• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করলেই মারপিট, শ্লীলতাহানি, খুন

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
পশ্চিমবঙ্গে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করলেই মারপিট, শ্লীলতাহানি, খুন

প্রতি বছর কালীপূজার সময়ে ভারতের পশ্চিবঙ্গে দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বায়ু থেকে শব্দদূষণের কোপে পড়েন সাধারণ মানুষ। এ বারও তার ব্যতিক্রম হল না। বরং প্রতিবাদীদের আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে।

সাউন্ড বক্স বাজাতে না চাওয়ায় এক যুবককে কুপিয়ে খুন করা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের কুস্তিয়া এলাকায়। মৃতের নাম সনাতন নস্কর। অভিযোগ, প্রতিবেশী পিন্টু সাহা ও তার স্ত্রী ছুরি মেরে খুন করেন সনাতনকে।

গত বুধবার রাতে এলাকার এক পূজা মণ্ডপে নিজের সাউন্ড বক্সে গান বাজাচ্ছিলেন ৩২ বছরের সনাতন। প্রতিবেশীর বাড়িতে এক হৃদরোগী থাকায় তাদের অনুরোধে তিনি সাউন্ড সিস্টেম খুলে বাড়ি ফিরে যান। কিছুক্ষণ পরে পিন্টু ও তাঁর স্ত্রী বক্স বাজানোর জন্য চাপ দেন সনাতনকে।

ওই যুবক পিন্টুদের অনুরোধে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় বচসা। অভিযোগ, প্রথমে পিন্টুরা সনাতনের মা ও ভাইকে মারধর করেন। প্রতিবাদ করলে পিন্টু ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সনাতনের উপরে। শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাত করা হয় তাকে। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা সনাতনকে উদ্ধার করে কালিকাপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি।

প্রায় প্রতি বছরই শব্দ দানবের প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বছর দুয়েক আগে মালদায় খুন হন আফজল মোমিন। ২০২১ সালে মারা যান সুভাষ বিশ্বাস। ২০১৯ সালে মুর্শিদাবাদে মৃত্যু হয় হারাধন মালের। ২০১৬ সালে কলকাতায় মারা যান পূর্ণিমা মৈত্র। এই দীর্ঘ তালিকায় সর্বশেষ শব্দ শহিদ সোনারপুরের সনাতন।

খোদ কলকাতা শহর শব্দ দানবের কবলে পড়েছে। গত শুক্রবার মধ্যরাতে মারধরের মুখে পড়েন টালিগঞ্জের একটি পরিবার। তাদের বাড়ির চার বছরের শিশুর হার্টের সমস্যা রয়েছে। টালিগঞ্জ রোডে রাস্তার ধারেই তাদের বাড়ি। কালী প্রতিমা বিসর্জনের জন্য যখন শোভাযাত্রা যাচ্ছিল, তখন বাড়ির সামনে শব্দবাজি ফাটানো হয়। এতে শিশুর অসুবিধা হওয়ায় তার মা ও পিসি আপত্তি জানান।

অভিযোগ, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শোভাযাত্রা থেকে কয়েকজন যুবক এসে বাড়ি ঢুকে দুই মহিলার শ্লীলতাহানি করে। তাদের মারধর করা হয়। ভাঙচুর চালানো হয় বাড়িতে। এই পরিস্থিতিতে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল সাংসদ মালা রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আক্রান্ত পরিবার। এরপরে সেখান থেকে চলে যায় অভিযুক্তরা। টালিগঞ্জ থানা অভিযুক্তদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামে এক দম্পতিকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার রাতে বধূকে শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও অভিযোগ।

কালী প্রতিমার শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়ার সময়ে শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছিল। এর প্রতিবাদ করার দম্পতির দিকে শব্দবাজি ছুঁড়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ। প্রতিবাদ করায় তারা মারধরের মুখে পড়েন। বাড়ির বধূ শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছেন।

খোদ পুলিশকর্মীর পরিবার শব্দবাজি নিয়ে প্রতিবাদ করে মারধরের মুখে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা উত্তর ২৪ পরগনার খড়দায়।

২১ অক্টোবর অর্থাৎ কালীপুজোর পরের দিন গভীর রাত পর্যন্ত শব্দবাজি ফাটছিল  কলকাতা পুলিশে কর্মরত দিব্যেন্দু সাহার ফ্ল্যাটের সামনে। তার স্ত্রী সুস্মিতা এত রাতে বাজি ফাটাতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি। এই ঘটনার ভিডিও ভাইরালও হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ।

নানারকম বিধিনিষেধ সত্ত্বেও উৎসবকে উপলক্ষ করে ডিজে বক্সের দাপট বেড়েই চলেছে কলকাতা ও জেলায়। মূলত বিসর্জনের শোভাযাত্রায় মিনি ট্রাকের উপর বসানো থাকছে প্রায় ১০-১২ ফুট উচ্চতার ডিজে বক্স। সেগুলি তারস্বরে বাজছে। হাই বাস ডিভাইস হওয়ার ফলে শব্দের প্রচণ্ড অভিজাত হচ্ছে আশপাশে। 

কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে, তার অনেকগুলিতে ডিজে বক্স ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত শোভাযাত্রা চলতে থাকায় বাজতে থাকে এই বক্স। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শব্দসীমার উপরে বক্স বাজানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবেল মাত্রারও বেশি। 

কোথাও কোথাও ডিজে বক্সের সঙ্গে লাউড স্পিকার ও ঢাক-ঢোল একসঙ্গে বেজেছে। ফলে শব্দের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে আরো। এ নিয়ে বিভিন্ন থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে ডিজের উৎপাত থামেনি।

উৎসবকে কেন্দ্র করে শুধু শব্দবাজি নয়, সার্বিক শব্দদূষণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সারা বছর পরিবেশ নিয়ে কাজ করে সবুজ মঞ্চ। সংগঠনের তরফে পরিবেশকর্মী নব দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "আইন যতটা শব্দ তাণ্ডবকে অপরাধ বলে গণ্য করে, সমাজ ততটা করে না। শব্দবাজি এখন অর্থবান মানুষদের হাতের মুঠোয়। বাজি এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। উচ্চবিত্তরাই এর পৃষ্ঠপোষক। তারা জানেন এই অপরাধ করলে তারা ছাড় পেয়ে যাবেন। যতদিন না এটা বন্ধ হচ্ছে, ততদিন অবস্থার পরিবর্তন হবে না।"

শুধু তাই নয়, একের পর এক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শব্দকে হাতিয়ার করে একশ্রেণীর মানুষ যেন আস্ফালন করছে। এমনটাই মত অনেক পর্যবেক্ষকের।

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে লুম্পেন সংস্কৃতির পরিসর তৈরি হয়েছে। শব্দবাজি ফাটানোর মধ্যে ক্ষমতা জাহিরের চেষ্টা আছে। লুম্পেন অর্থনীতির জন্য একশ্রেণীর মানুষের ক্ষমতা ফুলেফেঁপে উঠেছে। তাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার দম্ভ এই বাজি ফাটানোর মধ্যে প্রকাশ পায়।"

তিনি বলেন, "সামগ্রিকভাবে বাজি নিষিদ্ধ করতে হলে নির্দেশ দিয়ে কাজ হবে না। যে আর্থিক দৈন্য মানুষকে বাজি শিল্পের মতো বিপজ্জনক শিল্পের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা থেকে মুক্তির জায়গা যদি খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান নেই। একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। সামান্য বাজি নিয়ে প্রতিবাদ করলে নিগৃহীত হতে হচ্ছে বা বক্স বাজানো বন্ধ করলে খুন হতে হচ্ছে, এটা আসলে প্রভুত্ব দেখানোর একটা জায়গা। লুম্পেন সংস্কৃতি আমাদের এখানে নিয়ে গিয়েছে।"

মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপরতা বেড়েছে। আমি যেটা মনে করছি, সেটা করব। তাতে অন্যের কী ক্ষতি হচ্ছে না হচ্ছে, সেটা দেখার দরকার নেই। শিশু, বয়স্ক, হার্টের রোগী, ডিপ্রেশন, অটিজমে আক্রান্তরা শব্দবাজি বা ডিজে বক্স থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমনকী চারপাশের অবলা জীবজগৎ ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়। বিন্দুমাত্র সচেতনতা দেখালে অনেক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা যায়।"

তিনি বলেন, "উৎসবের সঙ্গে এখন রাজনীতিকে মেশানো হয়। শব্দসীমা আগে ৯০ ডেসিবেল ছিল। সেটা কমিয়ে ৬০ করা হয়েছিল। এখন সেই মাত্রা ১২৫ করা হয়েছে সরকারের উদ্যোগে। খোলা বাজারে উচ্চ ডেসিবেলের শব্দবাজি বিক্রি করা হয়। এটা নিয়ে প্রতিবাদ বা অভিযোগ করা হলে তাতে গুরুত্ব দেয়া হয় না। উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক যখন শব্দবাজির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলেন, তাকে সরিয়ে দেয়া হল। এটা একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করল সরকার। এতে আমাদের যে ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা নেই।"

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2