• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

হুইল চেয়ারে দোকান, সীমিত রোজগারে মায়ের সেবা করে শাওন

এম. দেলোয়ার হোসেন, রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ৫ নভেম্বর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
হুইল চেয়ারে দোকান, সীমিত রোজগারে মায়ের সেবা করে শাওন

ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে না নিয়ে নিজের হুইল চেয়ারকে রোজগারের মাধ্যম বানিয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. শাওন শেখ (২২)। রাজবাড়ী জেলা শহরের শহীদ স্মৃতি স্টেডিয়াম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে প্রতিদিন সকালে নিজের হুইল চেয়ারের ওপর খুলে বসেন ছোট্ট একটি দোকান। 

হুইল চেয়ারের মধ্যে বিশেষ কায়দায় তৈরি দোকানে থাকে চিপস, চানাচুর, আচারসহ বিভিন্ন পণ্য। গ্রাহকদের কাছে হাসিমুখে বিক্রি করেন অসুস্থ শাওন। প্রতিদিন দোকান থেকে বিক্রি করে যে টাকা লাভ হয় সেই টাকা দিয়ে ক্রয় করেন মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষুধ ও ভাইয়ের জন্য খাবার।

চোখ-মুখে ক্লান্তি থাকলেও মনে তার আত্মতৃপ্তি। প্রতিবন্ধকতার বেড়া পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে কিশোর শাওন প্রমাণ করেছেন সাহস আর দৃঢ় সংকল্প থাকলে কোন বাধা অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। তবে, সুস্থ হয়ে একটি বড় দোকান দিতে চান শাওন।

শারিরীক প্রতিবন্ধী শাওন শেখ রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের মাটিপাড়া গ্রামের ভূমিহীন বাসিন্দা রিকশাচালক শফিক শেখ ও সাহানা বেগম এর মেজো ছেলে।

জানা যায়, রাজবাড়ী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের জেলখানার পাশে একটি বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকেন ভূমিহীন বাসিন্দা রিকশাচালক শাফিক শেখ ও সাহানা বেগম দম্পতি। এই দম্পতির বড় ছেলে সাগর শেখ (২৩) ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন, মেজো ছেলে শাওন শারীরিক প্রতিবন্ধী ও ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করে। এই দম্পতির মেজো ছেলে শাওন পড়ালেখায় ভালো ছিল।পড়তেন রাজবাড়ী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে। অসুস্থতার মধ্যেও দিয়েছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে, ভাগ্য সহায় হয়নি শাওনের। ২০২১ সালে অজানা রোগে আক্রান্ত হয় শাওন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলে তার। কিন্তু, পরে আর সুস্থ হতে পারেনি সে, পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তার হাঁটাচলা।

২০২৪ সালে শাওনের ভাগ্যে জোটে একটি হুইল চেয়ার। ঘরে অলস বসে না থেকে সেই চেয়ারে বিশেষ কায়দায় তৈরি করে একটি দোকান। জমানো ২ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা হয় দোকান। দোকানে চিপস, চানাচুর, আচারসহ বিভিন্ন খাবার তোলেন প্রতিবন্ধী শাওন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় শহরের শহীদ স্মৃতি স্কুলের সামনে নিয়মিত চলে আসে শাওন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে বিভিন্ন খাবার কেনে। দোকানে যতটুক লাভ হয় তাই তুলে দেন মায়ের হাতে। মা সাহানা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হার্টে সমস্যা ও মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় নিয়ে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ভুগছেন তিনি। উপার্জিত টাকা থেকে মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় করেন শাওন।

শাওন শেখ বলেন, ২০২১ সলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু, হঠাৎ এক অজানা রোগ বাসা বাঁধে আমার শরীরে। তারপর থেকে আমার হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারিনি। দীর্ঘদিন ঘরে পড়েছিলাম। পরে একসময় চিন্তা করলাম এভাবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না, আরও অসুস্থ হয়ে যাব। তখন নিজের জমানো ২ হাজার টাকা দিয়ে কিছু খাবার সামগ্রী কিনে হুইল চেয়ারে করে শহীদ স্মৃতি স্কুলের সামনে বিক্রি করি। প্রতিদিন বেচা-বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে মায়ের জন্য ঔষধ কিনি ও ছোট ভাইয়ের জন্য খাবার কিনি। 

সরকারের কাছে ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে আবেদন জানিয়ে শাওন বলে, আমার বেশি কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। ঠিক মতন যেন চিকিৎসাটা নিতে পারি এবং আমার এই ছোট্ট দোকানটা আরেকটু বড় করতে পারি এজন্য আমি সাহায্য সহযোগিতা চাই।

প্রতিবন্ধী দোকানদার শাওন শেখের মা শাহানা বেগম বলেন, আমিও এক সময় মানুষের বাড়ি কাজ করতাম। বর্তমানে অসুস্থতার জন্য আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ওর বাবা একা পরিবার সামাল দিতে হিমশিম খায়। আমি মা হয়ে প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে ঔষুধ আনতে বলি। ও কোনদিন না করে না। ওর একটি বড় দোকান করার ইচ্ছে।

শাওনের বাবা মো. শফিক শেখ বলেন, আমি দারিদ্র মানুষ। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। বছর তিনেক আগে অজানা রোগে আক্রান্ত হয় শাওন। পরে ওকে ফরিদপুর হাসাপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কোন রোগ ধরতে পারেনি তারা। তখন তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো চিকিৎসক। অর্থের কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। অর্থের অভাবে ছেলের চিকিৎসাটাও আর চালিয়ে যেতে পারিনি আমি। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার এই অসুস্থ ছেলের দিকে একটু নজর দেবেন।

স্থানীয়রা বলেন, শাওন অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষ। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। দীর্ঘদিন ধরে দেখছি সে কারও কাছে কোন সাহায্য চায় না, ভিক্ষাও করে না। সে ব্যবসা করে খাচ্ছে। সে যেন ব্যবসা করে খেতে পারে এজন্য সকলের সহযোগিতা দরকার।

স্থানীয় শহীদ স্মৃতি স্টেডিয়াম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনয় কুমার বিশ্বাস বলেন, শাওন আমাদের বিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট দোকান করে। আমরা মানবিক কারণে তাকে ব্যবসা করতে দিই। শাওন প্রতিবন্ধীতা জয় করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

রাজবাড়ী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মোঃ ফেরদৌস বলেন, শাওন শেখ একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলাম সে দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে না। সে যদি সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা অফিসে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে আমরা অবশ্যই তাকে সার্বিক সহযোগিতা করবো এবং খতিয়ে দেখবো তার ভাতা কেনো বন্ধ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু প্রতিবন্ধী শাওন শেখ স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি হুইল চেয়ারে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেছেন। উনি যদি আমাদের প্রতিবন্ধী ঋণ কর্মসূচি থেকে ঋণ নিতে চান তাহলে আমরা তাকে ঋণ দিয়েও সহায়তা করবো এবং তার আয় বর্ধক মূলক কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করবো।

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: