রমজান অর্থনীতির শিরায় রক্ত প্রবাহ

নানা অঘটন ও দুর্ভাবনার মাঝেও অর্থ সেক্টরে কিছুটা স্বস্তির ঢেউ। কিছুদিন আগেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছিল। রমজানে বাজার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এ নিয়ে ঘুরছিল নানা শঙ্কা। তা অনেকটা কেটে গেছে। ভোজ্যতেল আর চাল ছাড়া বাজারে চলে আসে অনেকটা আয়ত্বে। একসময় পেঁয়াজের কেজি ২৫০—৩০০ টাকা ছিল, এখন ৪০—৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ মিলছে। সবজির দামও হাতের নাগালে। বাজার এভাবে স্থিতিশীল থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফুসরত পাবে। গত ৬ মাসে সরকার দেশি—বিদেশি ৬২ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করেছে। দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ১৮.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যা গতবছরের এই সময়ের তুলনায় ৪ বিলিয়ন বেশি। প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ৯টি দেশের ভিসা প্রসেসিং দিল্লির পরিবর্তে ঢাকায় চালু হয়েছে। দেশের রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অ্যাকাউন্ট থেকেই উদ্ধার করেছে ৬৩৫ কোটি টাকা। দেশের খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। এর মাঝে ব্যবসায়ী মহল যতদূর পারছে আয় লুফে নিচ্ছে। ক্রেতাসাধারণও কেনাকাটায় ব্যস্ত যার যার সাধ্য মতো। এটাই বাংলাদেশের বাজারি বৈশিষ্ট্য। এর মধ্য দিয়েই রোজা—ঈদ—চাঁদ—পূজা—পার্বণ যায়-আসে। শরবতসহ ভিন্ন হালাল পানীয়, চিরাচরিত মুড়ি, পেঁয়াজু, জিলাপি, বেগুনি, ছোলাসহ বিভিন্ন ধরনের নতুন আইটেমে সরগরম ইফতারের বাজার। যার নির্যাস পড়ছে অর্থনীতিতে। বরাবরই রোজা—রমজানে অর্থনীতির বিশাল সংযোগ। এ মাসে ইবাদতে নেকি হাসিলের বিষয়টা ঐশ্বরিক। আবর সংযম—কৃচ্ছ্বতা সাধনের বিষয় অনেকটা বান্দার হাতে। এ সময়ে কিছু বিশেষ খাদ্য পণ্যের বাজার, নানা ধরনের বিনোদন, পরিবহন সেবা ইত্যাদি থাকে বেশ চাঙ্গা। রমজানের ১০—১২ দিন পর দেখা দেয় পোশাক—আশাক, জুতাসহ ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও জোগান। সবমিলিয়ে অর্থনীতির যজ্ঞ।
বিশেষ কিছু খাদ্য, পোশাক ও নানা রকম সেবার চাহিদা বাড়ার কারণে এগুলোর উৎপাদন, বিপণন এবং বিক্রির ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাসে ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ইত্যাদির চাহিদা বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীদের জন্য এটি মোক্ষম সময়। আর রাজনৈতিক—অরাজনৈতিক, অন্তর্বর্তী বা মধ্যবর্তী যেকোনো সরকারের জন্য সময়টা বড় কঠিন। ইবাদত—বন্দেগির সাথে দেশের সামাজিকতা ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সাজ সাজ রব আপনাআপনি ব্যাপার। টাকার অংকে এটি নির্ণয় করা কঠিন। এরপরও বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআইর তথ্য দৃষ্টে ধারণানির্ভর করে বলা হয়, বাংলাদেশে বার্ষিক অর্থনীতির আকার প্রায় সাড়ে তের লাখ কোটি টাকা। আর শুধু রোজার মাসেই সার্বিক অর্থনীতিতে যোগ হয় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা।
এ হিসাবের সাথে অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত রয়েছে। আবার বাংলাদেশের ঈদ অর্থনীতি নিয়ে বাস্তবে গবেষণার নজির এখনও নেই। তাই ধারণাই ভরসা। আবার দ্বিমতও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কারণ এ সময় অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের পুরোটা সার্বিক অর্থনীতিতে সেভাবে যোগ হয় না। আত্মিক—নৈতিক দিকে কিন্তু হেরফের নেই। আয়—ব্যয় নিয়ন্ত্রণের প্র্যাকটিসের সুযোগও থাকে অবারিত। এটি একদম যার যার ব্যাপার। যে যেভাবে নেন। সাওম তথা রোজা মানুষকে সঞ্চয় ও নির্ভুল আয়—ব্যয়ের একটি পদ্ধতি নির্দেশ করে। আবার যথেচ্ছা কেনাকাটা —খানাপিনার পথও অবারিত। সংযম সাধনায় মানুষ পরিমাণ মতো খেলে অর্থ ও শ্রম ব্যয় হবে কম। এটি অর্থনীতি ও আয়—ব্যয় নিয়ন্ত্রণের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া।
গরিব—দুঃখীদের দান—সদকার মাধ্যমে গরিব—দুঃখীদের আর্থিক সংকট অনেকাংশে লাঘব হয়। এর মধ্য দিয়ে সমাজে—রাষ্ট্রে হতে পারে সাম্য প্রতিষ্ঠার চর্চা। ইসলামে বেশি লাভের আশায় মজুদ করা নিষেধ। বেঁচে যাওয়া সেই অর্থ যেতে পারে জাকাত—ফিতরাসহ দান—খয়রাতে। যা ধনী—গরিবে কিছুটা হলেও ব্যবধান কমায়। ধনীরা অধিক পরিমাণে ধন—সম্পদ মজুদ না রাখলে অর্থনীতির ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন বাড়তে বাধ্য। ইফতার বেচাকেনায় গ্রাম থেকে শহর, পাড়া মহল্লায় অর্থের প্রবাহ যে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব। রমজানে ইফতার বাজার দেশের অর্থনীতিতে যে তারল্য বাড়ায় এ নিয়েও সে রকম গবেষণা নেই। রমজানের শেষদিকে আসে ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশেও ঈদ বাণিজ্যে লাখ কোটি টাকা হাতবদল হয়।
রমজানে অঘোষিতভাবে দাম বাড়তে থাকা খাদ্যপণ্যের গড়পড়তা তালিকা সবারই জানা। কখনো কখনো এতে নতুন নতুন পণ্যও যোগ হয়। তখন তালিকা হালনাগাদ করতে হয়। ডাল, ছোলা, তেল, খেজুর, তরমুজ, এমন কি লেবু—শষার মতো পঁচনশীল আইটেমও কখনো কখনো সাবজেক্ট হয়ে যায়। এ নিয়ে ছোটবড় মজুতদারীও চলে। বড়রা বড়দের মতো। ছোটরা মানে সাধারণ ক্রেতাদের মাঝেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনার মধ্য দিয়ে একেকজন মজুতদার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। রমজান আসা মানে জিনিসের দাম বাড়ার, বাড়তি মুনাফার সুযোগ নিতে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। যা কখনো কারো কাম্য নয়। অবশ্য বেশিরভাগ মুসলিম দেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে রমজান ঘিরে চলে নানা রকম ছাড়—অফার।
রমজানের পুরো মাস অর্থনীতির এ সতেজ রূপ আসছে একটা চেইনের মাধ্যমে। পণ্যের হাতবদল, অর্থের স্থানান্তর। এরইমধ্যে ক্ষুদ্র ও পাইকারি বিক্রেতারা যারপরনাই ব্যস্ত। দম ফেলার সুযোগ নেই। সারাদেশে বাহারি রকমের পোশাক, পাদুকা, প্রসাধন সামগ্রী, অলঙ্কারসহ নিত্যপণ্যের বাজারে বেদম ভীড় জমেছে। টুপি, আতর কেন্দ্রীক অর্থনীতিও একদম ছোট নয়। টুপি, মিসওয়াক ও আতরের দোকানগুলোতে এবার দুই—তিন রোজা থেকেই ভীড়—বাট্টা জমেছে। দেশি—বিদেশি বিভিন্ন রকমের টুপির দোকানে দিনে লাখ টাকাও বেচাকেনা হচ্ছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি টুপি যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আসছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। রমজান উপলক্ষে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়েছে। এসবের যোগফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনও স্পষ্ট। এবার বাজার নিয়ন্ত্রণের কিছু ভিন্নতাও লক্ষণীয়।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল প্রতিরোধে ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান কিছুটা হলেও ফল দিচ্ছে। ভোজ্যতেল ছাড়া রোজায় নতুন করে কোনো পণ্যের দাম চড়েনি। কিছু কিছু পণ্যের দাম কমেছে। এবার ইফতার আদান—প্রদানের সংস্কৃতিও বাড়বাড়ন্ত। রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে গত কয়েক বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও সংস্থার ইফতারের আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছিল অত্যন্ত সীমিত।
লেখক: সাংবাদিক—কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: