• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

কবিতায় চিত্রকল্পের কাজ কী?

প্রকাশিত: ১৬:১০, ৫ মার্চ ২০২১

আপডেট: ২০:৫১, ৫ মার্চ ২০২১

ফন্ট সাইজ
কবিতায় চিত্রকল্পের কাজ কী?

ড. মাহবুব হাসান

প্রশ্নটি পাঠকের মনে খুব সহজেই উদিত হয়। কারণ, সাধারণ পাঠক জানেন ছবি বা চিত্রের কথা। শব্দ দিয়ে ছবি সৃষ্টি করা সহজ, কিন্তু তার সংগে কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করতে না পারলে এবং নতুন কিছু সৃষ্টি করতে না পারলে তাতে কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় না। এখানে মনে রাখতে হবে, কবিতায় সৌন্দর্য কোনো আকার সর্বস্ব উপলখন্ড নয় বা দৃশ্যমান কোনো উপকরণ নয়। আসলে সৌন্দর্যের যেমন কোনো সংজ্ঞা নেই, তেমনি রূপও নেই। সে আসলে অপরূপ চেতনারই ফসল। ইমেজিস্ট কবি এজরা পাউন্ড ১৯১৩ সালে পোয়েট্রি পত্রিকায় লিখেছিলেন "An ÔÔImage' is that which presents an intelectual and emotional complex in an instant of time,'' সার্থক চিত্রকল্প এমন এক মেটাফরধর্মী চিত্ররূপ, যা প্রথাগত সাদৃশ্যকে অতিক্রম করে পাঠককে চালিত করে ব্যঞ্জনার্থের দুঃসাহসিক গভীরতায়। যথার্থ চিত্রকল্প নিছক ‘সজ্জাসর্বস্ব’ বা ‘decorative' নয়, তা ক্রিয়ামূলক’ বা functional, দৃশ্য-শ্রুতি- ঘ্রাণ-স্পর্শ-স্বাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন আশ্রয় করে কবি শব্দের এই জটিল যৌগ নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেন, শব্দের অন্তর্নিহিত সংকেত-ধর্মিতাকে অভাবিত সৃজনী মাত্রায় চিহ্নিত করে। [কুন্তল চট্টোপাধ্যায় ; ২০০১ : ১৫০]

[caption id="attachment_76449" align="aligncenter" width="626"]সংগৃহীত চিত্রকল্প[/caption]

কাজটা সহজ নয় এবং প্রচলিত অর্থে স্বাভাবিকও নয়। সংবেদনশীল কবি-মন যখন তার বুদ্ধির কারুতে এমন এক রূপকধর্মী চিত্র আঁকেন, যা তার প্রচলিত ছবি বা চিত্রকে ছাপিয়ে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে নেয়। এজরা পাউন্ড এ-রকমটাই ভেবেছিলেন। আমরা তার এই চিত্রকল্প চেতনাকেই সমর্থন করি। কারণ, আমরা দেখতে চাই কবিতায় সেই দ্যুতি রচিত হোক, যা পার্থিব ও প্রায় অপার্থিব চিত্রসাম্যের ভেতর দিয়ে সাদৃশ্যমূলক অলংকারকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলেছে। এবং তা মনে-প্রাণে এমন আবেগ সৃষ্টি করছে, যা অনেকটাই অভিনব এবং মিথস্ক্রিয়াজাত। বস্তুনির্ভর ও অবস্তুনির্ভর চিত্র বা ছবির মধ্যে সেতু হচ্ছে উপমা। তাই জীবনানন্দ দাশের প্রথম ও প্রধান বিশ্বাস ছিলো ‘উপমাই কবিত্ব’। বুদ্ধদেব বসুর মতে ‘চিত্র ও চিত্রকল্পের সহায়তায় বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাবগত সাদৃশ্য আবিস্কার করে উপমা’। ‘ভাব যেখানে ছবি হয়ে উঠেছে, চিন্তা যেখানে স্পর্শসহ রূপ নিলো, সেখানেই-- কোনো না কোনো সূক্ষ্ম, চতুর, লুক্কায়িত উপায়ে উপমার ব্যবহার অনিবার্য। [বুদ্ধদেব বসু: ১৯৭৭; ১৯৭]
[জীবনানন্দ: কবিতার নান্দনিকতা/চিত্রকল্পের দ্যুতি: মাহবুব সাদিক, থেকে উদ্ধৃত]

দীর্ঘকাল সত্যি আমি মসজিদে যাইনি, শৈশবে
বাজান যেতেন নিয়ে হাত ধ’রে, মনে পড়ে। ইমামের সুরা
অবোধ্য ঠেকতো ব’লে ঝাড়-লণ্ঠনের
শোভা, হৌজে রঙিন মাছের খেলা দেখে
কাটতো সময় মসজিদে, তোর মনে নেই?
কখনো ঝড়ের রাতে, উথাল-পাথাল রাতে, ব্যাকুল বাজান
দিতেন আজান, যেন উদাত্ত সে স্বর রুখবেই
অমন দামাল ঝড়, বাঁচাবে থুত্থুরে ঘর-বাড়ি-- তোর মনে নেই?

[দু:সময়ে মুখোমুখি/শামসুর রাহমান/শ্রেষ্ঠ কবিতা]

[caption id="attachment_76450" align="aligncenter" width="675"]কবি শামসুর রাহমান[/caption]

এখানে অনেক চিত্র আছে, যা একের পর এক গেঁথে গেছেন শামসুর রাহমান। সেই সব চিত্রের ভেতরে অনেক কাহিনী আমরা আবিস্কার করতে পারি। কারণ, প্রত্যেক চিত্রের মধ্যে নিহিত আছে সেই অনিবার্য সত্য, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ, যা রাহমানের বর্ণনায় আছে। পংক্তিগুলোতে সেই ছবি পাই। শৈশবে তাঁর পিতা তাঁকে হাত ধরে মসজিদে নিয়ে গেছেন- এই চিত্রের পাশেই বা পড়েই বলছেন তিনি অবোধ্য তাঁর কাছে ‘ইমামের’ সুরা। ফলে শিশুটি মসজিদের রঙিন ঝাড়, হৌজে রঙিন মাছ দেখে সময় কাটাতো। এই ছবিগুলোর পর তিনি এমন এক প্রসংগ টানলেন, যা বাস্তব ও সত্য দৃশ্যকল্প। গ্রামাঞ্চলে, বিধ্বংসী ঝড়ের কবল থেকে জীর্ণ-শীর্ণ ঘর-বাড়ি বাঁচাতে ‘ব্যাকুল’ স্বরে আজান দিতেন সেই শিশুর বাজান। যাতে ঝড়ের আঘাত বা ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারবে তাঁর সেই বিশ্বাসের আজান। একটি বাস্তব প্রাকৃতিক আঘাতকে একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের জোর দিয়ে থামানোর চেষ্টাকে যে অনন্য মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, যা লোকসমাজের আবহমানতার নিরিখে রচিত হয়েছে।

এই চিত্রগুলোর সমন্বিত রূপ যদি আমরা কল্পনায় আনি, তাহলে দেখবো সেখানে নতুন যে বীক্ষার স্পর্শ-জ্ঞান জন্মে, তা অভিজ্ঞতার আধার থেকে জাত হয়েছে।

বৈসদৃশ্যের মধ্যে সাদৃশ্য আবিস্কারকে অ্যারিস্টটল ‘মেটাফর’ রূপে চিহিৃত করেছিলেন তাঁর পোয়েটিকস গ্রন্থে। (Aristotle, On the art of poetry, trans. Ingram Bywater, o.u.p, 1967. p-78) আসলে পরস্পরবিরোধী শব্দের আভিধানিক অর্থকে ছাপিয়ে ওঠে সেই শব্দের ব্যঞ্জনার্থ বা তার নতুন ইমেজ-অর্থ। আমি শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে উদাহরণ দেবার চেষ্টা করবো।

কান পেতে থাকি দীপ্র কণ্ঠ শোনার আশায়
কাকের বাসায় ঈগলের গান কখনো যায় কি শোনা?
(ইলেক্ট্রার গান/শামসুর রাহমান/শ্রেষ্ঠ কবিতা )

কাকের বাসায় ঈগল বাস করে না কিংবা ঈগলের বাসায় কাক বাস করে না। প্রাকৃতিক সত্য হচ্ছে ওই পাখি দু’টি ভিন্ন প্রজাতির। তাদের বাসা বাঁধবার রীতি-কৌশলও ভিন্ন। তাদের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই আচরণের ভিন্নতা আছে। অর্থাৎ দু’টির মধ্যে কোনো মিল নেই। বরং বলবো সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি। তাই শামসুর রাহমান বৈসাদৃশ্যকেই এখানে উপস্থাপন করেছেন। যে দীপ্র কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে চান, সেটা যে পাওয়া যাবে না, তাকেই ঈগলের বাসার সাথে তুলনা করেছেন, যা অস্বাভাবিক।

আল মাহমুদের কবিতায় দেখা যাক এ-রকম বৈসাদৃশ্যের নমুনা এবং তাঁর কাজ।

যে যাদুকর আমাকে একদা উড়াল শিখিয়েছিলেন
যেন মন্ত্র পড়ে আবার তা তুলে নিলেন। কিংবা যেন
আমারি ডানা আমার বাহুর মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে
পিঠে রয়ে গেলো দগদগে ব্যথা।
(বুদ্ধদেব বসুর সাথে সাক্ষাৎকার/আল মাহমুদের কবিতা)

অথবা

পৃথিবী থেকে অনেক দূরে যেখানে মেঘের গোল-গম্বুজে,
অকস্মাৎ সেখানে হযরত আলীর খঞ্জরের মত
ঝলসে উঠলো আমার ঈদের চাঁদ।
(নব ইমারতের বাইরে/আল মাহমুদ/আ.মা.ক)

[caption id="attachment_76448" align="aligncenter" width="637"]কবি আল মাহমুদ[/caption]

দৃশ্যের বাইরে কিন্তু বাস্তবের বাইরে নয়, এমন অসম মেটাফরধর্মী বৈসাদৃশ্য আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি। আল মাহমুদের কবিতার প্রথম উদ্ধৃতিতে দু’টি মেটাফরিক বিশেষণ শব্দ পাচ্ছি, যা ব্যবহার করে গোটা চিত্রটিকে বাস্তব থেকে পরাবাস্তরের স্তরে নিয়ে গেছেন তিনি। ডানা আর দগদগে শব্দ দু’টি সেই কাজ করেছে। মানুষের ডানা নেই, কিন্তু উড়বার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আছে। ব্যথা একটি কোমল অবস্তুগত শারীরিক-মানসিক শব্দ। সেই শব্দের আগে দগদগে পদটি ব্যবহার করে ব্যথার তীব্রতাকে নতুন কনোটেশনে নিয়ে গেছেন তিনি। এভাবে কবিতার চিত্রকে তার অন্তর্গত শক্তির জোরে চিত্রকল্পে রূপান্তরিত করে নেন কবি। আল মাহমুদ সেই কাজই করেছেন।

দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে পাচ্ছি কল্পনার নতুন ভাষ্য। ঈদের চাঁদের সংগে হযরত আলীর খঞ্জরের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য ইমেজ সৃজিত হয়েছে, তাতে এটাই মনে হবে পাঠকের যে ঈদের চাঁদ তালোয়ারের মতো ধারালো ও অনমনীয় ঈর্ষণীয় প্রতীক হয়ে উঠেছে। আবার এভাবেও ভাবতে পারি যে, হযরত আলীর তালোয়ারের মতোই ধারালো, অনমনীয় এবং ঈর্ষণীয় প্রতীক হয়ে উঠেছে আকাশের ওই ঈদের চাঁদ। উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক বা বৈসাদৃশ্যমূলক চিত্রের মিলনে যে অভিনবত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই কবির কাম্য। আমার মনে হয় শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতায় সেই সব ‘অভিনবত্ব, অপূর্বত্ব ও আবেগের যথাযথ সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়া’--- যা মাহবুব সাদিক বলেছেন তাঁর জীবনানন্দ দাশের কবিতার চিত্রকল্প বিষয়ে লিখতে গিয়ে, তা অর্জিত হয়েছে।
‘কবির বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতাজাত অভিজ্ঞান ও মনন-কল্পনা-স্বপ্ন-স্মৃতি’ [মা.সা.] ইত্যাদিই কবিতাকে অভিনবত্ব দান করে। কবিদের চেতনা সব সময়ই অভিনব কিছু সৃষ্টি করে, যা হবে তার মৌলিক সৃষ্টি। আকাশে শাদা-কালো মেঘের গম্বুজ আমরা অনেকেই দেখে আসছি, কিন্তু কবির দেখা ভিন্ন। সেই ভিন্নতাই আল মাহমুদকে নতুন কনোটেশনের স্বাদ দিয়েছে।

(আগামী সপ্তাহে সমাপ্য)

ড. মাহবুব হাসান : কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন: