কামনাটিও অনুরূপ, যদিও সামাজিক নির্দেশের কঠোর বিধি-বিধানের আওতায় নিয়ম-আবদ্ধ হয়ে বসবাস । এক দ্বিমুখী স্রোতের টানে তিনি অনুভব করলেন। ২০০৮ সালে সংগীতশিল্পী দিল্লি ঘরানার ওস্তাদ সামির কাছে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন।

সামি থাকেন পাকিস্তানের বন্দর নগরী করাচিতে। তবে মাসের অর্ধেকটা কাটান লাহোরে। এ নগরীতে সঙ্গীতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণকারী একদল ছাত্রকে শিক্ষা দেন তিনি। সঙ্গীতজ্ঞ সামি হলেন  দক্ষিণ এশিয়ায় কাওয়ালী উদ্ভাবনের কৃতিত্বের দাবিদার ত্রয়োদশ শতাব্দীর মিয়া সামাদ বিন ইব্রাহিমের বংশধর। ওস্তাদ সামি সম্পর্কে শেঠি বলেন, "তিনি মধ্যযুগীয় মুহূর্তে ঠাসা একজন মানুষ।"  শেঠি আরও বলেন, "তিনি নিজের ওষুধ নিজেই তৈরি করেন। তিনি প্রতি বছর শিকড়-বাকড় এবং ভেষজ উপাদানের খোঁজে পাহাড় চষে বেড়ান। এ ছাড়া তিনি একজন ভাষাবিদও। আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ব্রজভাষায় কথা বলতে পারেন কিন্তু ইংরেজি বলতে পারেন না।" শেঠিকে রাগের  ধরণ শেখালেন সামি। এবং কীভাবে মধ্যযুগীয় ভারতে বৈদিক মন্ত্র এবং তুর্কি ও ফার্সি সুরকে মেশানো হয়েছে তাও শেখান।  "এবং তিনি আমাকে দেখান যে, পশ্চিমের সাথে মুখোমুখি হওয়ার আগে, দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব স্বরলিপি ছিল এবং সঙ্গীতের নিয়ে বহুসাংস্কৃতিক ধারণা ছিল। পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া সঙ্গীতের চেয়ে এটি অনেক বেশি নমনীয় ছিল।" 

২০১২'তে মিরা নায়ারের ছবি 'দ্যা রিলাকট্যান্ট ফানডামেন্টালিস্টের' জন্য  ফরিদা খানুমের 'দিল জ্বালানো কি বাত' রেকর্ড করেন শেঠি। এ গান শেঠিকে গায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। ২০১৫ সালে কোক স্টুডিও'র জন্য প্রথমবার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত 'উমরান লাঙ্গিয়াঁ'(জীবন চলে গেছে) গাইলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী সঙ্গীতের তর্জমাকারী হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিলেন তিনি। গজলরানি হিসেবে পরিচিত ফরিদা খানুম তাকে গজল গাওয়ার রীতির ওপর দারুণ কিছু প্রশিক্ষণ দিলেন। রাগকে কী করে খেলাতে হয় তা শেখালেন গজলরানি। উপমহাদেশের রাজা-মহারাজাদের দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এ কৌশল আয়ত্তে এনেছেন গজলরানি। এ সব দরবারে তিনিই ছিলেন সঙ্গীতের একমাত্র বিনোদন দানকারী। পাসুরিকে উপভোগ্য সঙ্গীত করে তোলার ক্ষেত্রে ফরিদা খানুমের কৌশলকেই কৃতিত্ব দেন শেঠি। শেঠি মধ্যযুগীয় সঙ্গীতকলাকে কাজ লাগিয়ে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় সঙ্গীত রচনার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।

তার সেই কাঙ্ক্ষিত আকর্ষণীয় সঙ্গীত এখন ভারতের মিউজিক চার্টের পয়লা নম্বর জুড়ে বসে আছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প ঐতিহ্যগতভাবে অন্তহীন গান সরবরাহ করে এ জায়গা অধিকার করে রাখত। শহরে-গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট থেকে 'পাসুরি' শুনছে মানুষ। যারা  এ গানের ভাষা বোঝে না কিন্তু সঙ্গীতটির প্রাণস্পন্দন অনুভব করে এমন মানুষ শুনছে এ গান। বিদেশে বসবাসরত সব শ্রেণীর দেশি মানুষদের কাছ থেকে ভালোবাসার পত্র পেয়েছেন শেঠি। শেঠির মনে পড়ছে তার ছোটবেলার কথা। মা তাকে কাওয়ালির টেপ বাজিয়ে শোনাতেন। 'পাসুরি' ভারতে এক নম্বর তালিকায় যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে পাকিস্তানের গানটি শোনার দায়ে দুই ভারতীয় কিশোরকে গ্রেফতার করা হলো। আরজু  আফতাব গ্র্যামি পুরষ্কার জয়ী প্রথম পাকিস্তানি হওয়ার পরই ঘটল এমন ঘটনা। ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সম্প্রতি বাড়ছে। তাই ওই গ্রেফতার হওয়ার খবরটি মোটেও বিস্ময় সৃষ্টি করে না। পাকিস্তান ও ভারত সাধারণভাবে  পরস্পরের নাগরিকদের জন্য ভিসা দেয় না। যদিও এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে যেতে পারে না তারপরও পাকিস্তানিরা গোগ্রাসে বলিউডের চলচ্চিত্র দেখে। অন্যদিকে ভারতীয়রা রাতে পাকিস্তানি সোপ অপেরা দেখতে বসে। দেশদুটির নাগরিক সক্রিয়ভাবে একে অন্যের সংস্কৃতির তালাশ করছে।

দেশি অনেক গানের মতোই 'পাসুরি' প্রথম প্রথম হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ভারতীয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত  আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।

শেঠির কাছে প্রিয়াঙ্কা মাট্টু জানতে চান, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষগুলোকে সঙ্গীতের জাদু দিয়ে একত্রিত করেছেন, তারপর কী করবেন? "আরও 'রাগটন' গাইব" জানান তিনি। তারপর বলেন, "সিদ্দিকির সাথে পাসুরির অ্যালবামের কথা ভাবুন" এ ছাড়া নোয়া জর্জসনের সাথে নিয়ে "ধ্যাননিষ্ঠ রাগ-সঙ্গীত রেকর্ড করার কথা ভাবছি।"

সূত্র: নিউ ইয়র্কার

বিভি/এনএম

মন্তব্য করুন: