মানবাধিকার রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার থেকে সুরক্ষা দেয়: কাদের গনি চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, মানবাধিকার রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার থেকে সুরক্ষা দেয়।তিনি বলেন,মানুষের সুস্থ,সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দেয় মানভাধিকার।মানবাধিকার সমাজের সকল স্তরে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে। এটি নিশ্চিত করে যে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সরকারি নিয়োগ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সমতা বজায় থাকবে। মানবাধিকার জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বা অন্য কোনো পরিচয়ের ভেদাভেদ ছাড়াই সকল মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, এবং মর্যাদার অধিকার সুরক্ষিত করে।
বুধবার (৫ নভেম্বর) বিকালে ঢাকার একটি কনভেনশন হলে মানবাধিকার খবর আয়োজিত ‘মানবিক মানুষ সম্মাননা-২০২৫’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
মানবাধিকার খবর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সাবেক সচিব মার্গুব মোর্শেদ, মানবাধিকার সংগঠক রেজোয়ানা বাশার, নাসরিন হেলালী বক্তব্য রাখেন।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন,বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৬ বছর প্রতি পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।সোনার বাংলাকে পরিণত করা হয়েছিল মৃত্যু উপত্যাকায়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ভয়ঙ্কর সময়ে দেশের মানুষ ছিল অধিকার হারা। দেশে গণতন্ত্র ছিল না। মানবাধিকার ছিল না। আইনের শাসন ছিল না। ভোটাধিকার ছিল না। বাক স্বাধীনতা ছিল না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। ন্যায় বিচারের ব্যাংক হয়ে হয়ে পড়েছিল দেউলিয়া। মানবতার কোষাগার শূন্য হয়ে পড়েছিল। ছিল না স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরাও রেহাই পাননি শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর শাসন থেকে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আফতাব আহমদ, সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি, এডভোকেট এইউ আহমদ, ব্যাংকার বিএম সাকের হোসাইনসহ অসংখ্য পেশাজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরে জীবন দিতে হয়েছিল ৬৮ জন সাংবাদিককে। পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। শাপলা চত্বরে ব্রাশফায়ারে অনেক আলেমকে হত্যা করা হয়। গুম-খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী,কৃষিবিদ, শিক্ষক, ব্যাংকার থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক কর্মী কেউ রেহাই পায়নি নিষ্ঠুরতা থেকে। চাকরি, পদোন্নতি হতো দলীয় বিবেচনায়। ভিন্নমতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তিমূলক বদলি, পদোন্নতি বঞ্চিত ও চাকরিচ্যূতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং র্যাবের গোপন টর্চার সেল-আয়না ঘর তৈরি করে সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর চালানো হতো বর্বর নির্যাতন।
তিনি বলেন, ভোটাধিকার হরণ, ভিন্নমত দলন, বিনাবিচারে মানুষ হত্যা, গুম, খুন, ক্রসফায়ার-নির্যাতন-নিপীড়ন, গায়েবি মামলা, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে পাচার, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকের ভল্টে সোনা জালিয়াতি, বিমান বন্দরের ভল্ট থেকে সোনা চুরি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, শোষন-বঞ্চনা এমনভাবে বেড়ে ছিল যে, দেশ মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল।
এমনি পরিস্থিতিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্ররা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্রদের পক্ষে এসে দাঁড়ায় পেশাজীবী-জনতা।রাজপথে নেমে আসে অভিভাবক ও রাজনৈতিক কর্মীরাও। হাসিনার কাছ থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ আসলো। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি,ছাত্রলীগ, যুবলীগ নির্বিচারে গুলি চালালো ছাত্রদের বুকে।সারি সারি লাশ পড়ে থাকলো রাস্তায়। হাসপাতাল গুলোর বেড এমনকি মেজ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে যায় আহত ও গুলিবিদ্ধ ছাত্র দ্বারা। তারপরও ছাত্ররা থামলো না। বিমান থেকেও চালানো হলো গুলি।একজন নয়, দু'জন নয়- চৌদ্দ'শ ছাত্রকে হত্যা করা হলো। দমানো গেলো না ছাত্রদের। দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গার এক অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থান দেখলো বাংলাদেশ। দেড় যুগ ধরে নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভের বারুদ বিস্ফোরিত হলো চব্বিশের জুলাই-আগস্টে। পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। উল্লাসে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে কোটি জনতা।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, আমরা চাই এমন একটি দেশ যেখানে দুর্নীতি, হানাহানি, গুম, খুন, রাহাজানি, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, নাগরিক নির্যাতনের জন্য থাকবে না আয়না ঘর। থাকবে না বৈষম্য, দারিদ্র, বেকারত্ব, বাজার সিন্ডিকেট, ক্ষমতার অপব্যবহার। থাকবে না মব জাস্টিস। আমরা একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র চাই। যে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের কল্যাণে কাজ করবে।আমরা সেই রাষ্ট্র চাই যেখানে সকল নাগরিক সমঅধিকার ভোগ করবেন। কোনো বৈষম্য থাকবে না। চাকরির ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনায় নয়, মেধারভিত্তিতে নিয়োগ পদোন্নতি হবে।আমরা এমন একটা রাষ্ট্র চাই- যার মালিক হবেন দেশের জনগণ। আমরা নীতিভিত্তিক রাষ্ট্র চাই, নেতাভিত্তিক নয়। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। এক ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়, জনগণের ইচ্ছায় যেন দেশ পরিচালিত হবে। আমরা চাই জনগণই ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। দিনের ভোট রাতে হবে না। হবে না ডামি নির্বাচন। প্রহসনের নির্বাচন কিংবা কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জনরায় কেড়ে নেওয়া হবে না।
স্বপ্নের বাংলাদেশ তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশকে আমরা স্বাবলম্বী দেখতে চাই। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া দুর্নীতির অবসান চাই। একটা শোষণমুক্ত সমাজ চাই। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন চাই। আমরা সর্বত্র ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চাই। আমরা আর কোনো বিচারপতির মুখে শুনতে চাই না ‘টুথ ইজ নো ডিফেন্স’।আমরা এমন এক দেশ চাই, যেখানে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ, জাতি-ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মতাদর্শ নির্বিশেষে সবাই নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবে। সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বীকৃতি ও অধিকার সুরক্ষা পাবে। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানুষকে সম্মান করবে সর্বোচ্চ সেবা দেবেন। মোর্দা কথা আমরা দুর্নীতি মুক্ত জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায় বিচারের বাংলাদেশ দেখতে চাই।যে বাংলাদেশ হবে মানবিক।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বাহিনী যেন রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ বা দলীয় ঠেঙ্গাতে বাহিনীতে পরিণত না হয়।এমন এক রাষ্ট্র কল্পনা করি, যেখানে নৈতিকতা, মানবিকতা, ন্যায়বিচার, সমতা এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে।নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। সমাজে দারিদ্র্যের শিকার কেউ হবে না, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে।সরকারের ভূমিকা হবে নমনীয়, প্রয়োজনমতো কঠোরতা ও মানবিকতা প্রদর্শন। বিরোধী দলকে শোষণ না করে, সব দলের মূল লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন। একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধানের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে বৈষম্য দূর হবে। বিনা খরচে মানসম্মত শিক্ষা ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। কথায় কথায় ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক সমতা আনা হবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক নীতি থাকবে। আমরা আর কোনো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দেখতে চাই না। আমরা আশা করি,সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধতায় আমাদের এই দেশ হবে এমন এক আইডল, যা দেখে পিছিয়ে পড়া অন্যদেশগুলো শিক্ষা নেবে। বাংলাদেশের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাবে। আমাদের এই মাতৃভূমিতে একজন লোকও না খেয়ে থাকবে না। রাস্তায় ধূলোয় মলিন দিন কাটাবে না কোনো শিশু, কেউ কাউকে ধোঁকা দেবে না, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করবে না। অন্যের ক্ষতি করবে না। অন্যের দুঃখে ব্যথিত হবে, পাশে দাঁড়াবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন,নারীদের জন্য চাই মায়ার চাদরে ঘেরা অকৃত্রিম প্রেমের বাংলাদেশ। যেখানে আর লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হবে না একজন মা- বোন। ঘরে বাইরে, চাকরিস্থলে তারা নিরাপদ থাকবেন।বৃদ্ধ বাবা মায়ের জন্য চাই বিশুদ্ধ মায়া ও শ্রদ্ধার বাংলাদেশ। যেখানে কউ আর নিজেদের বৃদ্ধ বাপ-মাকে বোঝা মনে করবে না। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হবে না কোন বাবা মাকে।
বিএফইউজে মগাসচিব বলেন, আজ আমাদের সবচেয়ে বড় দরকার নিজেকে পাল্টানো।আমরা সবাই বাংলাদেশের পরিবর্তন চাই কিন্তু নিজের পরিবর্তন করতে নারাজ। ব্যক্তি বা নাগরিক কেমন হওয়া উচিত এটা সবাই জানি মোটামুটি। এবার শুধু জানলেই হবে না বরং মানতে হবে আমাদের। সততা,দেশপ্রেম, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা আর ভালোবাসার মানদণ্ডে এগিয়ে থাকতে হবে প্রতিটি নাগরিককে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি মব জাস্টিস আর অন্যায়কে না বলার সাহস থাকতে হবে প্রতিটি নাগরিকের। নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে তাহলেই সামগ্রিক পরিবর্তন সহজ হবে।
বিভি/এআই




মন্তব্য করুন: